বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি, এই দুটো শব্দ ব্যক্তিজীবনে যেমন, রাষ্ট্রের কাছেও তেমনই গভীর উদ্বেগের কারণ। প্রতীকী ছবি।
বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি, এই দুটো শব্দ ব্যক্তিজীবনে যেমন, রাষ্ট্রের কাছেও তেমনই গভীর উদ্বেগের কারণ। অর্থনীতির তত্ত্বে এই দু’টি সমস্যাকে আক্ষরিক অর্থেই একটি রেখায় বেঁধেছিলেন লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স-এর অর্থনীতির অধ্যাপক উইলিয়াম ফিলিপস। ১৯৫৮ সালে তিনি দেখান যে, বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতির মধ্যে একটি বিপরীত সম্পর্ক বর্তমান, অন্তত স্বল্পমেয়াদে। অর্থশাস্ত্রের ছাত্রদের কাছে তাঁর এই তত্ত্ব ‘ফিলিপস কার্ভ’ বা ‘ফিলিপস রেখা’ নামে অতি সুপরিচিত। ব্যাপারটা কেমন? ধরা যাক, সরকার কর্মসংস্থান বাড়াতে চায়। তা হলে এমন মুদ্রানীতি গ্রহণ করতে হবে যাতে ব্যবসায় ধার পাওয়ার সুবিধা হয়, বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি যাতে নতুন নতুন কাজের জন্যে কর্মী নিয়োগ করতে পারে। এতে বেকারত্ব কমবে, কিন্তু মূল্যস্ফীতি বাড়বে। আবার যদি সরকারের মনে হয় যে, মূল্যস্ফীতি খুব বেশি হয়ে যাচ্ছে, ধারের সংস্থান কমানো দরকার, তা হলে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক রেপো রেট বাড়াবে— অর্থাৎ, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক দেশের বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিকে স্বল্পমেয়াদে যে সুদের হারে টাকা ধার দেয়, বাড়বে। এতে সব ব্যাঙ্কের হাতেই নগদের পরিমাণ কমবে, অতএব তারা ব্যবসায়িক সংস্থাগুলিকে কম ধার দিতে পারবে। এতে মূল্যস্ফীতি কমবে, কিন্তু অন্য দিকে নতুন কর্মসংস্থান ব্যাহত হবে, অন্তত অদূর ভবিষ্যতে।
গত শতকের সত্তরের দশক থেকেই অর্থনীতির গবেষণায় ‘ফিলিপস রেখা’র যাথার্থ্য নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়, কারণ ওই সময়ে একই সঙ্গে ঊর্ধ্বমুখী বেকারত্ব এবং মূল্যস্ফীতির হার দেখা যাচ্ছিল, বিশেষত উন্নত দেশগুলিতে। এই পরিস্থিতিকে স্ট্যাগফ্লেশন বা স্থবির মূল্যস্ফীতি নাম দেওয়া হয়। ‘ফিলিপস রেখা’র তত্ত্ব দিয়ে এমন পরিস্থিতির ব্যাখ্যা চলে না। এর ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞরা ‘ফিলিপস রেখা’ তত্ত্বকে বাতিল করতে চান। পরবর্তী কালে তাত্ত্বিক আলোচনায় আবার এই তত্ত্ব অনিশ্চয়তার হাত ধরে ফিরে আসে— গত দু’দশকে ‘ফিলিপস রেখা’র তত্ত্বের এক ধরনের পুনর্জন্ম হয়েছে বলা চলে।
কিছু দিন যাবৎ বিভিন্ন আলোচনায় ‘স্থবির মূল্যস্ফীতি’ শব্দবন্ধটির ব্যবহার শুনছি। আমরা সত্যই এই পরিস্থিতির মধ্যে যাব কি না, বা ইতিমধ্যেই পৌঁছে গিয়েছি কি না, তা বোঝার জন্যে কয়েকটি কথা ভাবা দরকার। গত কয়েক বছর ধরে (বিশেষ করে কোভিড-উত্তর পর্বে) দেশে বেকারত্বের হার নিয়ে আলোচনা ও দোষারোপ চলছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মূল্যস্ফীতির ক্রমবর্ধমান হার। সত্যিই কি পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ? সংখ্যার বিচারে একটু কাছ থেকে দেখা যাক। প্রথমত, এখনও ততটা দীর্ঘমেয়াদি তথ্য আমাদের হাতে আসেনি, যার ভিত্তিতে বলা চলে যে, সত্যিই বেকারত্ব কমছে না, অর্থাৎ স্থবির মূল্যস্ফীতি ঘটছে। দ্বিতীয়ত, যদি একটু লম্বা সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এই বিষয়ের তথ্য এক সঙ্গে দেখি, তা হলে কিন্তু চিত্রটা অন্য রকম। ২০১৯ থেকে ২০২৩-এর মধ্যে বেকারত্বের হারে খুব সামান্য ঊর্ধ্বমুখী গতি দেখা গিয়েছে (৬.৭ শতাংশ থেকে ৭.৫ শতাংশ)। অন্য দিকে, মূল্যস্ফীতির হার তুলনামূলক ভাবে বেশ তাড়াতাড়ি বেড়েছে (৩.৫ থেকে ৬.৭ শতাংশ)। কিন্তু এর মধ্যে কোভিড-জনিত প্রবল ধাক্কাটিও রয়েছে কি (কোভিডকালে এই হার ৭.৫ শতাংশ অবধি পৌঁছে গিয়েছিল)? তা হলে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ে এমন গেল-গেল রব কেন? আমরা কিন্তু এখনও ফিলিপস রেখা থেকে খুব দূরে যাইনি। একটু ধৈর্য ধরা যেতেই পারে।
তৃতীয়ত, এবং বিশেষ জরুরি কথা হল, এই সব অর্থনৈতিক তত্ত্ব কিন্তু লক্ষ্মণরেখা নয়। এদের সত্যাসত্য নির্ভর করে আমাদের বিশ্বাসের উপর। অর্থনৈতিক সুশাসনের (যা সরকারের আর্থিক বিচক্ষণতার উপর নির্ভরশীল) ব্যাপারে আমাদের ভরসার উপর, অর্থনীতির ভবিষ্যতের ব্যাপারে আমাদের প্রত্যাশার উপর এবং বিভিন্ন ছোট ছোট সম্ভাবনার সমষ্টির উপর এই তথ্যের যাচাই নির্ভরশীল। যদি যথেষ্ট বেশি সংখ্যক সংস্থা বিশ্বাস করে যে, ব্যাঙ্ক তাদের ঋণ দিতে পারবে, তবেই তারা নতুন কাজের পরিকল্পনা করতে সাহস পাবে এবং নতুন কর্মসংস্থানের পরিবেশ তৈরি করবে। যদি ব্যাঙ্ক বিশ্বাস করে যে, তাদের প্রদেয় ঋণ থেকে সত্যিই অর্থকরী কাজের সংস্থান হবে, তা হলে তারা ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হবে, ও স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের নীতিনির্ধারণের আলোচনায় ইতিবাচক ইঙ্গিত পাঠাবে। যখন দু’দিক থেকে এই প্রত্যাশার মেলবন্ধন হয়, তখনই আমরা ফিলিপস তত্ত্বের সাফল্য দেখতে পাই। অঙ্কের ভাষায়, বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতির মধ্যে সম্পর্ক কিন্তু নিশ্চিত নয়— এটি একটি সম্ভাবনাশ্রয়ী গতি, যার চলন সব সময় সরলরৈখিক না-ও হতে পারে। ফিলিপস রেখার পুনর্জন্ম ঘটেছে নিশ্চয়তা থেকে সম্ভাব্যতার দিকে তাত্ত্বিক যাত্রার ফলেই।
তথ্য বলছে যে, আমরা কোন দিকে যাচ্ছি, তা বোঝার জন্য আর একটু সময় দেওয়া দরকার। এবং তত্ত্ব বলে যে, আমাদের এ বিষয়ে নিরাশা (বা আশা) প্রভাবিত করতে পারে ভবিষ্যৎকে। কিছু দিন আশাবাদী হতে দোষ কী?