২০২৪-এর লোকসভা ভোটের আগে জনগণনার কাজে হাত পড়বে না বলে ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা। ফাইল চিত্র।
অতিমারি পার করে দুনিয়া আবার এক ধরনের ছন্দে ফিরেছে। ভারতও। ভোট হয়েছে, উৎসবের পুরনো আমেজ ফিরেছে, কুম্ভমেলা হয়েছে, আইপিএল-ও। আবার হয়নি অনেক কিছু। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ২০২১ সালের জনগণনা। সময়মতো জনগণনা না হওয়ার প্রধান কারণ অবশ্যই অতিমারি। পাশাপাশি কিছু রাজনৈতিক কারণও রয়েছে, যেগুলিকে ‘নৈতিক’ আখ্যা দেওয়া মুশকিল, এমন একটা কথাও হাওয়ায় ভাসছে।
জনগণনায় দেড় শতাব্দীর চেনা রুটিন ভেঙে যাওয়ার ফল কিন্তু বেশ জটিল হতে পারে। জনগণনা এক সুবিশাল কর্মকাণ্ড— আগামী জনগণনাতে প্রয়োজন পড়বে ৩.৩ লক্ষ কর্মী, আর অন্তত ৪০০০ কোটি টাকা। এই বিপুল সম্পদ ব্যয়ে তো শুধুমাত্র দেশের লোকসংখ্যা গোনা হয় না, সঙ্গে উঠে আসে জনবিন্যাস এবং আর্থিক ও মানবসম্পদ সংক্রান্ত অজস্র অতি-প্রয়োজনীয় তথ্য। পরবর্তী জনগণনা না হওয়া পর্যন্ত যা হাতিয়ার দেশের উন্নয়নের রূপরেখা তৈরি করতে; সেই পরিকল্পনা রূপায়ণে উপযুক্ত খাতে ও উপযুক্ত ভাবে সম্পদের বিনিয়োগে; সেই সঙ্গে বহুবিধ সামাজিক এবং গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের মাপকাঠি তৈরিতে। জনগণনা দেশের নির্মাণ-কাঠামো, তার প্রবহমান রূপরেখার দর্পণ।
২০২৪-এর লোকসভা ভোটের আগে জনগণনার কাজে হাত পড়বে না বলে ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা। সে ক্ষেত্রে, সমীক্ষালব্ধ তথ্য প্রকাশ পেতে অন্তত ২০২৬ সাল অবধি অপেক্ষা। এমনটা আগে কখনও হয়নি। ১৮৮১ সালে শুরু হয়ে প্রতি দশ বছর অন্তত নিয়ম করেই হয়ে আসছিল ভারতের জনগণনা। দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধ, স্প্যানিশ ফ্লু-র মতো অতিমারি, স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বাধীনতার অমৃতমন্থনের মতো সমস্ত ওঠাপড়া সত্ত্বেও। এ বার ব্যবধান হবে অন্তত ১৫ বছরের। এই দীর্ঘ সময়কাল জনবিন্যাসের সঠিক তথ্য অজ্ঞাত থাকছে নীতি-নির্ধারকদের কাছে। ফলে বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর আয়, ব্যয়, বা সম্পদ সৃষ্টির লক্ষ্যে নীতি প্রণয়ন হবে ভুল পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করেই।
তবে এটাও কিন্তু ঠিক যে, দশক ব্যবধানের জনগণনার ক্ষেত্রেও ব্যবধান-কালের শেষ দিকে জনবিন্যাস অনেকটাই আলাদা হয়ে যেতে পারে শেষ জনগণনার তথ্যের থেকে। আসলে এই ১০ বছরের ব্যবধানও একটা আপস। এই সুবিশাল এবং খরচ-সাপেক্ষ কর্মকাণ্ড এর চেয়ে কম সময়ের ব্যবধানে করার পরিকাঠামো সে যুগেও ছিল না, এখনও নেই। তবে এ বার বোধ হয় সময় এসেছে জনগণনার পদ্ধতিটার খোলনলচে বদলাবার। প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করে।
একে তো বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের দিন ফুরিয়েছে। পরিবর্তে এসেছে রেজিস্টার বা নিবন্ধন-ভিত্তিক জনগণনা। বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি রেজিস্টারে রয়েছে প্রচুর তথ্য, যাকে আনা সম্ভব এক ছাতার তলায়। যেমন জনসংখ্যার তথ্য, করের রেকর্ড, কর্মসংস্থানের পরিসংখ্যান, স্কুল এবং হাসপাতালের নিবন্ধন, বিভিন্ন পুরসভার তথ্য। এমনটাই কিন্তু করা হচ্ছে অস্ট্রিয়া, জার্মানি, সুইৎজ়ারল্যান্ড, হল্যান্ড, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক, গ্রিনল্যান্ড, বাহরিন বা সিঙ্গাপুরে। অবশ্য বিভিন্ন নিবন্ধনের তথ্যের মধ্যে নানা ধরনের অসঙ্গতি থাকা স্বাভাবিক। সে সব ফাঁকফোকর বুজিয়ে যথাযথ এক তথ্যভান্ডার নির্মাণ করা কঠিন নিশ্চয়ই। এ যেন ফসিলের টুকরো মিলিয়ে একটা অজানা প্রাণীর অবয়ব তৈরি করা। কিন্তু, জোর দিয়ে বলতে পারি, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের উত্তরাধিকারী ভারতীয় রাশিবিজ্ঞান, এবং সেই সঙ্গে কম্পিউটার বিজ্ঞান সেই চ্যালেঞ্জের জন্য তৈরি।
অবশ্য এটাও ঠিক যে, এই ভাবে নানা নিবন্ধন মন্থন করে তৈরি করা তথ্যভান্ডারে জনগণনায় সংগৃহীত তথ্যের সবটা নাও মিলতে পারে। সেটুকু পেতে দেশের জনসংখ্যার পাঁচ থেকে দশ শতাংশের মধ্যে সমীক্ষা করা যেতে পারে। সুইৎজ়ারল্যান্ডে এমন ব্যবস্থা প্রচলিত। সবটা মিলিয়ে পাওয়া যাবে একটা বিকল্প জনগণনার তথ্যভান্ডার। আশা করা যায়, তার গুণমান নেহাত খারাপ হবে না। মনে রাখা ভাল যে, প্রথাগত জনগণনাতেও কিছু ভুল থেকেই যায়। তার উপরে, এই ব্যবস্থায় খরচ কমবে বহুলাংশে। যেমন অস্ট্রিয়ার ২০০১ সালের জনগণনা হয়েছিল প্রথাগত উপায়ে, সম্পূর্ণ গণনাভিত্তিক। খরচ পড়েছিল ৭২ মিলিয়ন ইউরো। দশ বছর পরে অস্ট্রিয়া যখন নিবন্ধন-ভিত্তিক জনগণনা করল, তাতে খরচ হল মাত্র ১০ মিলিয়ন ইউরো।
কিন্তু নিবন্ধন-ভিত্তিক জনগণনাই একমাত্র সমাধান নয়। একে করতে হবে আরও প্রযুক্তি-নির্ভর, ‘গতিশীল’। যা সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে প্রতিনিয়ত, আমাদের প্রতিটা অর্থনৈতিক, সামাজিক পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে। প্রতিনিয়ত ‘আপডেটেড’ হতে থাকা ‘গতিশীল নিবন্ধন-ভিত্তিক’ তথ্যভান্ডারই আমাদের জোগান দিতে পারে জনগণনার তথ্য, যে কোনও সময়, কেবলমাত্র কম্পিউটারে কয়েকটা ক্লিকের সাহায্যে। ২০১৪ সালে ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করে যে, ২০২১-এর জনগণনাই হতে চলেছে সে দেশের শেষ প্রথাগত জনগণনা। তার পর তা প্রতিস্থাপিত হবে নিয়মিত এবং সময়োপযোগী প্রশাসনিক তথ্যের সাহায্যে উৎপাদিত পরিসংখ্যান দিয়ে। জনগণনার সনাতন প্রশ্নোত্তর-ভিত্তিক পদ্ধতি থেকে সরে এসে ব্রিটেন জড়ো করবে দেশবাসীর দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি স্পন্দনের তথ্যকে।
আমাদের তবু আধারের মতো একটা তথ্যভান্ডার রয়েছে। ব্রিটেনের কিন্তু সে রকম কিছুও নেই। এবং ঘটনা হল, আমাদের জনগণনাও কিন্তু ক্রমশ হাঁটছে এই আধুনিকতার পথে। খানিকটা হলেও। এমনিতে ‘কাগজ-কলমের জমানা’ পেরিয়ে আগামী জনগণনা হবে ‘ডিজিটাল’, এমনই ঘোষণা হয়েছে। তবে তা কতটা ‘গতিশীল’ কিংবা ‘নিবন্ধন-ভিত্তিক’ হবে, সেটাই প্রশ্ন। কয়েক বছর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আধার আর ভোটার কার্ডের তথ্যভান্ডারকে জনগণনার তথ্যভান্ডারের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার উপায় ভাবার কথা বলেছিলেন। সেই কাজ কত দূর এগিয়েছে?
‘গতিশীল’ হওয়ার জন্য জনগণনার তথ্যভান্ডারকে ‘আপডেট’ করতে হবে প্রতি মুহূর্তে, জনগণেশের প্রতিটা পদক্ষেপের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। কেমন এই গতিশীলতা? গত মে মাসে ডিরেক্টরেট অব সেন্সাস অপারেশনস, অসম-এর নতুন ভবনের উদ্বোধন করার সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ভারত এমন এক সফটওয়্যার বানাতে চলেছে, যার সাহায্যে প্রতিটা শিশুর জন্মতারিখ জনগণনার তথ্যভান্ডারের শেষে যোগ হতে থাকবে। কারও ১৮ বছর বয়স হলেই সরাসরি নাম উঠে যাবে ভোটার তালিকায়। মৃত্যু হলে নাম বাদ যাবে তালিকা থেকে। কেউ ঠিকানা বদলালেও প্রয়োজনীয় পরিবর্তন হবে ভোটার তালিকায়।
এটা ‘গতিশীলতা’র দিকে এক ধাপ এগোনো নিশ্চয়ই। কিন্তু, এ কেবলমাত্র ভোটার তালিকার গতিশীলতা। জনগণনা তো কেবলমাত্র জনগণের তালিকা নয়— নির্বাচন সংঘটিত করা তার একমাত্র লক্ষ্য নয়। জনশুমারি বিভিন্ন তথ্যের একটি বিশাল খনি— যার আওতায় পড়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, সাক্ষরতার মাত্রা, শিক্ষা, আবাসন ও গৃহস্থালির তথ্য, নগরায়ণ, অভিবাসন, জন্ম ও মৃত্যুহার, ধর্ম, ভাষা এবং অন্যান্য আর্থ-সামাজিক, এবং সাংস্কৃতিক তথ্যাদি। এই সমস্ত তথ্যকে বাস্তব সময়ের নিরিখে আপডেট করা হতে থাকবে কি না, তা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে সম্পূর্ণ গতিশীলতার লক্ষ্যে এই ধরনের সফটওয়্যারকে আরও উন্নত করে তার পটভূমিকে বাড়িয়ে দেওয়া যায় নিশ্চয়ই।
তথ্যভিত্তিক নীতি-নির্ধারণ এবং সুপ্রযুক্ত পরিকল্পনার জন্য, আমাদের প্রতিনিয়ত প্রয়োজন সাম্প্রতিক তথ্য— গতিশীল এবং অবিচ্ছিন্ন জনগণনার তথ্য। যদি তা বাস্তবায়িত করা যায়, কোনও বিপর্যয়ই জনগণনার অতি-প্রয়োজনীয় প্রবহমান স্রোতকে সহজে রুদ্ধ করতে পারবে না ভবিষ্যতে। এবং সেটাই হতে পারে ডিজিটাল ইন্ডিয়ার সবচেয়ে বড় উত্তরাধিকার।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা