—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
ডেটা এবং তার থেকে উদ্ভূত ‘ইনফর্মেশন’-এর যে জগৎজোড়া জালে আজ আমাদের জীবন, অস্তিত্ব সর্বদা বিজড়িত, সেই তথ্যভিত্তিক জলবায়ুতে ভারতে সবচেয়ে দরিদ্র হল শিক্ষা। তথ্য থেকে আহৃত জ্ঞান যে শিক্ষাকেন্দ্র, তার ছাত্রবৃন্দ এবং শিক্ষাপ্রণালী বিষয়ে সম্পদ হিসাবে সংগ্রহ করা যেতে পারে, এই বোধটাই সাধারণ ভাবে এ দেশের স্কুল থেকে ইউনিভার্সিটি অবধি অনুপস্থিত। তথ্যভিত্তিক কোনও দৃষ্টিভঙ্গিকে শিক্ষাপ্রাঙ্গণে যথেষ্ট তির্যক দৃষ্টিতে দেখা হয়। এখনও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষাকেন্দ্রের প্রধানের দীর্ঘ অভিজ্ঞতাপ্রসূত অন্তর্জ্ঞানের উপর নির্ভর করাকেই নিরাপদ ভাবা হয়।
উল্লেখ্য যে, ভারতে সরকারি পর্যায়ে ডিজিটাল সচেতনতা এবং জাতীয় শিক্ষানীতির মাধ্যমে একটি দেশব্যাপী ডেটা গভর্নেন্স সংস্কৃতি ধীরে ধীরে হলেও গড়ে উঠছে। সরকারি স্তরে ইউডিআইএসই প্লাসের মাধ্যমে সারা দেশের সমস্ত স্কুল ছাত্রছাত্রীর তথ্য সংগ্রহ করা তারই পরিচয়। আশা করা যেতে পারে, এই তথ্য সঠিক ভাবে ব্যবহৃত হলে স্কুল একত্রীকরণ, শিক্ষক নিয়োগ থেকে ছাত্রছাত্রী ধরে রাখা, সবই সম্ভব হবে। ডেটা সঞ্চয় করা হল তথ্য কেন্দ্রিক, জ্ঞান-মনোযোগী শিক্ষাব্যবস্থার দিকে প্রথম পদক্ষেপ। অপরিশোধিত তথ্যকে অর্থপূর্ণ তথ্য হিসাবে মূল্যায়ন করে এবং অপ্রত্যাশিত জ্ঞানের উন্মোচনের মাধ্যমেই আজকের দিনের বিচক্ষণ শিক্ষাপ্রধান তাঁর স্বজ্ঞাত বুদ্ধিমত্তাকে শিক্ষার নতুন দৃষ্টান্তে কার্যকর করতে পারবেন। এবং সেই শিক্ষাপ্রধানের সাফল্য নির্ভর করে তাঁর টিমের তথ্য সাক্ষরতার স্তরের উপর। মনে রাখতে হবে, বর্তমানে (এবং ভবিষ্যতে আরও বেশি করে) তথ্য মানে আর কেবলমাত্র সংখ্যা নয়, তথ্যের আওতায় পড়ে চিত্র, অডিয়ো, ভিডিয়ো, পাঠ্য, অনুভূতি ইত্যাদি। একটি তথ্য-সমৃদ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মীদের ‘ভাল’ তথ্য শনাক্ত করতে এবং ‘খারাপ’ তথ্য থেকে আলাদা করতে প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতের বিশ্লেষণের জন্য তথ্যের শুদ্ধতা বজায় থাকে।
অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার এই ধরনের প্রথম উদ্যোগে রাজ্যের সরকারি স্কুলে স্বাস্থ্যবিধি নিরীক্ষণের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গ্রহণ করেছে। সেই রাজ্যের সরকারি স্কুল শিক্ষা বিভাগ টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস লিমিটেড (টিসিএস)-এর সঙ্গে একটা প্রকল্পে রাজ্য জুড়ে প্রায় ৪৫ হাজার সরকারি স্কুলে একটি অভিনব ট্র্যাকিং সিস্টেম প্রয়োগ করেছে। এই প্রকল্পের আওতায় প্রতি দিন প্রতিটি সরকারি স্কুলের প্রতিটি শৌচাগারের কমোড-প্যান, ইউরিনাল, ওয়াশ বেসিন এবং মেঝের ছবি তুলে মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিতে হয় এক মূল ডাটাবেসে। টিসিএস-এর এআই এঞ্জিন দ্বারা প্রক্রিয়ার পর তার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট শৌচাগারগুলোর পরিচ্ছন্নতা গ্রেড করা হয়। সেই গ্রেড অনুমোদনযোগ্য না হলে স্কুল সতর্কবার্তা পায়, স্কুলকে পরিষ্কার করে ফের ছবি তুলে পাঠানোর নির্দেশসমেত। সমান্তরাল ভাবে প্রতি দিন জনগণের পর্যালোচনার জন্য একটি সরকারি ড্যাশবোর্ড পোর্টালে প্রতিটি স্কুলের শৌচাগার পরিচ্ছন্নতার প্রকৃত চিত্রটি প্রতিফলিত থাকে। এই উদ্যোগ স্কুলে ভর্তির হার বাড়িয়েছে এবং বয়ঃসন্ধি পেরোনো ছাত্রীদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার কমেছে।
জাতীয় ডিজিটাল যোগাযোগ নীতি ২০১৮-র প্রথম এবং প্রধান কৌশলগত উদ্দেশ্য ছিল ২০২২-এর ভিতর ‘সকলের জন্য ব্রডব্যান্ডের ব্যবস্থা করা’। ‘কানেক্ট ইন্ডিয়া’ মিশনের অধীনে ২০২২ সালের জন্য নির্ধারিত সাতটি লক্ষ্যের মধ্যে প্রথম তিনটি— ১) প্রত্যেক নাগরিককে ৫০ এমবিপিএস ব্রডব্যান্ড সংযোগ প্রদান, ২) ২০২০ সালের মধ্যে সমস্ত গ্রাম পঞ্চায়েতে ১ জিবিপিএস এবং ২০২২ সালের মধ্যে ১০ জিবিপিএস সংযোগ প্রদান এবং ৩) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-সহ দেশের সমস্ত প্রধান উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানকে চাহিদা অনুযায়ী ১০০ এমবিপিএস ব্রডব্যান্ড প্রদান। কোভিডের দু’বছরের বিরূপ প্রভাব বিবেচনা করে এর মধ্যে কতটা অর্জন করা হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশ্নাধীন, সরকারি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এর সাফল্যের হার ভবিষ্যতে নিশ্চিত হবে। তবে বলতেই হবে, শত বাধাবিপত্তি ও দুর্নীতির মধ্যেই ভারত সমগ্র দেশটিকে ডিজিটাল ভাবে আবদ্ধ করার পথে এগিয়ে চলেছে।
৩১ অগস্ট, ২০২১-এ টেলিকম রেগুলেটরি অথরিটি অব ইন্ডিয়া (ট্রাই) দ্বারা প্রকাশিত ব্রডব্যান্ড সংযোগকেন্দ্রিক সুপারিশ, ‘রেকমেন্ডেশন্স অন রোডম্যাপ টু প্রমোট ব্রডব্যান্ড কানেক্টিভিটি অ্যান্ড এনহ্যান্সড ব্রডব্যান্ড স্পিড’ দেখলে বোঝা যাবে, ভারতের বৃহত্তর ছাত্রগোষ্ঠী, যারা ডিজিটাল বিভাজনের শিকার, তাদের কাছে স্বল্পমূল্যে ব্রডব্যান্ড পৌঁছনোর বিষয়ে ট্রাই কতটা চিন্তিত। কিন্তু, শুধুমাত্র নেটওয়ার্কের গতি নয়, সাশ্রয়ী মূল্যের হ্যান্ডসেটের প্রাপ্যতা, স্থানীয় ভাষায় লিখিত অ্যাপ থাকা ইত্যাদি বিষয়গুলোতেও জোর দেওয়া প্রয়োজন।
আজকের দিনে ভারতে স্কুল যাওয়ার উপযুক্ত নাগরিক সংখ্যা আনুমানিক প্রায় ৪৫ কোটি, যার মধ্যে মাত্র ২৬ কোটি স্কুলে যায়। আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতির লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে স্কুল শিক্ষায় ১০০ শতাংশ ‘গ্রোস এনরোলমেন্ট রেশিয়ো’ অর্জন করা। এটি দেশের যোগাযোগ বিপ্লবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পরিষেবা শিল্প, ব্যাঙ্কিং এবং আর্থিক সংস্থাগুলি সকলেই দেশের সর্বব্যাপী ডিজিটাল কাঠামোর উপর ভর করে নিজস্ব তথ্য ব্যবস্থাপনা, রক্ষণাবেক্ষণ এবং খননের মাধ্যমে লাভবান হচ্ছে। স্কুলগুলো কি এখনও পিছিয়ে থাকবে?