গত কয়েক দশকে সমগ্র বিশ্বে আর্থিক বৃদ্ধি হয়েছে বিপুল হারে। কিন্তু, এই প্রচলিত বিপণন ও ভোগ্যপণ্য-নির্ভর অর্থব্যবস্থা পৃথিবীর বহু মানুষের ন্যূনতম জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে ব্যর্থ হয়েছে। এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশগুলির জনসাধারণের অতি দুর্দশাগ্রস্ত জীবনযাত্রার উন্নতিসাধনে প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অবদান শূন্য নয়, নেতিবাচক।
সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের পণ্যায়নের ও শোষণের বিরুদ্ধে যে সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়েছে, তার একটি ধারা ‘বিকল্প অর্থনীতি’। পুঁজিভিত্তিক অর্থব্যবস্থা মুনাফা ও মুদ্রাকেন্দ্রিক লেনদেনকে ঘিরে আবর্তিত হয়। কিন্তু, এই প্রচলিত ছাঁচের বাইরেও বৈচিত্রপূর্ণ ব্যবস্থার অস্তিত্ব আছে, যা পুঁজিভিত্তিক অর্থনীতির বিকল্প হতে পারে। তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্য— বৈচিত্র, সংহতি ও পারস্পরিক নির্ভরতার উপর ভিত্তি করে এক বিকল্প ব্যবস্থা সম্ভব।
‘বিকল্প অর্থনীতি’ কোনও নতুন তত্ত্ব বা ধারণা নয়। আয়ার্ল্যান্ডের কিছু কৃষি বিপণন বাজারে আঞ্চলিক কৃষিগোষ্ঠীর সদস্যরা বিনিময়প্রথার মাধ্যমে নিজেদের উৎপাদন অন্য সদস্যদের বিক্রি করেন, তাঁদের কাছ থেকে নিজেদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী কেনেন। এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ায় মুদ্রার কোনও ভূমিকা নেই। ভারতের বহু গ্রামাঞ্চলেও এই প্রথা চালু আছে। মূলধারার সংগঠিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পাশাপাশি এই বিকল্প ব্যবস্থার আঞ্চলিক সহাবস্থান তাৎপর্যপূর্ণ। ২০০১ সালে, আর্জেন্টিনার অর্থনৈতিক সঙ্কট ও পুঁজিপতিদের শোষণ সে দেশে এক প্রতিবাদী আন্দোলনের জন্ম দেয়। সেখানকার কর্মহারা শ্রমিকরা গঠনমূলক প্রকল্পের মাধ্যমে এক সমান্তরাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সংগঠন করেন। এই বিকল্প ব্যবস্থা মূলধারার অর্থনীতি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে সফল ভাবে অবস্থান করেছিল।
বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থা জোটভিত্তিক সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে; ফলে স্থানীয় মানুষের জীবনের মান বাড়ে। প্রচলিত ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন এই ব্যবস্থা, সম্পদবণ্টন ও আদানপ্রদানের এক সমমাত্রিকতন্ত্রের বিন্যাস করে, যা আঞ্চলিক জোটগুলির সুষম অর্থনৈতিক বিকাশের অনুকূল। এই বিকল্প ব্যবস্থার মাধ্যমে অঞ্চলভিত্তিক কর্মদক্ষতা ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সংগঠনে সৃষ্ট অর্থনীতি স্থিতিশীল সামাজিক উন্নয়নে সাহায্য করে।
বিকল্প অর্থব্যবস্থা তৈরি হয় নাগরিক সমাজের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ও সাংস্কৃতিক সমন্বয়ে। এটাকে এক অর্থে উপভোক্তা-নাগরিক আন্দোলনও বলা চলে। পুঁজিবাদী অর্থনীতির মধ্যে যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভুত্ববাদ আছে, এই আন্দোলন সেটাকে চ্যালেঞ্জ করে, প্রতিবাদী উন্নয়নের পথের সন্ধান দেয়। নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী নিজেদের মতো করে জীবনযাত্রার মান নির্ধারণ করবে, ও সমষ্টিগত ভাবে কাজ করবে সেই উদ্দেশ্যে, বিকল্প পথের নির্মাণে এটাই উপভোক্তা-নাগরিক আন্দোলনের মূল অস্ত্র।
একটা বিকল্প অর্থব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য রাজনৈতিক, সামাজিক, জনকল্যাণমূলক, ও বিপণনভিত্তিক— এই চার ধরনের প্রতিষ্ঠানেরই প্রয়োজন হয়। তবে, কোনও একটি নির্দিষ্ট বিকল্প ব্যবস্থায় চারটিই একই সঙ্গে শামিল না-ও হতে পারে। কোনও একটি ব্যবস্থা রাজনৈতিক উপাদানের উপর গুরুত্ব দিতে পারে; আবার অন্য একটি ব্যবস্থা জনজোটের জীবনযাপনের মানোন্নয়নে ও বিপণনের সরলীকরণের উপর গুরুত্ব আরোপ করতে পারে।
বিকল্প অর্থনীতি কি শুধুই মূলধারার অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিস্পর্ধী, প্রতিরোধী ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করতে পারে? না কি, তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব আছে? ঘটনা হল, এই বিবর্তনশীল বিকল্প অর্থনীতির সঙ্গে প্রচলিত বাজার অর্থনীতির এক মিশ্র ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়। প্রচলিত অর্থনীতির বিপণন ব্যবস্থা এই মিশ্র অর্থনীতির আঞ্চলিক গঠনে ইতিবাচক ভূমিকা নিতে পারে। মূলধারা ও বিকল্প অর্থনীতির সমন্বয়ে এক বৃহত্তর, বিপণন প্রক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পভিত্তিক সঙ্কটের সমাধান ও মুদ্রাকেন্দ্রিক বিপণন ব্যবস্থার রাজনৈতিক পুনর্গঠনেও এই মিশ্র অর্থনীতির ভূমিকা থাকতে পারে। বিভিন্ন আঞ্চলিক জনগোষ্ঠী ও তাদের পরিবেশের উপর আর্থিক আদানপ্রদানের বিন্যাস, উপভোক্তাগোষ্ঠীর সামাজিক প্রত্যুত্তর, ভোগ্যপণ্যের অতিব্যবহার বন্ধ করা, সামাজিক উদ্যোগ ও প্রাতিষ্ঠানিক লেনদেন ব্যবস্থার বিন্যাসে বিকল্প অর্থনীতির সঙ্গে মূলধারার সমন্বয় বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়