শিকড়: জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি, কলকাতা ফাইল ছবি।
আমার মনে হয়, সংস্কৃতির অনেকটাই পরিবারের বিষয়। ছোটবেলায় যা কিছু দেখা যায়, শোনা যায়, তা-ই দিয়েই তৈরি হয় আমাদের মন আর মূল্যবোধ। তাই, যে সব পরিবারে মিশেল রয়েছে বিভিন্ন সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং সংস্কারমুক্ত ধর্মের আচার— সেখানে জোর করে ভারতীয়ত্বের বোধ কখনওই আলাদা করে চাপানোর দরকার হয় না। আমি মনে করি, আমার বাপের বাড়ি অর্থাৎ ঠাকুরবাড়ির একটা স্বাভাবিক শিক্ষা আমার মধ্যে কম বয়স থেকেই ছিল। পরবর্তী কালে সেই শিক্ষার জোরে শ্বশুরবাড়ির পারিবারিক ঐতিহ্যও পালন করতে পেরেছি সহজ ভাবেই।
পরিবারের মধ্যে এই যে একটা বৃহৎ ঐতিহ্য, আমার ছেলেমেয়েরাও তা টের পেয়েছে বড় হওয়ার সময়। যেমন, আমি রমজান পালন করতাম, রোজা রাখতাম, কেননা আমার শাশুড়ি সে সব করতেন। আমিও সেই পরম্পরাই বজায় রাখতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম, ছেলেমেয়েরা দেখুক, পারিবারিক পরম্পরাটুকু জানুক, তার পর নিজের মতো করে ওরা সিদ্ধান্ত নিক, কী করতে চায়। মনে পড়ে, আমার কন্যা সোহার মাথায় এক বার চেপেছিল, খ্রিস্টান ধর্ম অবলম্বন করে দেখবে, তাতে কী রয়েছে। আমি তখন শুধু বলেছিলাম, কোনও কিছু নিয়ে তাড়াহুড়ো কোরো না। নিজেকে প্রশ্ন করো, সময় দাও, তার পর ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নাও। সেটাই করেছিল ও।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে জীবনের নানা সময়ের নানা ঘটনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আমার মায়ের সম্পর্ক, ঠাকুরবাড়ির কথা, পটৌডির ইতিহাস। মুম্বই-এর জীবনের সঙ্গে তার সরাসরি সংযোগ ছিল না, কিন্তু আমার মনের মধ্যে নিশ্চয়ই কোথাও সঞ্চিত থাকত সেই সব স্মৃতি। মনে পড়ে, পরিবারের ইতিহাস নিয়ে সোহার বিশেষ আগ্রহ তৈরি হতে এক বার সে মুম্বই থেকে দিল্লিতে আমাকে ফোন করে জানতে চেয়েছিল, “আম্মান, তোমার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠিক কী ভাবে সম্পর্কিত?” আবার দেখলাম, এর উত্তর দিতে আমায় কেমন এক মিনিটও চিন্তা করতে হয় না। তবে, উত্তরটা সংক্ষেপেও সারা যায় না! এক দমে, দ্বারকানাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে তাঁর পুত্র দেবেন্দ্রনাথ এবং তাঁর চোদ্দো সন্তানে পৌঁছে গেলাম ফোনের মধ্যেই। বলতে বলতে শুনলাম সোহা বলছে, “দাঁড়াও দাঁড়াও, কাগজ পেনসিল নিয়ে আবার তোমায় ফোন করছি!”
মুখস্থ থাকার মতোই ইতিহাস বটে। বাংলাদেশের যশোর জেলা থেকে জোব চার্নকের আমলে গোবিন্দপুর আসেন ঠাকুর বংশের আদি পুরুষ পঞ্চানন ঠাকুর। তাঁর গৌরবর্ণ, উপবীত, তিলক দেখে স্থানীয় মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের মানুষ ধরেই নেন যে, তিনি উচ্চবংশীয় ব্রাহ্মণ। তাঁর মুখচলতি নাম হয়ে যায় ঠাকুরমশাই। তার থেকেই ইংরেজদের অনুবাদে প্রথমে ঠাকৌর এবং পরে টেগোর। পঞ্চাননের বংশধর জয়রাম পলাশির যুদ্ধের আগেই মারা যান (১৭৫৬)। কলকাতার প্রথম জরিপের সময় (১৭০৭) কাজ করে তিনি যথেষ্ট অর্থোপার্জন করেন। জয়রামের দ্বিতীয় পুত্র নীলমণি, তৃতীয় দর্পনারায়ণ ঠাকুর। নীলমণি বাইরে ঘুরে ঘুরে রোজগার করে দর্পকে প্রচুর টাকা পাঠাতেন। সেই টাকার অনেকটাই কাজে লাগিয়ে দর্প তৈরি করেন পাথুরিয়াঘাটার বাড়ি। নীলমণি অবসর নিয়ে ঘরে ফিরলে এই দর্পই তাঁকে ঠকান। তাঁর হাতে এক লাখ টাকা ধরিয়ে (যদিও তিনি দিয়েছিলেন আরও অনেক বেশি) কার্যত বাড়িছাড়া করেন। সে সময় নীলমণির এক মারোয়াড়ি বন্ধু তাঁর এই হাল দেখে এক টাকার বিনিময়ে জোড়াসাঁকোর জমিটি লিখে দেন নীলমণিকে। সঙ্গে থাকা ১ লাখ টাকায় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িটি তৈরি করেন নীলমণি।
এই নীলমণির নাতি দ্বারকানাথ ঠাকুর। আর দ্বারকানাথের নাতির ঘরের পুতি গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমার বাবা অর্থাৎ গীতীন্দ্রনাথ ঠাকুর সরাসরি গগন ঠাকুরের নাতি। সেই হিসাবে আমি আসলে গগন ঠাকুরের নাতির ঘরের পুতনি! অন্য দিকে, আমার মা ইরা দেবীও জোড়াসাঁকোর ছ’নম্বর বাড়ির অন্যতম উত্তরাধিকারী। শুধু তা-ই নয়, তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রিয়পাত্রীও। রবি ঠাকুরের সঙ্গে বসে লুচি খেতে খেতে আকাশপাতাল গল্প করতেন তিনি! মা ছিলেন রবি ঠাকুরের বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতনি। আমার দিদিমা লতিকা ঠাকুর বিয়ে করেছিলেন জ্ঞানদাভিরাম বরুয়াকে (অসমের শিক্ষাবিদ, লেখক, অভিনেতা)। সেই অর্থে আমার রক্তে ঠাকুরবাড়ির ঘরানার পাশাপাশি অসমের সংস্কৃতিরও মিশেল রয়েছে। সোহার বিয়েতে ওকে তাই অসমের বিখ্যাত মেখলা পরিয়েছিলাম, বরুয়া পরিবারের ঐতিহ্যের চিহ্ন হিসাবে।
একটি ঘটনা বলি। আমার মা নিজে সময়ের তুলনায় এগিয়ে থাকা মানুষ। কিন্তু রক্ষণশীলতার একটা ভারসাম্য ছিল তাঁর মধ্যে। ঋতুপর্ণ ঘোষের অন্তরমহল ছবিতে কাজ করেছিল সোহা। ছবিটি সোহার সঙ্গে বসেই দেখেছিলেন মা। এক ধনবান জমিদারের স্ত্রীর চরিত্র ছিল সোহার, যাঁর উপরে চাপ রয়েছে বংশরক্ষার। সেই সময়ের বঙ্গ নারীর যেমন পোশাক, ব্লাউজ ছাড়াই শাড়ি পরতে হয়েছিল। ছবিটি বাণিজ্যিক এবং ফিল্মবোদ্ধাদের প্রশংসা ও সাফল্য পেলেও আপত্তি ছিল মায়ের। সোহাকে বলেছিলেন, কোনও ব্লাউজহীন চরিত্র যেন এর পর সে না করে!
অন্য দিকে, পটৌডির ইতিহাসও বিশিষ্ট ধরনের। সোহার লেখা বইতে উঠে এসেছে এই দুই পরিবারের ইতিহাস, ছোটখাটো তথ্য ও কাহিনি। অনেকেই হয়তো এটা প্রথম বার শুনবেন যে, পটৌডি কোনও ব্যক্তি নয়, একটি জায়গার নাম। ১৮০৪ সালে নবাবের শাসনকাল কায়েম হয় সেখানে। অষ্টম নবাব ইফতিকার আলি খান পটৌডি ছিলেন মনসুরের পিতা এবং রাজকীয় এক ব্যাটসম্যান। ইংল্যান্ড এবং ভারতের হয়ে ক্রিকেট খেলার জন্যই ইনি বেশি পরিচিত, পরে ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়কও হন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির বালিয়ল কলেজে হকি এবং ক্রিকেট ব্লু ছিলেন তিনি।
মাত্র ৪২ বছর বয়সে ইফতিকার আলি খান চলে যান। ১৯৫২ সালের ৫ জানুয়ারি ছিল সেটা। সেটি ছিল টাইগারের এগারোতম জন্মদিন। বাড়িতে তিনি আর তাঁর স্কুলের বন্ধুরা মিউজ়িক্যাল চেয়ার খেলছিলেন, অপেক্ষা করা হচ্ছিল বাবা-মায়ের জন্য। জয়পুর পোলো গ্রাউন্ড থেকে তাঁদের ফেরার কথা ছিল। ঠিক ছিল, তাঁরা এলে কেক কাটা, খাবার পরিবেশন করা হবে। কিন্তু তিনি আর ফিরলেন না। বিরাট এক হার্ট অ্যাটাকে চলে গেলেন। পোলো ম্যাচ চলাকালীনই স্তম্ভিত দর্শকদের সামনে ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়েছিল তাঁর দেহ।
আজকের দিনে নবাব পরিবার, অনেক মজার ঘটনাও ঘটে যায়। কন্যার ছোটবেলার একটি গল্প বলি। সোহার বয়স তখন ছয়। আমি আর ও পটৌডির ভিতরে সন্ধ্যাবেলা হাঁটছি। সোহা বলল, “আচ্ছা আম্মা, ভাই (সেফ) কাকে বিয়ে করবে?” হকচকিয়ে বললাম, তা তো বলতে পারি না। উত্তরে ও বলল, “আচ্ছা ভাই তো প্রিন্স। ও যাকে বিয়ে করবে সে নিশ্চয়ই প্রিন্সেস! কিন্তু আমি কাকে বিয়ে করব? কোথায় প্রিন্স খুঁজে পাব?” আরও ভেবে তার বিমর্ষ আক্ষেপ, “প্রিন্স খুঁজে পাওয়া তো খুব কঠিন।”
একান্ত পারিবারিক এ সব কথা। কিন্তু এই পারিবারিক ঐতিহ্যের একটা বিশিষ্টতা আছে। আজকের দিনে আরও বেশি করে বুঝতে পারি, সেটা কত মূল্যবান।
অনুলিখন: অগ্নি রায়