—প্রতীকী ছবি।
অর্থশাস্ত্রের জনক অ্যাডাম স্মিথ বাজারের অদৃশ্য হাতের কথা বলেছিলেন। কলেজে অর্থশাস্ত্রের পাঠ্যক্রমের একেবারে গোড়ায় রয়েছে চাহিদা আর জোগান-চালিত সেই অদৃশ্য হাতের কার্যকলাপের কথা। সেই অদৃশ্য হাত চলে মানুষের সম্পূর্ণ স্বার্থপরতার ভিত্তিতে— নিজের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগিতা অর্জন ছাড়া কারও অন্য কোনও লক্ষ্য নেই। কিন্তু, গত কয়েক দশকে এই সনাতন অর্থশাস্ত্র অনেক জটিল প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। আমরা কি সবাই এ রকম ঠান্ডা হিসাবনিকাশ করে কাজ করি? না কি, পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে আবেগের ভিত্তিতে কাজ করি?
প্রশ্ন করতেই পারেন যে, নিজের স্বার্থের সঙ্গে অন্যের স্বার্থের মেলবন্ধন কি সম্ভব? অপরকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত কি একেবারেই আত্মস্বার্থহীন? অনেক ক্ষেত্রে নয়। আমি যদি আমার প্রতিবেশীকে বিপদে সাহায্য না করি, আমার দুর্দিনে তাঁদের পাশে পাব না। আবার, ভিক্ষা দেওয়া, বন্যাত্রাণে টাকা দেওয়া ইত্যাদির মধ্যে আবেগ আর সহানুভূতির পাল্লা স্বার্থের চেয়ে অনেক ভারী।
প্রতি দিনই আমরা বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিই। সনাতন যুক্তিবাদী অর্থনীতিবিদরা বলেন, যে সিদ্ধান্তে আমাদের এক্সপেক্টেড ভ্যালু বা প্রত্যাশিত প্রাপ্তি সর্বোচ্চ, আমরা সেটাই করি। ধরুন, দশ টাকা দামের দু’টি লটারির টিকিটের মধ্যে একটিতে এক লক্ষ টাকা জেতার সম্ভাবনা হাজারের মধ্যে এক, অর্থাৎ প্রত্যাশিত প্রাপ্তি একশো টাকা; আর দ্বিতীয়টিতে নিশ্চিত প্রাপ্তি একশো টাকা। সমীক্ষা করে দেখা গেছে, দু’টি লটারিরই প্রত্যাশিত প্রাপ্তি সমান হওয়া সত্ত্বেও অধিকাংশ মানুষ প্রথম লটারিটি কিনতে চান। যদি বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে! সেই একই মানুষ আবার একশো টাকা খরচ করে একটি বিমা কেনেন এক লক্ষ টাকার একটি গহনা বাড়ি থেকে চুরি যাবার ভয়ে, যার সম্ভাবনাও এক হাজারের মধ্যে এক। অর্থাৎ যে মানুষ ঝুঁকিহীন একশো টাকার লাভ ছেড়ে প্রায় অসম্ভব এক লক্ষ টাকার লাভের লটারিটি কিনছেন, সেই তিনিই একশো টাকা ব্যয় করছেন বিমা কিনে, এক লক্ষ টাকা ক্ষতির ভয়ে। আচরণবাদী অর্থশাস্ত্রের পথিকৃৎ ড্যানিয়েল কানেম্যান বলেছেন, মানুষ ক্ষতির ব্যাপারে, লাভের তুলনায় অনেক বেশি স্পর্শকাতর। তাই তার এমন পছন্দ।
ভবিষ্যতে কী ঘটতে চলেছে, তা কি আমরা চটজলদি জানতে চাই, না কি তা জানতে স্বেচ্ছায় বিলম্ব করি? ধরুন, আমি যদি ভাবি আমার শরীরে ক্যানসার দানা বাঁধছে, সেটি কি টেস্ট করে এখনই জানব, না দেরি করব? এক বার মনে হবে যে, তাড়াতাড়ি জানাই ভাল— সত্যিই যদি রোগটি হয়ে থাকে, এখনই চিকিৎসা করলে নিরাময়ের সম্ভাবনা বেশি। অন্য দিকে মনে হতে পারে, কী দরকার! সত্যিই যদি রোগ হয়ে থাকে, চিকিৎসা এখনই শুরু করতে হবে। জীবনটা পাল্টে যাবে বিলকুল। মনের এই টানাপড়েন সনাতন সম্ভাবনা তত্ত্ব দিয়ে বোঝা শক্ত। অর্থশাস্ত্রের একটি নতুন শাখা, ননএক্সপেক্টেড ইউটিলিটি থিয়োরি দিয়ে এটি বোঝা সম্ভব। কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ল্যারি সেল্ডেন ১৯৭৮ সালে এই তত্ত্বের গোড়াপত্তন করেন।
ফেলুদা বলেছিল, মাইন্ড যখন আমার, তখন চেঞ্জ করলে আপত্তি কোথায়? এ কথাটা আমরা সবাই মানি, জেনে অথবা না-জেনেই। সকাল ছ’টায় ঘুম থেকে উঠব বলে অ্যালার্ম দিয়ে পর দিন সকালে সেটা বন্ধ করে আর এক ঘণ্টা কি ঘুমোইনি কোনও দিন? অর্থনীতিবিদরা একে টাইম ইনকনসিস্টেন্সি বলেন। আজ যা যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে, কাল সেটা মনে নাও হতে পারে। অন্য দিকে, কালকের প্রাপ্তির গুরুত্ব আজ তুলনায় কম মনে হতে পারে, ডিসকাউন্ট ফ্যাক্টরের কারণে।
আমরা অনেক সময়ই এমন অনেক কিছুতে মনোযোগ দিই না, যা হয়তো আমাদের জন্য লাভজনক হত। আমি যদি প্রতি দিন শেয়ার বাজারের ওঠাপড়ার খবর রাখি, তা হলে হয়তো বড়লোক হতে পারব। কিন্তু, তা না করে আমি গান শুনি, বাগান করি। চার পাশে এত তথ্য উড়ে বেড়াচ্ছে। আমার মনকে যুক্তিশীল ভাবে শুধুমাত্র সেই তথ্যগুলিকেই আহরণ করতে বলছি, যাতে আমার উৎসাহ আছে। মনস্তাত্ত্বিক অর্থশাস্ত্রের পরিভাষায় এর নাম র্যাশনাল ইনঅ্যাটেনশন। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ক্রিস্টোফার সিমস এনট্রপি তত্ত্বের লেন্সে আমাদের এই মানসিকতা বুঝিয়েছেন।
মনস্তাত্ত্বিক অর্থনীতি আর সনাতন যুক্তিশীল অর্থনীতি পরস্পরের পরিপূরক। গত চল্লিশ বছরে এই দু’টি শাখার মেলবন্ধনে একটি নতুন অর্থশাস্ত্রের দিগন্তের সূচনা হয়েছে। এর সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে অর্থশাস্ত্রের প্রচুর ব্যবহারিক প্রয়োগ হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ক্রেতার মনের গোপন সাধ আহ্লাদগুলি তাঁদের স্মার্টফোনে ওয়েবসাইট খোঁজার প্যাটার্ন দেখে একটি বিরাট তথ্যভান্ডার বানিয়ে ক্রেতাকে মনের মতো বিক্রেতার সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এর জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি। তার ভাল-মন্দ এক অন্য আলোচনা, কিন্তু পরিবর্তনের এই ধারাটি লক্ষণীয়।
অর্থাৎ, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক সিদ্ধান্তই সর্বদা সনাতন অর্থশাস্ত্রের স্বার্থপরতার যুক্তির নিগড়ে বাঁধা যায় না। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তগুলির পিছনে জটিল যুক্তি আর মননের বীজ থাকে। সেগুলোকে চিহ্নিত করা, এবং অর্থশাস্ত্রের তাত্ত্বিক কাঠামোয় জুড়ে নেওয়াই পরবর্তী চ্যালেঞ্জ।