বিজ্ঞানী আর ডাক্তার সম্প্রদায়েও শ্রেণিবিভাগ রয়েছে। কেউ শাসকের পেটোয়া, কেউ জিজ্ঞাসু। সত্যানুরাগী, জিজ্ঞাসুরা সংখ্যালঘুদের দিকেই। তার প্রমাণ অজস্র। তবে এখন ভাইরাস আর টিকার মরসুম, তাই ‘মরসুমি ফ্লু’-এর দিকেই তাকানো যাক।
প্রাচীন রোগ ‘মরসুমি ফ্লু’-র জন্য দায়ী ‘ইনফ্লুয়েঞ্জা’ নামের এক দল ভাইরাস। আমাদের নাক, গলা, ফুসফুসই তাদের প্রিয় বাসস্থান। এই অসুখে বৃদ্ধ অশক্ত মানুষজন ঘোরতর বিপদে পড়তে পারেন। তবে তার সংখ্যা কমই। এটি মৃদু শ্রেণির, ভাইরাসজনিত, ছোঁয়াচে রোগ।
বহু কাল অসুখটির চিকিৎসায় নির্দিষ্ট ওষুধ ছিল না। তাই ১৯৯৯-এ ‘ট্যামিফ্লু’ নামের ওষুধ আমেরিকায় ছাড়পত্র পেতে দুনিয়ায় সাড়া পড়েছিল। ছাড়পত্র পেতে বিচিত্র পরীক্ষানিরীক্ষা, বিচার-বিবেচনা, বিধিনিষেধের বেড়াজাল পেরোতে হয়। সেই ‘ট্রায়াল’ চলেছিল প্রধানত ‘রোশ’ নামে বহুজাতিক ওষুধ সংস্থার খরচে আর তদারকিতে। তাঁরাই আমেরিকান অধিকর্তাদের কাছে বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণ দিয়ে বলেছিলেন, ওষুধটি কার্যকর এবং নিরাপদ। ছাড়পত্র পেয়েই ‘রোশ’ বিশ্বে প্রচার করল, এখনই ওষুধ মজুত না করলে দরকারের সময় সঙ্কট হবে। ‘ফ্লু’-এর আসন্ন অতিমারি নিয়েও প্রচার চলল।
২০০৫ আর ২০০৯-এ কোনও কোনও জায়গায় ফ্লু-এর মহামারি দেখা গেলে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ (হু) সমেত আমেরিকা, ইউরোপ এবং অন্যান্য দেশের বহু সংস্থা জানাল, ‘ট্যামিফ্লু’তেই লুকিয়ে আছে জিয়নকাঠি। কিছু কাল পরই ওষুধের বিষক্রিয়াগুলো, বিশেষত স্নায়ুজনিত কুফল স্পষ্ট হতে থাকল। প্রশ্ন উঠল, নিরাপত্তার তথ্যগুলোয় কি জল মেশানো ছিল? নিরাপত্তা নিয়ে আদৌ ‘ট্রায়াল’ হয়েছে? ছাড়পত্রদাতা, প্রচারকর্তা সকলকেই প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতে হয়েছিল। সেই সারিতে হু-ও ছিল।
ইতিমধ্যে ওই ওষুধ বাবদ দেশগুলির কোষাগার থেকে অকল্পনীয় খরচ হয়েছে। অনেকে স্বীকার করলেন, ওষুধের ছাড়পত্র লাভ এবং যথেচ্ছ ব্যবহার ‘মহার্ঘ ভুল’! ওষুধের মজুতদারিতে তখন জাপান প্রথম সারিতে। শিশুদের উপর কুফল দেখে জাপানিরাও ওষুধের ব্যবহারে রাশ টানলেন। কেউ কেউ বললেন, ওষুধ সংস্থা সমেত অনেকেই ওষুধের সপক্ষে তথ্য দেখিয়েছে, সবাই ভুল করল? জাপানি শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হায়াশি দেখালেন, ভুল ছিল ‘ট্রায়াল’-এর নিয়মকানুন লঙ্ঘনে, ভুল ছিল ভুল রিপোর্ট চোখ বুজে মেনে নেওয়ায়।
অন্তত তখনও বড়কর্তাদের প্রশ্ন করার হিম্মত বজায় ছিল। বলা হল, নতুন ওষুধপত্র নিয়ে বেশি সতর্ক থাকতে হবে, পুরনো ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিতে হবে। বিশেষজ্ঞরাও জানালেন, এই রোগ নিয়ে জনমনে উদ্বেগ চাগিয়ে তোলা আর ওষুধের মাহাত্ম্য ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখাটাও ভুল। ২০১৪-য় হু-ও দলিল-দস্তাবেজ খুঁজে তাই জানাল। একই সময়ে দ্য ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এ প্রকাশিত প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘সার্বিক ব্যর্থতা— ইনফ্লুয়েঞ্জা বিরোধী ওষুধের গপ্পো’! দু’জন লেখকের এক জন পিটার দোশী এখন জার্নালটির সহযোগী সম্পাদক।
প্রবন্ধটি অনুযায়ী, উচ্চতম মহল ওষুধের সপক্ষে ভুল ও মিথ্যা বলেছিল। ওষুধের কুফল নিয়ে সংস্থা ছলনার আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু সংস্থা এবং অন্যদের কাছ থেকে সাড়ে তিন বছর ধরে সেই তথ্য জোগাড় করতে লেখকদের কালঘাম ছুটে গিয়েছে। ২০১৪ সালে বোঝা গেল, ওষুধের উপকারিতা নামমাত্র। তবে একে নিয়ে এত হইচই কেন? সরকার এমন অবাঞ্ছিত প্রশ্নের উত্তর দেয় না।
পশ্চিমি দুনিয়ার ‘ফ্লু শট’ নিয়ে একই কাণ্ড। বহু কাল নানা সংস্থা নানা টিকা তৈরি করেছে। কোনওটিই উল্লেখযোগ্য কার্যকর হয়নি। ২০০৬-এ দ্য ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এ চিঠি বার হল, টিকা দিয়ে ইনফ্লুয়েঞ্জায় মৃত্যুর সংখ্যা কমানোর প্রমাণ মিলছে না। ইনফ্লুয়েঞ্জায় মৃত্যুর সংখ্যা নিয়েই তো যথেষ্ট বিভ্রান্তি রয়েছে। অথচ, সরকার টিকা বাবদ বিপুল খরচ করছে।
২০১৪-য় পিটার দোশী জানালেন, টিকার নথিপত্র অতি দুর্বল, কুফলও যথেষ্ট। ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগটি বৃদ্ধ, অশক্ত মানুষজনের মৃত্যুর আশঙ্কা নিশ্চয়ই বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু তাঁদের উপর টিকার প্রভাব যে ভাল, এমন তথ্যপ্রমাণ নেই। আগে টিকার প্রয়োজন প্রমাণ করে বিচার করতে হবে টিকা কখন, কোথায়, কতটা কার্যকর। সব শেষে প্রমাণ করতে হবে, টিকা কতটা নিরাপদ। সব বিচারের নির্দিষ্ট, পৃথক, নিয়মকানুন আছে। সে সব ছাড়াই সরকারি কর্মচারীদের বেলায় টিকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। স্বভাবে মৃদু রোগটাকে ভয়ঙ্কর বলে প্রচার হল, আর স্বভাবে দুর্বল টিকাকে বলা হল, মহাবলী!
বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই ফ্লু-এর প্রকোপ কমেছে। অথচ, ফ্লু নিয়ে আদেখলেপনা শুরুই হল একুশ শতকের প্রথমে। তাতেই প্রমাণিত যে, সরকার ওষুধ সংস্থাগুলোর পাতা জুজুর ফাঁদে পা দিয়েছে। মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছেন। অথচ প্রতিষেধকের যোগ্যতা প্রমাণ হয়নি। পরীক্ষানিরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, টিকা মাত্র ৯% লোকের উপর কার্যকর হতে পারে। কোনও ওষুধ তখনই যথার্থ বলে বিবেচিত হবে, যখন দেখা যাবে যে তা ব্যবহারে মানুষ প্রাণে বাঁচেন, অন্তত অসুখের ভয়ঙ্করতা থেকে মুক্তি পান। এটা দেখাতে গেলে তড়িঘড়ি, আপৎকালীন বা খামখেয়ালি যুক্তি চলে না। ওগুলো ব্যবসার যুক্তি। নিখরচায় কিছু দিলেই তা যথার্থ হয় না। বিষ তো শেষ পর্যন্ত বিষই!
পেটোয়া শ্রেণি এখন টিকাসমরে নেমেছে। তবে ইতিহাসের কিন্তু পুনরাবৃত্তি হয়, হাস্যকর অথবা বিয়োগান্ত রূপে। পুনরাবৃত্তির হোতারা হয়তো মনে মনে বলছেন, “খুকি তোমার ভারি ছেলেমানুষ।/ ও ভেবেছে তারা উঠছে বুঝি/ আমরা যখন উড়িয়েছিলেম ফানুস।”