নোটবন্দির পদ্ধতি ছিল এ বারের বিচার্য, কিন্তু তার যাথার্থ্য?
Demonitisation

প্রশ্নগুলো থেকেই গেল

নোটবন্দি সফল না হলে, এক সময়ে বিভিন্ন জনসভায় নিজেকে ফাঁসিতে ঝোলানোর কথা বলতেন নরেন্দ্র মোদী। এখন আর সে সব কথা তিনি মুখে আনেন না!

Advertisement

পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা

শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২৩ ০৫:৩১
Share:

সঙ্কটাপন্ন: নোটবন্দি ঘোষণার পর এটিএম-এর সামনে দিনরাত জুড়ে দীর্ঘ লাইন, দিল্লি, ১৩ নভেম্বর, ২০১৬। পিটিআই

বিশ্বকাপ ফুটবলের রেশ এখনও কাটেনি। তাই এক ঝলকে কোনও ফুটবল ম্যাচের স্কোরলাইন মনে হওয়া হয়তো একেবারে অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আদতে এটি গত এক দশকে সম্ভবত সব থেকে বেশি চর্চিত বিষয় সম্পর্কে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের বিন্যাস। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চের রায়: ২০১৬ সালের নভেম্বরে নোট বাতিল করা হয়েছিল আইন মেনেই। বেঞ্চের চার বিচারপতি (এস আব্দুল নাজ়ির, বি আর গাভাই, এ এস বোপান্না এবং বি রামসুব্রমনিয়ন) বলেছেন যে, পুরোদস্তুর আইন মেনেই নোটবন্দি করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। পদ্ধতিগত ত্রুটি কিছু হয়নি।

Advertisement

কিন্তু পঞ্চম বিচারপতি বি ভি নাগরত্ন (যিনি সব থেকে কম বয়সি এবং ভবিষ্যতে দেশের সম্ভাব্য প্রথম মহিলা প্রধান বিচারপতি) স্পষ্ট বলেছেন, নোট নাকচের উদ্দেশ্য ভাল হতে পারে, কিন্তু তা করতে সরকার যে ভাবে এগিয়েছে, তা বেআইনি।

অর্থাৎ, চার বিচারপতি মনে করেছেন, পদ্ধতি আইনসঙ্গত। এক জনের চোখে তা নয়। ফলে এই গুরুত্বপূর্ণ রায়ের বিন্যাস ফুটবলের স্কোরলাইনের মতো— ৪-১।

Advertisement

এই রায় সামনে আসতেই শুরু হয়েছে রাজনৈতিক তরজা। ঠিক যেমনটা প্রত্যাশিত ছিল। শাসক দল বিজেপি উদ্বাহু। তাদের প্রশ্ন, “এত দিন রাহুল গান্ধী-সহ বিরোধীরা নোটবন্দিকে যে ভাবে নাগাড়ে আক্রমণ করে এসেছেন, এ বার কি তার জন্য ক্ষমা চাইবেন তাঁরা?”

উল্টো দিকে, বিচারপতি নাগরত্নের বয়ানকে হাতিয়ার করছেন বিরোধীরা। একই সঙ্গে তাঁদের মত— সুপ্রিম কোর্ট শুধু বলেছে, পদ্ধতিতে ত্রুটি ছিল না। কিন্তু এত বড় সিদ্ধান্ত সকলকে অন্ধকারে রেখে অতি সন্তর্পণে নেওয়ার পিছনে নিশ্চয় অনেক বড় কোনও উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য ছিল। যদি দেশের এবং দশের জন্যই তা হয়ে থাকে, তা হলে সেই লক্ষ্য কতখানি পূরণ হয়েছে, আজ পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদীর সরকার সে বিষয়ে নীরব কেন?

এ বিষয়ে একটি বাক্য উচ্চারণ করেনি সুপ্রিম কোর্টও। বরং স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশ্য কিংবা সাফল্য পর্যালোচনা এ ক্ষেত্রে তাদের এক্তিয়ারভুক্ত নয়। মামলা পদ্ধতি নিয়ে হয়েছিল, রায়ও তাই সেই সম্পর্কেই।

শীর্ষ আদালতে ৪-১ বিন্যাসে রায়ের পরে তা যে মোদী সরকারকে স্বস্তি দেবে কিংবা বলা ভাল, উজ্জীবিত করবে, তা বলা বাহুল্য। কিন্তু একই সঙ্গে এ-ও সত্যি যে, এ নিয়ে বিতর্ক তবু পিছু ছাড়ছে না এখনও। বরং বেশ কিছু প্রশ্নে তাকে নতুন করে চাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছে বিরোধী শিবির।

যেমন— এক, ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর নোটবন্দির কথা ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রায় এল তার প্রায় ৬ বছর ২ মাস পরে। এ কথা ঠিক যে, এই সংক্রান্ত বহু পিটিশন জমা পড়েছে। আর কোন মামলার শুনানি কখন হবে, তা একান্তই মহামান্য কোর্টের বিষয়। কিন্তু যে ঘটনার অভিঘাত এত বেশি, দেশের কোটি-কোটি মানুষ যাতে প্রভাবিত, সেই মামলার রায় আরও আগে এলে ভাল হত না কি?

দুই, নোটবন্দির সময়ে এটিএম-এর লাইনে দাঁড়িয়ে প্রাণ গিয়েছে বহু জনের। কাজ খুইয়েছেন বহু মানুষ। চিরতরে ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গিয়েছে অনেক ছোট দোকানের। লাটে উঠেছে বহু নগদনির্ভর ছোট ব্যবসা। যদি এত দেরিতে দেখা যেত যে, পদ্ধতিতেও গলদ ছিল, তা হলে অত মানুষের ক্ষতি কী ভাবে পুষিয়ে দিতে পারত মোদী সরকার? বা আদৌ কিছু করতে পারত কি?

তিন, নোটবন্দির সময়ে মোদী সরকারের দাবি ছিল, এতে জাল নোট জব্দ হবে। রাশ টানা যাবে কালো টাকায়। টাকার জোগান বন্ধ হবে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপেও। বিরোধীদের বক্তব্য, ভারতে সন্ত্রাসবাদ বন্ধ হয়নি। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের পরিসংখ্যানই বলছে যে, গত ছ’বছরে বাজারে নগদ বেড়েছে ৮৩ শতাংশ। জাল নোট ধরা পড়াও বন্ধ হয়নি। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম, বাম নেতাদের প্রশ্ন, তা হলে কেন্দ্র যে সমস্ত উদ্দেশ্যে এত বড় পদক্ষেপ করল, এত আত্মত্যাগ করলেন সাধারণ মানুষ, এত অত্যাচার হল আর্থিক ভাবে দুর্বল শ্রেণির উপরে, জীবিকার উপরে ধাক্কা সইলেন কোটি-কোটি মানুষ, সেই সব উদ্দেশ্য কতখানি পূরণ হল, সে বিষয়ে সরকারের মুখে কুলুপ কেন? সুপ্রিম কোর্ট নাহয় এক্তিয়ারভুক্ত নয় বলে মন্তব্য করেনি, কিন্তু লক্ষ্যে কতখানি পৌঁছনো গেল, তা স্পষ্ট করার দায়বদ্ধতা কি কেন্দ্রের তরফ থেকে থাকা প্রত্যাশিত নয়?

চার, প্রাথমিক ভাবে বলা লক্ষ্য ফস্কে যাচ্ছে দেখে পরে কেন্দ্রের দাবি ছিল, নোটবন্দির দরুন নগদের লেনদেন কমবে। বাড়বে ডিজিটাল লেনদেন। এর জন্য এত কড়া পদক্ষেপ জরুরি কি না, তা আলাদা তর্ক। কিন্তু রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের একাধিক পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট, ডিজিটাল লেনদেন গতি পেলেও নগদের গুরুত্ব কমেনি। তবে কি এই লক্ষ্যও অধরা কেন্দ্রের?

সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে যে, নোটবন্দি নিয়ে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে আলোচনা করেছিল কেন্দ্র। বিরোধীরা বলছেন, একাধিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে প্রায় ছ’মাস ২০০০ টাকার নোট ছাপা ইত্যাদি বিষয়ে কথা হলেও শীর্ষ ব্যাঙ্কের পর্ষদকে এত বড় সিদ্ধান্তের কথা নাকি মেরেকেটে ২৪ ঘণ্টা আগে জানিয়েছিল কেন্দ্র। ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি, এতে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়। একই সঙ্গে প্রশ্ন, এত তাড়াহুড়ো করে কার্যত সকলকে অন্ধকারে রেখে নেওয়া সিদ্ধান্তে আখেরে উপকার হল দেশের কত জনের? দেশের অর্থনীতিই বা সাফসুতরো হল কতখানি? আর যদি তা না-ই হয়ে থাকে, তা হলে এই পর্বতপ্রমাণ ‘ভুল’-এর দায় নেবে কে? কে ফিরিয়ে দেবে জীবন-জীবিকা? কী ভাবে?

নীতি আয়োগের প্রাক্তন সিইও রাজীব কুমার পর্যন্ত বলেছেন, তাঁকে ফের নোটবন্দির কথা বললে, তিনি সেই পথে হাঁটতেন না।

নোটবন্দি সফল না হলে, এক সময়ে বিভিন্ন জনসভায় নিজেকে ফাঁসিতে ঝোলানোর কথা বলতেন নরেন্দ্র মোদী। এখন আর সে সব কথা তিনি মুখে আনেন না!

এই প্রেক্ষিতে যে মহিলা বিচারপতি নোট বাতিলকে বেআইনি বলার সাহসী উচ্চারণে পিছপা হলেন না, তাঁকে আমার কুর্নিশ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement