—ফাইল চিত্র।
সাম্প্রতিক নির্বাচনে ব্রিটেনের রক্ষণশীল টোরি পার্টির নজিরবিহীন পরাজয়ের জন্য মূলত দায়ী রক্ষণশীল দক্ষিণপন্থী অর্থনীতির এক উগ্র ধারার দেড় দশকব্যাপী বিরামহীন প্রয়োগ, সেই সঙ্গে এঁটুলি হয়ে জুড়ে থাকা উগ্র সমাজ ও রাজনীতির বিষফল। দেড় দশক ধরে জীবনের সর্ব স্তরে এই অর্থনৈতিক মতাদর্শের প্রভাব একটা চলমান ধনী দেশকে নিয়ে গেছে অন্ধকূপের দিকে। পরিসংখ্যান বলছে, টোরি আমলে দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ২.৫% থেকে নেমেছে ০.৪ শতাংশে, ব্রিটেনের প্রকৃত গড় মজুরি ২০০৮-এর তুলনায় কমেছে ৫%, রাস্তার অন্তত সাড়ে পাঁচ লক্ষ গর্ত আজও মেরামতের অপেক্ষায়, হাসপাতালের পরিষেবায় অপেক্ষারত ৭০ লক্ষ মানুষ।
চোদ্দো বছর আগে যখন কনজ়ারভেটিভ পার্টি ক্ষমতায় ফেরে, ব্রিটেন-সহ সারা বিশ্বেই মন্দায় চার দিকে বন্ধ কলকারখানা। বাজারে ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতা নেই। এমতাবস্থায় অধিকাংশ অর্থনীতিবিদের একমাত্র জানা পথ সুচিন্তিত সরকারি হস্তক্ষেপ, অন্য সময়ে যা কাম্য নয়। দুঃসময়ে তার কাজ ব্যাঙ্কগুলোর অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ কিনে তাদের আপাত সচল রাখা, আর বিক্রি না-হওয়া বেসরকারি পণ্যের চাহিদা বজায় রাখা যাতে তার বাজার বন্ধ না হয়। অদূর ভবিষ্যতে অর্থনীতি ফের চলমান হলে কর বসিয়ে বা টাকা ছাপিয়ে সরকার তার আজকের খরচ তুলে নিতে পারে। এ কাজে মুদ্রাস্ফীতি বা ঋণের বোঝা লাগামছাড়া হওয়ার ঝুঁকি ও অন্যান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকলেও, অর্থনীতিকে আইসিইউ থেকে বার করার অন্য পন্থা আজও অজানা।
রক্ষণশীল অর্থনীতির মতে সামাজিক ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ ও অনুদান অপ্রয়োজনীয়, কারণ চ্যারিটি বা ব্যক্তিগত উদ্যোগ একই কাজ করতে পারে আরও ভাল ভাবে। সরকারি মিতব্যয়িতা রক্ষণশীল চিন্তাধারার অঙ্গ। ফলে কোভিডের সময়টা বাদ দিয়ে, ২০১০-২০২২ পর্যন্ত সময়কালে চলে ব্যয় সঙ্কোচনের সরকারি বার্ষিক মহোৎসব। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প, পরিকাঠামো, শিক্ষা, শিশুকল্যাণ, বৃদ্ধাবাস, পার্ক, গ্রন্থাগার, স্বাস্থ্য, সব কিছুতেই তখন সরকার ব্যয়কুণ্ঠ। সরকারি ব্যয় সঙ্কোচনে প্রান্তিক ও মধ্যবিত্ত মানুষের সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনে নেমে আসে হতাশা।
একই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রকৃত সুদের হার ছিল প্রায় শূন্য। ধার করে, বাজেট তত না কমিয়ে সরকার অনায়াসেই মন্দার মোকাবিলা করতে পারত আরও কম খরচে। কিছুটা হলেও লাঘব হত মানুষের উপর অর্থনৈতিক জগদ্দলের ভার, সাশ্রয় হত কোষাগারেরও। অর্থনীতিও ফিরে আসত ছন্দে। কিন্তু মানুষের কল্যাণ চিন্তা, এমনকি বিকল্প লাভজনক পন্থার থেকেও মুখ্য ছিল কৃপণতার মতাদর্শ। ব্যয় সঙ্কোচনের ফলে হারিয়ে যাওয়া চাকরির সার্বিক মূল্যের পরিমাণ (যার সিংহভাগই বয়েছেন দেশের প্রান্তিক ও শ্রমজীবী মানুষ) ছিল প্রায় পাঁচশো বিলিয়ন পাউন্ড। এঁদের অর্থনৈতিক ক্ষতে প্রলেপ দিতে এই দশকের নাম সরকারি ভাবে রাখা হয় ‘কৃচ্ছ্রসাধনের যুগ’। নির্বাচনী ফলের কিয়দংশ দশকব্যাপী এই মুষলপর্বেরও প্রতিফলন।
পরের পর্বের ইতিহাস সবারই জানা। দু’-দুটো বিশ্বযুদ্ধ পেরিয়ে এসে তৈরি হল ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের রূপরেখা। কর্ণধাররা ভেবেছিলেন, অবাধ বাণিজ্য, অভিবাসনমুক্ত শ্রমবাজার ও অন্য অর্থনৈতিক যোগসূত্র দিয়ে দেশগুলিকে একই সূত্রে গাঁথলে গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা কমবে। ব্রিটেন গোড়ায় নিমরাজি থাকলেও পরে ১৯৭৩-এ যোগ দেয়। তার পর প্রায় পঞ্চাশ বছর কেটেছে, দু’পক্ষেরই মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্য, লেনদেন ও যাতায়াত করেছেন অবাধে, শান্তিপূর্ণ বাতাবরণের মধ্যেই।
এই স্থিতাবস্থা সহ্য হল না টোরি উগ্রবাদীদের। জাতীয়তাবাদের উন্মত্ত ধ্বজা তুলে, ইউরোপীয় বেষ্টনীর বাইরের জগতের সঙ্গে ব্যবসা ও মুনাফার লোভ দেখিয়ে, সত্য-মিথ্যার মিশ্রণে এক আজগুবি আখ্যান তৈরি করে তাঁরা মানুষকে দ্বিধাবিভক্ত করলেন। থেমে গেল আগের চল্লিশ বছরে পড়শি দেশগুলোর সঙ্গে অবাধ লেনদেন ও বাণিজ্য, বন্ধ হল বিনিয়োগ। কিন্তু না এল নতুন কোনও বাণিজ্যের সন্ধান, না কোনও নতুন সহযোগী দেশ।
আধুনিক যুগের সফল ব্যবসা-বাণিজ্য ও উদ্যোগ গড়ে ওঠে ক্রেতা ও জোগানদারদের মধ্যে সক্রিয় সমন্বয়ে। তার বাঁধন শক্ত করতে দরকার পোক্ত সরবরাহ-শৃঙ্খল, মসৃণ যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। এ সবই সময়সাপেক্ষ। নতুন এই অর্থনীতির বনিয়াদ গঠনে যখন সরকারি মনোযোগ আবশ্যক, তখন টোরি নেতারা মেতে রইলেন নিজেদের মধ্যে ‘মিউজ়িক্যাল চেয়ার’ খেলায়। ইতিমধ্যে পতনোন্মুখ অর্থনীতিকে ঊর্ধ্বগতি করতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিজ় ট্রাস আরও এক ধাপ এগিয়ে মিনি বাজেটে ঘোষণা করলেন বড়লোকদের জন্য ৪৫ বিলিয়ন পাউন্ডের ট্যাক্স ছাড়, আর শূন্য ভাঁড়ার ভর্তি করতে সমপরিমাণ টাকা ধারের। আন্তর্জাতিক ঋণের বাজার রে-রে করে উঠল, কারণ সরকারি প্রস্তাবে নেই ঋণ পরিশোধের দিশা। ব্রিটিশ বন্ড ও পাউন্ডের অনিবার্য পতন রোধে সরকার বিনিয়োগকারীদের প্রদেয় সুদের হার বাড়াল। বাড়ির মর্টগেজ বাড়ল, এক ধাক্কায় ৬০ লক্ষ গৃহস্থ বিপদে পড়লেন: প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় এক লাফে ইএমআই বেড়ে গেল দেড় হাজার পাউন্ডের বেশি! ঋষি সুনকের আগমনেও তার সুরাহা মেলেনি।
অর্থনীতি কোনও দিন সরলরেখায় চলে না। জীবনের মতোই তার নিজস্ব ওঠাপড়া, স্রোত-চোরাস্রোত। তার চলার পথ আরও ব্যাহত হয়, যখন কোনও দল বা গোষ্ঠী তাদের সঙ্কীর্ণ মতাদর্শ চাপিয়ে দেয় ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধিতে। বিপর্যস্ত মানুষ তখন জবাব দেন ব্যালটে। এক সমীক্ষায় এ দেশের ৭১% মানুষ জানিয়েছেন ব্রেক্সিটের জন্যই তাঁদের অর্থনৈতিক দুর্ভোগ চরমে, ৪৫% মানুষের ধারণা রাজনৈতিক নেতারা বিশ্বাসযোগ্য নন। ভোটবাক্সের ফল এই দুইয়েরই প্রতিফলন।
এই নির্বাচনে চরম দক্ষিণপন্থী রিফর্ম পার্টির উত্থানে অনেকেই দেখছেন অশনিসঙ্কেত। ব্রিটেনের নির্বাচনী ইতিহাস মূলত মধ্যপন্থারই জয়ের সাক্ষী। অতীত সব সময় পুনরাবৃত্তি করে না; তবে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই গভীর অর্থনৈতিক ক্ষত এই সরকার কতটা ও কী ভাবে নিরাময় করছে, তার উপর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে অনেকটাই।