—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
ভগবান না করুন, ভাবা যাক দেশ জুড়ে খেতের ফসল শুকিয়ে গেল। হাহাকার পড়ে যাবে, দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় সাজ-সাজ রব উঠবে। কিন্তু যদি বড় গাছগুলো শুকিয়ে যায়? গোড়ায় তেমন খেয়ালই হবে না, ক্রমশ বোঝা যাবে প্রকৃতির ভারসাম্য বিপন্ন। এক দিন ফসলও ফলবে না, দেশ চরম সঙ্কটে পড়বে।
প্রথম বিপদটা বন্যা বা মহামারির মতো। ক্ষতিটা স্পষ্ট, বাঁচার তাগিদও। দ্বিতীয়টা তুলনীয় শিক্ষার বিপর্যয়ের সঙ্গে: এক দিনে ধরা পড়ে না, কিন্তু গভীরে অগোচরে সমাজের বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করে।
আমরা কি আজ দ্বিতীয় অবস্থার সম্মুখীন? এ দেশে শিক্ষা যুগ্ম তালিকায়। ফলে কেন্দ্র ও রাজ্য এ ওর ঘাড়ে দায় ঠেলে। কেন্দ্র একতরফা সিদ্ধান্ত চাপায়, যদিও খরচের প্রায় অর্ধেক রাজ্যই মেটায়। দুইয়ের ক্ষমতা ও অর্থবলে প্রবল অসাম্য, ফলে কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে ব্যবধান বেড়েই চলে।
২০২০-তে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি চালু হয়েছে। এ-যাবৎ ফল কিছু প্রসাধনিক রদবদল, যাতে খরচ বাড়ে না। প্রাক্-স্নাতক পাঠক্রম এক বছর বেড়েছে কিন্তু অর্থসংস্থান বাড়েনি। স্কুলের উন্নয়নে চালু হয়েছে ‘পিএমশ্রী’ প্রকল্প। দেশে স্কুলের সংখ্যা প্রায় ১৫,০০,০০০। পিএমশ্রী স্কুল হবে ১৪,৫০০, অর্থাৎ এক শতাংশেরও কম। কেন্দ্র টাকা দেবে পাঁচ বছর; তার পর সামলাবে রাজ্য সরকার, সেই সঙ্গে বাকি নিরানব্বই শতাংশ স্কুলের সংস্কার ঘটাবে। এটাও যুগ্ম তালিকার মহিমা।
অবধারিত ভাবে তেমন ‘সংস্কার’-ই ঘটছে, যাতে খরচ বাঁচে। একাধিক স্কুল একত্র করে বা ‘লিড স্কুল’ হিসাবে মাত্র একটিকে উন্নত করে, এবং নির্বিচারে অনলাইন শিক্ষার সওয়াল করে, চুলোয় যাক গরিব বা প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছেলেমেয়েরা। অতীতে অপারেশন ব্ল্যাকবোর্ড বা সর্বশিক্ষা মিশনের মতো যে সার্বিক উদ্যোগ করা গেছে, আজ তা কল্পনাতীত।
রাজ্য সরকারের খতিয়ান দেখা যাক। পশ্চিমবঙ্গে ব্যতিক্রমী ভাবে অন্তত ৮৬ শতাংশ ছেলেমেয়ে সরকারি স্কুলে পড়ে। কেন্দ্রের অবহেলা ও বঞ্চনা মেনেও প্রশ্ন, রাজ্য তাদের জন্য যথাসাধ্য করেছে কি? স্কুলশিক্ষার গুরুত্ব সর্বাধিক, কিন্তু পরিচালনার রূপরেখা অপেক্ষাকৃত সরল। সাধারণ সমাজের সরকারি স্কুলের অবস্থান অনেকটা মাটির কাছাকাছি। সেখানে সরকারের সংযোগ সহজ হতে পারে, যেমন কন্যাশ্রীর রূপায়ণে। কিন্তু কন্যাশ্রী তো মেয়েদের স্কুলের দরজায় পৌঁছে দিচ্ছে কেবল, লেখাপড়া শেখাচ্ছে না। ছেলেদেরই বা কী হবে? তাদের স্কুলছুটের হার তো মেয়েদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
শিক্ষক নিয়োগ প্রসঙ্গের উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। সকলেই জানি, হাতে-গোনা স্কুলে মাত্রাধিক শিক্ষক, প্রচুর স্কুলে নেহাত কম বা আদৌ নেই। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ছাত্রদের মুখ চেয়ে পড়িয়ে চলেছেন। বাপমায়েরা চাঁদা তুলে ক্লাস চালু রাখছেন, সাধ্যাতীত খরচে সন্তানকে টিউশনে পাঠাচ্ছেন কিংবা নামগোত্রহীন স্কুলে ‘ইংলিশে পড়াচ্ছেন’। বিজ্ঞানশিক্ষার অবস্থা বিশেষ ভাবে সঙ্গিন। এ দিকে হবু শিক্ষকদের রোদে-জলে অবস্থান হাজার দিন ছুঁইছুঁই। তাঁদের হবু ছাত্রেরা হাজার দিনে তিনটে ক্লাস পেরোতে চলল, হয়তো স্কুলছুট হয়ে গেল। ধর্নাকারীরা চাকরি পেলেও পেতে পারেন, এই ছেলেমেয়েদের কাছে শিক্ষা থাকবে আজীবন অধরা।
আদালতের দোহাই দিলে চলবে না। এত দফা নিয়োগ আদালত অবধি গড়াল কেন? ক’টা নিয়োগ সত্যিই মামলায় আটকে? রাজ্যবাসীর মুখ চেয়ে না হোক, নিজের ঘর গোছাতেই শিক্ষা দফতরের একটা ব্যাপক হিসাব না করলেই নয়। কোথায় ক’টা স্কুল, কোনটায় কত পদ, ক’জন শিক্ষক কী শর্তে বহাল, কে কী বিষয় পড়ান, ইত্যাদি বিশদ পরিসংখ্যান উন্নতির প্রাথমিক শর্ত, জানতে চাওয়া রাজ্যবাসীর অধিকার। সেই দাবি মেটাতেই হবে।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অবস্থাটা ভিন্ন কিন্তু অনুরূপ। নয়া শিক্ষানীতির ‘লাইট বাট টাইট’ পন্থায় কেন্দ্রীয় সরকার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলি আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে, অথচ পুরো ব্যবস্থাটা আলগা, খণ্ডিত ও দিশাহীন। স্বাধীনতার পর অর্ধশতক উচ্চশিক্ষা ছিল পুরোপুরি সরকারের হাতে, একটা পরিকল্পনা অনুসারে। ত্রুটি ও অনাচার ছিল অশেষ, সাফল্যও নেহাত নগণ্য নয়। ইউরোপের অধিকাংশ দেশে (ব্রিটেন বা আমেরিকায় নয়) উচ্চশিক্ষার কাঠামো আজও এই ধাঁচে। ভারতে একটা উপসর্গ হল কেন্দ্রীয় ও রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণি ভাগ। ব্যবধানটা বেড়েই চলেছে, তবে এই শতকের গোড়া থেকে উভয়কে ছাপিয়ে গেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের রমরমা। তাদের অবস্থানও আজ অনিশ্চিত, বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ভারতে শাখা স্থাপনের নতুন উদার ছাড়পত্রের ফলে। আরও তুরীয় মার্গে, গুজরাতের গিফট সিটির মতো জায়গায় বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় আসছে নিখাদ বাণিজ্যিক অর্থসংস্থা হিসাবে। ভারতীয় শিক্ষাবিধি সেখানে অচল।
পুরোটা যেন চার তলা বাড়ি মায় চিলেকোঠা (না কি পেন্টহাউস?)। অঙ্ক নেই নকশা নেই, উপরের তলাগুলো চাপানো হয়েছে নীচের তলার বহনশক্তি, বাসিন্দাদের জীবনধারা ও অর্থবল অগ্রাহ্য করে। সমন্বয়ের লেশ নেই। নতুন প্রতিষ্ঠানগুলি প্রত্যেকে নিজের মতো চলছে। অল্প কয়েকটি মহার্ঘ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সার্থক জ্ঞানকেন্দ্র হিসাবে গড়ে ওঠার পথে; আর কতকগুলি অর্থকরী বিদ্যার সুষ্ঠু প্রশিক্ষণকেন্দ্র, তার বেশি নয়; বাকিরা অর্থকরী কেবল নিজেদের পোষণে।
মধ্যবিত্তরা ধারদেনা করে সন্তানদের সেখানে পাঠাচ্ছেন। অবশ্যই পাঠাতেন না, যদি সুলভ সরকারি বিদ্যায়তনে চাহিদা মিটত। আবার পাঠাচ্ছেন না বলেই চাহিদা মেটাবার দায় কমছে। ঊহ্য বার্তা, সরকারিব্যবস্থা কেবল সম্বলহীনের জন্য। স্কুলব্যবস্থায় আগেই যে শ্রেণি-বিভাজন ঘটে গেছে, আজ তা কায়েম হচ্ছে উচ্চশিক্ষায়।
সরকারি উচ্চশিক্ষায় সত্যিই দুর্দিন এসেছে। আইআইটি গোছের কিছু প্রতিষ্ঠান বাদে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়েও অনুদান কমছে। আরও সঙ্গিন কথা, তারা জর্জরিত হচ্ছে বিচিত্র অনাচার আর খবরদারিতে। তবে আতান্তরে পড়েছে রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। এদের উন্নয়ন ও গবেষণার টাকা মূলত দিল্লি থেকে আসত, তা প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ। কেন্দ্রীয় বিধিনিষেধের বোঝা বেড়ে চলেছে, উপরন্তু চেপেছে নতুন শিক্ষানীতির ব্যয়ভার।
রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আদৌ বাঁচার উপায় আছে কি? উত্তর: বহুমাত্রায় আছে, যদি কিছু জরুরি আত্মসমীক্ষা করা হয়। বর্তমান রাজ্য সরকার দু’টি হানিকর নীতি গ্রহণ করেছে। এক, অপরিকল্পিত ভাবে প্রচুর নতুন বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছে। অর্থাভাবে সেগুলি নিষ্প্রভ, অথচ পুরনো প্রতিষ্ঠানগুলিও ক্ষতিগ্রস্ত। চালু বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের প্রশ্ন ওঠে না; তবে ভাবতেই হবে কী করে সেগুলি ‘ডিফ্র্যাগ’ করা যায়, সমন্বয়ের ফলে অর্থের যথাসাধ্য সদ্ব্যবহার করে ফলপ্রসূ করা যায়।
অন্য পন্থাটি কেন্দ্রের নীতির নিষ্করুণ দোসর। শিক্ষায়তনের স্বশাসন ছারখার, মিটিং ডাকতেও বিকাশ ভবনের দ্বারস্থ হতে হয়। সরকারি অর্থ বাড়ন্ত, কিন্তু অন্য সূত্রে অর্থসংস্থানে নানা নতুন কড়াকড়ি। অভূতপূর্ব ভাবে ডিন নির্বাচন করছিল সরকার, এখন হচ্ছে সম্পূর্ণ যান্ত্রিক পদ্ধতিতে। আরও অবিশ্বাস্য ভাবে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘকাল চলছে কার্যবিধি (স্ট্যাটিউট) বিনা। এ-দিকে শিক্ষকের আকাল। পদ থাকলেও লোক নেই, পদই নেই নতুন প্রতিষ্ঠানে। কলেজগুলির বহু বিভাগে কেবল আংশিক সময়ের শিক্ষক। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাজ্যপালের প্রতিনিধি চাই, রাজভবন আর সরকারের দ্বৈরথে তাদের মনোনয়ন হচ্ছে না। রাজ্যবাসী জানেন, উপাচার্য নির্বাচনে এই দ্বৈরথ কোন পর্যায়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দৈনন্দিন কাজও অচল হওয়ার মুখে। আবার সেই প্রশ্ন: কোন ধারাবাহিক অনাচারে এই অবস্থার সৃষ্টি হল? সুপ্রিম কোর্ট অবধি গড়িয়ে নতুন জটিলতা ধারণ করল কী করে?
ভারতের রাজ্য-বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে যাদবপুর ও কলকাতা এখনও সর্বোচ্চ স্তরে। কখনও প্রথম দুই স্থানে, যেমন কেন্দ্রীয় সরকারের শেষ মূল্যায়নে। তুমুল প্রতিকূলতার মধ্যে অধ্যাপকরা প্রমাণ করেছেন, কেন্দ্রের বাধা অতিক্রম করার ক্ষমতা এই প্রতিষ্ঠানগুলির আছে। রাজন্যবর্গের রেষারেষিতে কি তাঁদের প্রয়াস নিষ্ফল হবে?
প্রতীকস্বরূপ একটি ঘটনা দিয়ে শেষ করি। ২০১২-য় কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন স্কুল এলাকায় বিজ্ঞানপাঠ কেন্দ্র খুলেছিল; পশ্চিমবঙ্গ পেয়েছিল আড়াইশোর বেশি। ২০১৪ থেকে বরাদ্দ কমতে থাকে, ২০১৮-তে বন্ধ হয়ে যায়। একটি প্রতিষ্ঠিত শিক্ষক সংগঠন রাজ্য সরকারকে প্রস্তাব দেয়, তারা স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে কেন্দ্রগুলি চালু রাখবে। সরকার প্রস্তাবটি নাকচ করায় কেন্দ্রগুলি উঠে যায়। আজ স্কুলে-স্কুলে বিজ্ঞানশিক্ষার যে সঙ্কোচন, এ যেন তারই অশনিসঙ্কেত।
সঙ্কেত আরও মর্মান্তিক এক সত্যের: কেন্দ্রে-রাজ্যে শত বিরোধ সত্ত্বেও শিক্ষার অধোগতিতে তাদের অবদান পাল্লা দিয়ে। এক পক্ষেরও যদি শুভবুদ্ধি হয়, তা হলে বাংলার ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখে বাঁচে।