Picnic

দিন বদলের ছবি পিকনিকে 

নব্বইয়ের দশকে, অর্থনীতির উদারীকরণের সঙ্গে আরও অনেক কিছুর মতো বদলে গেল বনভোজনের নিজস্ব চরিত্রও। কর্পোরেট পিকনিক ঢুকে পড়ল সমাজের চালচিত্রে।

Advertisement

ঈশা দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০২৩ ০৯:১২
Share:

আচমকা হুল্লোড়, বাতানুকূল যন্ত্র না-চলা ঘরে ঢুকে পড়া শব্দ মনে করিয়ে দিত বনভোজনের সময়। ফাইল ছবি।

তখনও পৃথিবী অক্ষত ছিল। আচমকা হুল্লোড়, বাতানুকূল যন্ত্র না-চলা ঘরে ঢুকে পড়া শব্দ মনে করিয়ে দিত বনভোজনের সময়। ছুটির সকালের ঘুম ভাঙার সঙ্গে, ছড়িয়ে পড়ত ভাল লাগার রেশও।

Advertisement

বনভোজনের উল্লেখ আমরা পাই মহাভারতের কালেও, কৃষ্ণ, বলরাম ও পাণ্ডবদের আখ্যানে। কিন্তু যে ‘পিকনিক’-এর ছবি আমাদের পরিচিত, তার বিবর্তন ঘটে ইউরোপীয় সংস্কৃতি থেকে। ইউরোপের সামাজিক ইতিহাসে পিকনিকের প্রথম উল্লেখ পাই ফরাসি ব্যঙ্গগ্রন্থ বাকিকুস্‌ দ্যে পিকিউ-নিকিউ’তে (১৬৪৯)। অষ্টাদশ শতাব্দীতে, ফ্রান্সের অভিজাত শ্রেণির হাত ধরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে পিকনিক। তখনও অবশ্য ঠিক বনভোজন নয়, ঘরের ভিতরেই অনুষ্ঠিত হত এই পিকনিক। অভ্যাগতদের সঙ্গে করে আনতে হত কোনও খাবার বা পানীয়, এই ছিল সতেরো শতকের ফ্রান্সের পিকনিকের বৈশিষ্ট্য। প্যারিসে এই পিকনিক সংস্কৃতির অন্যতম ধারক ছিলেন চিন্তাবিদ জঁ-জাক রুসো।

এর পর আসে ফরাসি বিপ্লব। ফরাসি অভিজাতরা নির্বাসিত হন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে— অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া আর সর্বোপরি ইংল্যান্ডে। ফরাসি দেশ থেকে সাহিত্য, সুগন্ধীর মতো ইংল্যান্ডে আসে তাদের পিকনিকও। ১৮০১ নাগাদ লন্ডনে ‘ফ্রাঙ্কোফাইল’ বা ফরাসি সংস্কৃতিপ্রেমীদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় পিকনিক সোসাইটি। সেই পিকনিকে থাকত নাচ গান, আরও নানা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাও। ঊনবিংশ শতাব্দীতে সেই পিকনিক প্রচলিত হয় ইংল্যান্ডের উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণিতেও, এবং ঘরের ভিতরের অনুষ্ঠান থেকে পিকনিক ক্রমে নেয় আমাদের পরিচিত রূপ— বনভোজন। ঊনবিংশ শতাব্দীর এই পিকনিকের উল্লেখ পাওয়া যায় ১৮১৬ সালে রচিত জেন অস্টেন-এর এমা উপন্যাসে বক্স হিল-এ পিকনিকের বর্ণনায়। বিশ শতকে সর্বসাধারণের মধ্যে প্রচলিত হয় বনভোজন, এবং এর জনপ্রিয়তার কারণে তৈরি হতে শুরু করে বিশেষ ‘পিকনিক বাস্কেট’ও।

Advertisement

এর পর সেই বনভোজন সাত সাগর তেরো নদী পেরিয়ে এসে পড়ে আমাদের দেশে। সব প্রভাবের মতোই, এ ক্ষেত্রে সাহেবসুবোদের ‘পিকনিক’ সংস্কৃতি বেশি মাত্রায় প্রভাবিত করে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত অংশকে। পশ্চিমি রন্ধন-ইতিহাসবিদদের লেখায় পাওয়া যায় ‘সাহিব’দের পিকনিক-সংস্কৃতির বিবর্তনের উল্লেখ— যে পিকনিকে একটা বাস্কেটে করে শুধু খাবারই নয়, যেত টেবিল, কাঁটা-চামচের সম্ভার এমনকি বোন চায়নার বাসনও। পরবর্তী কালে ইংরেজ-প্রভাবিত ভারতীয়রাও অনুকরণ করতে শুরু করেন পিকনিকের এই রীতি।

সাহিত্য, চলচ্চিত্র দেশে বিদেশে ধরে রেখেছে বনভোজনের এই বিবর্তনকে। সহজ পাঠ-এর পথ বেয়ে উস্রি নদীর ধারে চলে গিয়েছি আমরা সবাই— তখনই ‘ছাত্রদের ইস্কুল বন্ধ’। যুক্তাক্ষর শেখানোর প্রয়াস ভয় দেখাতে পারেনি মোটেই, কারণ বোধ হয় ইস্কুল ছুটির ও উস্রি নদীর ধারে বনভোজনের আহ্বান। লীলা মজুমদারের গল্পে উঠে এসেছে মণিঝোরার পিকনিকের বর্ণনা। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ-কাহিনিতে বার বার উঠে এসেছে বনভোজন— সে চিত্রচোর-এর অফিস পিকনিক হোক বা চোরাবালি-র শিকারের পিকনিক। সত্যজিৎ রায়ের ছিন্নমস্তার অভিশাপ-এ উঠে আসে রাজারাপ্পার ধারের পিকনিকের গল্প।

হলিউডের ছবি সাউন্ড অব মিউজ়িক অথবা তার বাংলা বা হিন্দি সংস্করণে এই বনভোজন কয়েকটি শিশু-কিশোরের বদলে যাওয়া জীবনের ইঙ্গিত দেয়। আবার সত্যজিৎ রায়ের অরণ্যের দিনরাত্রি-র বনভোজন একই সঙ্গে প্রকৃতি ও মানবিক জটিলতাকে তুলে ধরে এই বনভোজন বা বনভোজন গোছের পরিবেশকে কেন্দ্র করে। চোখের বালি-র বনভোজনের পরিবেশ রবীন্দ্রসাহিত্যকে আধার ও অতিক্রম করে জীবন্ত হয়ে থাকে ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবিতেও।

পিকনিক ছুঁয়ে ফেলে সমাজের সব স্তর। আশির দশকে অফিসের, পাড়ার ক্লাবের, স্কুলের পিকনিক হয়ে ওঠে শীতকালীন পার্বণ। অর্থনৈতিক সাধ্য, যোগদাতাদের বয়স, সংখ্যা অনুযায়ী স্থান নির্বাচিত হলেও, সময়কাল ও যানবাহনে তারতম্য কম। স্কুলের পিকনিকে স্কুল-যান, পাড়ার পিকনিকে ভাড়া করা বাস। স্কুলের ক্ষেত্রে গন্তব্য চিড়িয়াখানা, পাড়ার পিকনিকে বারুইপুর।

নব্বইয়ের দশকে, অর্থনীতির উদারীকরণের সঙ্গে আরও অনেক কিছুর মতো বদলে গেল বনভোজনের নিজস্ব চরিত্রও। কর্পোরেট পিকনিক ঢুকে পড়ল সমাজের চালচিত্রে, এলাহি আয়োজনে হারিয়ে গেল পাড়ার দাদাদের তদারকি, খোঁজখবরের ভাল লাগা। অর্থনৈতিক বৈষম্য আর ভাগাভাগির ছবি ধরা রইল বদলে যাওয়া বনভোজনের ছবিতেও। তাই পর্দা-টানা কালো কাচের লুকিয়ে পড়া পরিবহণও যেমন রইল, খোলা ট্রাক বা টেম্পোতে ক্লাবের উচ্চকিত বনভোজনও জেগে রইল।

পিকনিকের এই ছবি তার সব রং, সমস্ত ভাল লাগা না-লাগাকে হারিয়ে ফেলেছিল অতিমারির সময়। আমরা আবার গুছিয়ে নিচ্ছি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জীবনের টুকরোগুলো, তখন ফোনের কোটরে থেকে যাওয়া পুরনো ছবি হাসি গান মনে করিয়ে দেয়— বনভোজনের পথে থেকে গিয়েছে স্মৃতির সব ক’টা নুড়িপাথর।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement