পীঠস্থান: সংসদের একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, ৬ মার্চ, ২০১৬। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স।
ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ৭৩ বছর পূর্ণ হচ্ছে। যে সব প্রতিষ্ঠান তাকে ধরে রেখেছে, তাদের অনেকগুলিই আজ গভীর সঙ্কটে। সংসদ সেগুলির অন্যতম। সংসদের কিছু সমস্যা পুরনো এবং কাঠামোগত, যেমন— জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে মেয়েদের এবং সংখ্যালঘু মানুষের অনুপাত কম, বিপুল ধনসম্পদের অধিকারী না হলে সংসদের আসন পাওয়া উত্তরোত্তর কঠিন হয়ে উঠেছে, আইন-প্রস্তাব (বিল) বা বাজেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ নীতি নিয়ে যথার্থ আলোচনা ক্রমশ উঠে যাচ্ছে। অন্য কিছু সমস্যা, আগে মাঝে-মধ্যে দেখা গেলেও, ইদানীং প্রবল আকার ধারণ করেছে। এই লেখায় আমি তেমন চারটি সমস্যা নিয়ে কথা বলতে চাই। এই সমস্যাগুলির কারণে সংসদের মৌলিক চরিত্রে নানা দিক থেকে আঘাত লেগেছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার জনপ্রতিনিধিত্বের সামর্থ্য, স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা এবং কার্যকারিতা। বর্তমান, অর্থাৎ সপ্তদশ লোকসভার সাফল্য নিয়ে নানা উজ্জ্বল পরিসংখ্যান প্রচারিত হয়েছে বটে, কিন্তু এই সমস্যাগুলি তাতে ঢাকা পড়ে না। যেমন, শাসক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবাদে সাম্প্রতিক অতীতের তুলনায় এই লোকসভায় আইন প্রণয়নের মাত্রা অনেক বেশি, কিন্তু এই আপাত-কৃতিত্বের আড়ালে আছে বড় রকমের ব্যাধি।
প্রথমত, আইন-প্রস্তাবগুলি বিচার-বিবেচনার জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানোর হার কম— পঞ্চদশ থেকে ষোড়শ লোকসভায় এই হার অনেক কমে গিয়েছিল, সপ্তদশ লোকসভার প্রথম তিন বছরে তা আরও কমেছে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নানা বিল কমিটিতে না পাঠিয়ে অতি দ্রুত সংসদে পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছে, যেমন কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা প্রত্যাহারের জন্য ৩৭০ ধারা বিলোপের প্রস্তাব, কিংবা বিতর্কিত কৃষি বিলগুলি। কৃষি বিল-সহ একাধিক আইন-প্রস্তাব তো এক দিনের মধ্যে অনুমোদিত হয়েছে। কৃষি বিলগুলি নিয়ে রাজ্যসভায় ‘ডিভিশন’ অর্থাৎ আনুষ্ঠানিক ভোটাভুটির দাবি উঠেছিল, কিন্তু সেই আবেদন নাকচ করে ধ্বনি ভোটেই বিলগুলি পাশ করিয়ে নেওয়া হয়। আবার, কৃষক আন্দোলনের চাপে ২০২১ সালের নভেম্বরে সরকার যখন কৃষি বিল প্রত্যাহার করল, তখনও এ বিষয়ে সংসদে কোনও বিতর্ক করতে দেওয়া হল না। বস্তুত কৃষি আইন বিলোপের বিলটি (২০২১) লোকসভায় তিন মিনিটে এবং রাজ্যসভায় ন’মিনিটে পাশ করানো হয়। আইন-প্রস্তাব নিয়ে বিতর্ক ও অনুমোদনের সংসদীয় প্রক্রিয়াটি এর ফলে ভয়ানক ভাবে খর্বিত হয়েছে।
কমিটির মধ্যে পক্ষপাতিত্বের প্রবণতাও বাড়ছে। এই প্রবণতার সূচনা হয়েছিল পঞ্চদশ লোকসভায় টু-জি কেলেঙ্কারির প্রসঙ্গে, কিন্তু সপ্তদশ লোকসভায় তার মাত্রা তীব্রতর হয়েছে। কমিটির রিপোর্ট দেওয়ার সময় কোনও সদস্য ভিন্নমত জানিয়ে নোট দিচ্ছেন, এটা নতুন কিছু নয়— কিন্তু কমিটির কাছে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য কাউকে ডাকা হলে তা নিয়ে মতবিরোধ ক্রমশই বাড়ছে।
দ্বিতীয়ত, ২০২১ সালের বাদল অধিবেশনে প্রচণ্ড বাধাবিপত্তির কারণে সংসদ নির্ধারিত সময়ের সিকিভাগও কাজ করতে পারেনি। সরকার গোয়েন্দা-প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বেআইনি নজরদারি চালিয়েছে, এই অভিযোগই শোরগোলের প্রধান কারণ ছিল। আইনসভার কাজকর্মে এমন গোলযোগের রীতি এ দেশে অনেক কাল ধরেই চলছে। কিন্তু ওই অধিবেশনে কোনও বিতর্ক বা আলোচনা ছাড়াই বেশির ভাগ বিল পাশ করিয়ে নেওয়া হয়। সংসদীয় গবেষণা সংস্থা (পিআরএস)-র হিসাব অনুসারে, লোকসভায় এক-একটি বিল গড়ে ৩৪ মিনিটে অনুমোদিত হয়েছিল। তার মধ্যে ১৪টি বিল পাশ হয় দশ মিনিটের চেয়েও কম সময়ে। ওই অধিবেশনে আনা ১৫টি বিলের একটিও সংসদীয় কমিটিতে যায়নি। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই— ২০২১-এর বাদল অধিবেশন পর্যন্ত সপ্তদশ লোকসভায় মাত্র ১২ শতাংশ বিল কমিটিতে পাঠানো হয়। সংসদের কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টির জন্য সরকার বিরোধী দলকে দায়ী করেছে, কিন্তু যে ভাবে বিলের পর বিল পাশ করানো হয়, তার ফলে সংসদীয় প্রক্রিয়া— বস্তুত সংসদ নিজেই— প্রহসনে পর্যবসিত হয়েছে।
তৃতীয়ত, ২০১৪ সালের পর অর্ডিন্যান্স জারির একটা বেশ অন্য রকম পথ খুলে গেল। ২০১৪ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে মোদী সরকার ৭৬টি অর্ডিন্যান্স পাশ করেছে। পঞ্চম লোকসভা (১৯৭১-৭৬) পাশ করেছিল ৯৩টি, জরুরি অবস্থা জারি নিয়ে— তার চেয়ে এই সংখ্যা কম, মানতেই হবে। এমনকি দশম লোকসভায় (১৯৯১-৯৬) প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও পাশ করেছিলেন ১১৪টি— অবশ্যই তার চেয়েও কম এখনকার সংখ্যা। তবে, সাম্প্রতিক অতীতের অভিজ্ঞতার পর এই অর্ডিন্যান্স জারির বিষয়টি একটু বেশিই মনে হল, কেননা বাজপেয়ী আমলের ছ’বছরে (১৯৯৮-২০০৪) এই সংখ্যাটা ছিল ৫৫, আর ইউপিএ শাসনের এক দশককালে (২০০৪-১৪) ছিল ৬১। বাৎসরিক গড়ের দিকে যদি তাকানো যায়, তা হলে দেখা যাবে বাজপেয়ী আমলে ৯ এবং ইউপিএ আমলে ৬-এর পাশে মোদী আমলে বছরে অর্ডিন্যান্সের গড় সংখ্যাটা দাঁড়াচ্ছে ১১।
শেষত, প্রধানমন্ত্রী নিজেই ভারতীয় গণতন্ত্রে সংসদের মর্যাদাকে অনেক নীচে নামিয়ে এনেছেন। ২০১৪ সালে সংসদে প্রবেশ করার সময়ে যদিও নত হয়ে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে তাঁর প্রণাম করার দৃশ্য বিখ্যাত হয়ে আছে, স্মরণীয় হয়ে আছে তাঁর তখনকার অভিভূত উক্তি: ‘সংসদই হল গণতন্ত্রের মন্দির’! পরবর্তী সময়ে কিন্তু তাঁর এই ভক্তি থেকে সংসদের সঙ্গে তাঁর কোনও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হল না। খুব কম সময়েই তিনি উপস্থিত থাকতেন। এবং খুব কম সময়েই স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে কোনও কথা বলতেন, বা কাজ করতেন। সংসদের সঙ্গে তাঁর মোলাকাত, সবটাই যেন আগে থেকে ছকে-নেওয়া, এবং গণনায় অতি সীমিত। পূর্ববর্তী বিজেপি প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ীর থেকে এখানেই তাঁর মস্ত তফাত। বিজেপি নরেন্দ্র মোদী ছাড়া আর যে এক জন মাত্র প্রধানমন্ত্রীকে দেখেছে, সেই অটলবিহারী বাজপেয়ী কিন্তু সংসদীয় ঐতিহ্যরক্ষায় উজ্জ্বল ছিলেন, মানতেই হবে।
২০১৪ সালে যখন মোদী প্রধানমন্ত্রী হলেন, তিনি প্রথম বারের জন্য সাংসদও হলেন। সংসদের সঙ্গে তাঁর এই দূরত্ব সম্পর্কে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না, কেননা গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে কিন্তু তাঁর রেকর্ড এমনটাই ছিল। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর তৃতীয় পর্ব যেটা, ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল— সেই সময়ে বিধানসভা বসেছিল বছরে গড়ে মাত্র ৩১ দিন, যে কোনও রাজ্যে বিধানসভা অধিবেশনের হিসাব দেখলে বোঝা যাবে যে, এই সংখ্যা কতটাই কম। সেখানে ৯০ শতাংশ বিলের ক্ষেত্রে বিল পেশ হওয়ার দিনই তা পাশ হয়ে আইন হয়ে যেত। সংসদেও এই অভ্যাস জারি রইল। বিল নিয়ে আলোচনা বা বিতর্কে প্রধানমন্ত্রীর কোনও আগ্রহ রইল না। একটা হিসাব বলছে, ২০১৪ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে মোদী মাত্র ২২ বার কথা বলেছেন সংসদে, অর্থাৎ বছরে মাত্র ৩.৬ বার। বাজপেয়ী ৬ বছরে ৭৭ বার বক্তব্য পেশ করেছিলেন, আর মনমোহন সিংহ ১০ বছরে ৪৮ বার (বছরে গড়ে ৪.৮ বার)।
প্রধানমন্ত্রী মোদীর সংসদে এই নীরবতার আর একটা কারণও আছে। কোনও ভাবে তাঁকে সংসদীয় দায়িত্ব নিয়ে কথা বলার মতো প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতাই রাখা হয়নি এই মন্ত্রিসভার কাজে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী সাধারণত পার্লামেন্টারি চেম্বারে আসেন সপ্তাহে এক দিন, এখানে কোনও আলাদা সময় ধার্য করা নেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রশ্নোত্তর পর্বের জন্য— যেমনটা আছে ব্রিটেনে। ব্রিটেনে সপ্তাহে অন্তত আধ ঘণ্টা সময় ধার্য করা থাকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রশ্নোত্তরের জন্য। ফলে মোদী যতই শক্তিশালী বক্তা হোন না কেন, তিনি অন্যান্য সাংসদের সঙ্গেও কথা বলেন না, কিংবা সংসদ থেকে জাতির উদ্দেশেও বিশেষ কথা বলেন না। সে দিক থেকে বলা যেতে পারে, তিনি এক জন অনিচ্ছুক সাংসদ (রিলাকট্যান্ট পার্লামেন্টারিয়ান)। তাঁর সঙ্গে খুব মিল ভারতের যে সর্বশেষ রাষ্ট্রপতি-সম (প্রেসিডেনশিয়াল) এবং জনবাদী (পপুলিস্ট) প্রধানমন্ত্রীর, তাঁর নাম: ইন্দিরা গান্ধী।