গত এক দশক স্থির করে দিয়েছে: দলদাস না হলেই রাষ্ট্রদ্রোহী
Journalism

কলমকে ভয় করে বলেই

২০২৩ সালে ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস’ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সংক্রান্ত যে সূচক রিপোর্ট প্রকাশ করে, তাতে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান নেমে গিয়ে হয়েছে ১৬১।

Advertisement

ঈশানী দত্ত রায়

শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:২৮
Share:

—প্রতীকী ছবি।

এক জন বলছেন, “বৃষ্টিতে সব ভেসে গেল।” আর এক জন বলছেন, “কোথায়, সবই তো খটখটে।” তোমার কাজ দু’জনের কথাই লিখে দেওয়া নয়, তোমার কাজ বাইরে বেরিয়ে দেখা যে, কোনটা সত্যি।

Advertisement

সাংবাদিকতার অন্যতম এই ব্যাকরণটি পালন করে আপনি দেখলেন বাইরে প্রবল বৃষ্টি। তখন খটখটেপন্থী বলবেন, আপনি আদৌ বাইরে বেরিয়ে দেখেননি— বৃষ্টি বলে যা মনে হচ্ছে, তা আসলে চৌবাচ্চার পাইপের জল। আর যিনি বৃষ্টিপন্থী তিনি বললেন, এটা যে পার্শ্ববর্তী রাজ্যের চক্রান্ত এই প্রবল বৃষ্টির মেঘ বুনে দেওয়া, যার ফলে বন্যা হতে চলেছে, সেটা তো সাংবাদিক লিখলেন না। অতএব দু’পক্ষই অন্তত একটি ব্যাপারে একমত হলেন যে, আপনি সত্য লেখেননি এবং আপনি নিশ্চয় টাকা খেয়েছেন।

বা, আপনি বৃষ্টি হচ্ছে কি না দেখতে বাইরে বেরোতেই পারলেন না। তার আগেই আপনাকে দেশদ্রোহের ধারা দেওয়া হল, কারণ আপনি একটি সূর্যস্নাত দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ধুয়ো তুলে দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছেন।

Advertisement

না, রসিকতা নয়। ২০২২ সালে উত্তরপ্রদেশে সাংবাদিক অজিত ওঝাকে ১৯ দিন জেলে কাটাতে হয়েছিল। তাঁর অপরাধ, তিনি বালিয়ায় হাইস্কুলের পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের স‌ংবাদ লিখেছিলেন। এবং এ কথাও লিখেছিলেন যে, ঘটনাটির তদন্ত হচ্ছে। পুলিশ পর দিনই তাঁকে বাড়ি থেকে তুলে গ্রেফতার করল— অভিযোগ করা হল যে, তিনি নিজেই প্রশ্নপত্র ফাঁস করিয়ে এ সব খবর করছেন। ওই একই বছরে উত্তরপ্রদেশেই একটি স্কুলে মিড-ডে মিলে নুন-রুটি দেওয়ার খবর করায় পুলিশ মামলা করে সাংবাদিক পবন আগরওয়ালের বিরুদ্ধে।

২০২৩ সালে ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস’ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সংক্রান্ত যে সূচক রিপোর্ট প্রকাশ করে, তাতে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান নেমে গিয়ে হয়েছে ১৬১। ২০১৪ সালে তা ছিল ১৪০, ২০০৪ সালে তা ছিল ১২০।

শুধু তা-ই নয়, সংগঠনটি বিশ্বের যে ৩১টি দেশকে সাংবাদিকদের জন্য খুবই বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত করেছে, তার অন্যতম ভারত। পাঁচটি মাপকাঠির ভিত্তিতে কোনও দেশের অবস্থান নির্ধারিত হয় এবং আরও আশঙ্কার কথা, সেগুলির মধ্যে নিরাপত্তার মাপকাঠিতে ভারতের স্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৭২তম। চিন, মেক্সিকো, পাকিস্তান, সিরিয়া, ইরান, ইয়েমেন, ইউক্রেন, মায়ানমার শুধু রয়েছে ভারতের পিছনে। এই নিরাপত্তার মাপকাঠিতে যাচাই করা হয় সাংবাদিকেরা নির্ভয়ে খবর সংগ্রহ করতে পারছেন কি না, খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে তাঁদের শারীরিক বা মানসিক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে কি না বা তাঁরা চাকরি খোয়াতে পারেন কি না, তাঁদের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ছিনিয়ে নেওয়া বা নষ্ট করা হয় কি না, এই সব প্রশ্নের ভিত্তিতে।

আরএসএফ তাদের রিপোর্টে এও মনে করিয়ে দিয়েছে, ভারতের আইনে নাগরিকের নিরাপত্তার সংস্থান থাকলেও ইদানীং সরকারের সমালোচনা করলেই তাঁদের দেশবিরোধী বলে দাগিয়ে দেওয়া, রাষ্ট্রদ্রোহ, মানহানি, জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা ইত্যাদি অভিযোগ আনার প্রবণতা দিন-দিন বেড়েই চলেছে। ‘কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস’-এর হিসাব অনুযায়ী, মনমোহন সিংহ সরকারের আমলে আট জন সাংবাদিককে জেলে যেতে হয়েছিল; নরেন্দ্র মোদীর আমলে আপাতত সংখ্যাটা ৩৬। বেআইনি কাজকর্ম প্রতিরোধ আইন (ইউএপিএ) অনুযায়ী ১৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে অনেকেই কাশ্মীরের। মোদীর আমলে ২০১৪ থেকে এ-যাবৎ রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা ৩০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে।

শুধু সরকারের সমালোচনা করে লেখার জন্যই রাজরোষে পড়তে হচ্ছে, তা নয়, হাথরসে দলিত কন্যার গণধর্ষণ এবং মৃত্যুর খবর করতে যাওয়ার পথে মথুরায় গ্রেফতার করা হয় সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানকে। আনা হয় রাষ্ট্রদ্রোহের ধারাও। দু’বছর পর জামিন পান কাপ্পান।

গত বছরই মার্চে দিল্লিতে বিবিসির দফতরে আয়কর কর্তারা হানা দেন সাতসকালে। অফিসে যে কর্মীরা ছিলেন, তাঁদের মোবাইল ফোন নিয়ে নেওয়া হয়। হানা দেওয়া হয় মুম্বই অফিসেও। অভিযোগ, ভারতে তাদের লাভের অঙ্ক, লন্ডনে সেই অর্থ পাঠায় এবং আয়করের বিষয়ে প্রশ্নের জবাব দেয়নি বিবিসি। কাকতালীয় নয় যে, তার তিন সপ্তাহ আগে গুজরাত দাঙ্গায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভূমিকা নিয়ে একটি তথ্যচিত্র দেখিয়েছিল বিবিসি। ভারতে শুধু তার প্রদর্শনই নিষিদ্ধই করা হয়নি, সমাজমাধ্যমে সেই সংক্রান্ত যে কোনও মন্তব্য বা আলোচনাও সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

তেমনই ঘটেছিল নিউজ়ক্লিকের ক্ষেত্রেও। কৃষক আন্দোলন হোক, বা পাঠ্যক্রম বদলে ফেলা, বিভিন্ন বিষয়ে এই সংবাদপোর্টালের রিপোর্টে কেন্দ্রীয় সরকারের সন্তুষ্ট হওয়ার কারণ একেবারেই ছিল না। তার পরেই দেখা গেল গত অক্টোবরে ইউএপিএ-র আওতায় নিউজ়ক্লিকের সাংবাদিকদের বাড়ি, অফিসে দিল্লি পুলিশ হানা দিল। গ্রেফতার করা হল সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থকে। শুধু আর্থিক নয়ছয়, এফডিআই-এর নিয়ম না-মানাই নয়, নিউজ়ক্লিকের বিরুদ্ধে চিনের সমর্থনে এবং ভারতের বিরুদ্ধে খবর লেখার অভিযোগ আনা হয়। বলা হয়েছিল, চিনের ঘনিষ্ঠ নেভিল সিংঘমের লগ্নি রয়েছে নিউজ়ক্লিকে। তবে নিউজ়ক্লিকের তরফে এই সব অভিযোগই অস্বীকার করে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়, আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগের ক্ষেত্রে এত দিন তো সম্পাদককে পুলিশ তলবও করেনি, কোনও চার্জও গঠন করেনি, যদিও অনেক কাগজপত্রই পুলিশ আগে নিয়ে গিয়েছে। পুলিশি অভিযানের সময়ে বা পরে এফআইআরের কপিও তাদের দেওয়া হয়নি।

প্রশ্ন হচ্ছে, অনিয়মের অভিযোগ থাকতেই পারে। আর অনিয়ম হয়ে থাকলে তার ন্যায্য বিচার হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সরকারবিরোধী লেখা বা তথ্যচিত্র প্রকাশের পরই আচমকা পুলিশি বা আয়কর অভিযান বুঝিয়ে দেয়, বিষয়টা সহজ নয়, আর নেহাত অনিয়মের তো নয়ই।

এই ভয় দেখানোর বাতাবরণেই প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় গত বছর এপ্রিলে মিডিয়াওয়ানের মামলা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত, এমন অভিযোগ শূন্য থেকে তৈরি করা যায় না। এবং জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে সরকার নাগরিকদের কোনও সুরাহার পথ বন্ধ করবে, তা আইনের শাসনের পরিপন্থী। এবং সরকারের সমালোচনামূলক মতকে রক্ষা করা যে সংবাদমাধ্যমের স্বাস্থ্যের পক্ষে জরুরি, তাও উল্লেখ করেছিল সুপ্রিম কোর্ট।

কিন্তু গত এক দশকে প্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে ভারতে খবর এক প্রকারই হতে হবে, তা হল কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারপক্ষ যা রচনা করবে বা যা দেবে। ২০১৪ সাল থেকে এ-যাবৎ প্রধানমন্ত্রী কোনও সাংবাদিক সম্মেলনই করেননি। ফলে গোলটা বাধে গত বছরের ২২ জুন। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে যৌথ সাংবাদিক বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাঁকে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাব্রিনা সিদ্দিকি ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বৈষম্য নিয়ে প্রশ্ন করেন। প্রধানমন্ত্রী সেই অভিযোগ খণ্ডন করে বলেন, গণতন্ত্র ভারতের ডিএনএ। কিন্তু এর পরে সাব্রিনাকে সমাজমাধ্যমে ট্রোল করা শুরু হয়, তাঁর ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করা হয়। বিজেপির আইটি সেলের প্রধান অমিত মালবীয় অভিযোগ করেছিলেন যে, সাব্রিনার প্রশ্নের পিছনে অন্য উদ্দেশ্য ছিল। এর পরে আক্রমণের বন্যা বয়ে যায়। সব মিলিয়ে সাব্রিনাকে সমাজমাধ্যমে আক্রমণ এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে, হোয়াইট হাউস বিবৃতি দিয়ে বলে— এ ধরনের ঘটনা গণতন্ত্রেরই পরিপন্থী। অতএব পরিবেশটাই এমন যে, প্রশ্ন তুললেই তুমি দেশদ্রোহী।

ছুরিকাহত হওয়ার পর সলমন রুশদি তাঁর সাম্প্রতিক বই নাইফ-এ লিখেছেন, “ভাষাও একটি ছুরি। তা দিয়ে জগৎকে উন্মোচন করা যায়, বার করে আনা যায় তার অর্থ, তার গভীরতম ক্রিয়া, তার সত্য, তার গোপন কথা। ভাষা আমার ছুরি... এটাই সেই ছুরি যা নিয়ে আমি পাল্টা লড়াই শুরু করলাম।”

সত্য সেই ছুরি। সাংবাদিকতা সেই ছুরি।

নিজের বাড়ির সামনে গৌরী লঙ্কেশের রক্তাক্ত মৃতদেহের ছবিটা মনে করে দেখুন— ছুরি, গুলি, বোমা, রাষ্ট্রদ্রোহ আইন, এমন অনেক আক্রমণ, আঘাত, মৃত্যুবাহী আঘাত এবং আঘাতের ভয়, অসম্মান, অসম্মানের ভয় ঘিরে ফেলেছে সংবাদজগৎকে। তারই মধ্যে সাংবাদিকেরা লড়ে চলেছেন নিজেদের মতো করে। মেরুদণ্ড বেঁকে গিয়েছে অনেকের, হামাগুড়ি দিতেও দেখা যাচ্ছে, কিন্তু এক দিন না এক দিন তাঁরাও সাংবাদিকতায় ফিরবেন, ফিরবেনই। ফিরবেন, বাঁচারই তাগিদে।

যে গুলি গৌরীকে বিদ্ধ করেছিল, সে গুলি প্রশ্ন সহ্য করে না। আর মানুষের ধর্ম প্রশ্ন করা। সাংবাদিকতার তো বটেই।

তাই হলুদ সাংবাদিকতা, চটিচাটা সাংবাদিকতা, গৈরিক সাংবাদিকতা, টাকা খাওয়া সাংবাদিকতা-সহ বিভিন্ন বিশেষণে ভূষিত হতে হতেও জিজ্ঞেস করে যেতেই হবে, ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়?’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement