—ফাইল চিত্র।
গত চোদ্দো বছর ধরে বিলেতে কনজ়ারভেটিভ সরকার ছিল। ২০১০ সালের নির্বাচনে লিবারাল ডেমোক্র্যাট-দের হাত ধরে ডেভিড ক্যামেরন প্রধানমন্ত্রী হন; ২০১৫, ২০১৭, ২০১৯-এ পর পর তিন বার কনজ়ারভেটিভ নেতারাই সাধারণ নির্বাচনে জেতেন। ২০১৫-তে ক্যামেরনের পরে নির্বাচনে একক জয়ের মুখ দেখেন যথাক্রমে টেরিজ়া মে এবং বরিস জনসন। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বরিসের পদত্যাগের পরে মাত্র সাত সপ্তাহের জন্য লিজ় ট্রাস দলনেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তার পর এলেন ঋষি সুনক।
এই নির্বাচনে কনজ়ারভেটিভরা গো-হারান হারলেন শুধু নয়, পার্লামেন্টে সাড়ে ছ’শো-র মধ্যে আগের বারের চেয়ে আড়াইশো সিট খুইয়ে কনজ়ারভেটিভদের দখলে এখন মাত্র ১২২টি আসন। কেন এমনটা হল, তার উত্তর পেতে খুব দূরে যেতে হবে না। চোদ্দো বছরের সরকারের কার্যকলাপে সব্বাই বিরক্ত, বীতশ্রদ্ধ, এমনকি ক্রুদ্ধ। তাই ‘অ্যান্টি-ইনকামবেন্ট’ ভোট এ বার গগনচুম্বী।
মাস দেড়েক আগে সুনক নির্বাচনের দিন ঘোষণা করাতেই সকলে আশ্চর্য হয়েছিলেন। ভোট না ডাকলেও চলত, ২৮ জানুয়ারি অবধি সুনকের হাতে সময় ছিল। তবু ফাটকা খেলেছিলেন, বিলেতের অর্থনীতির উন্নতির কিছু সূচক দেখেই। কাজে লাগল না। নির্বাচনের প্রচারকালেও প্রতি পদে সরকারের বিরুদ্ধে রোষ বাড়ল বই কমল না।
তবে বিগত কনজ়ারভেটিভ প্রধানমন্ত্রীদের ব্যর্থতার কথা এই প্রসঙ্গে আসবে। টেরিজ়া মে, বরিস জনসন তো বটেই, বিশেষ করে লিজ় ট্রাস বিলেতের অর্থনীতির দৈন্যদশা গভীর করেছেন। ভোটাররা এমন ভাবে পরিবর্তন চেয়েছিলেন যেন, অন্য যে কোনও দলই কনজ়ারভেটিভদের থেকে ভাল।
তাই মনে হয়, সুনকের জায়গায় কনজ়ারভেটিভ দলের অন্য কোনও নেতা থাকলেও এই নির্বাচনে হারতেন। তবু মনে প্রশ্ন জাগে, সুনক কি তাঁর প্রাপ্য কৃতিত্বটুকু পেলেন না? যদি তা-ই হয়, তা হলে পরের প্রশ্ন, সেটা কি তাঁর ভারতীয় বংশধারার জন্যই?
মেনে নিতেই হবে বিলেতের অর্থনীতির দুর্দশার পিছনে তাঁর ব্যক্তিগত দায় কম। আক্ষরিক অর্থেই যাকে বলে বাইরের শক, সেগুলোই অর্থনীতিকে ধরাশায়ী করেছে। ব্রেক্সিট, কোভিড, ইউক্রেন: পর পর এই তিনটে শব্দকে সাজালে ছবিটা পরিষ্কার হয়ে যায়। বিলেতের নাগরিকদের তাই সুনক বোঝাতে চেয়েছিলেন এ-হেন পরিস্থিতিতে তাঁর হাতই শক্ত, লেবার-দলনেতা স্যর কিয়ের স্টার্মারের নয়।
তবে এও ঠিক, সুনকের পরাজয়ের তিন নম্বর কারণটা মুখ ফুটে কেউ বলতে চাইছেন না। আগের চার জন নেতার দায় বা চোদ্দো বছর ধরে জমে থাকা ক্ষোভের সঙ্গে যেটা মিলেছে, সেটা বিদ্বেষ। এই নির্বাচন দক্ষিণপন্থার জয়। শুধু বিলেতে নয়, ইউরোপের সর্বত্রই সম্প্রতি দেখা দিয়েছে এই বিদ্বেষ। গত মাসে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের নির্বাচনেও দক্ষিণপন্থীদের বড় প্রভাব দেখা গেল।
বিলেতে নির্বাচনের ঠিক আগে ‘রিফর্ম ইউকে’ নামের একটা নতুন দল গড়েন নাইজেল ফ্যারাজ (ছবি)। নাইজেল ফ্যারাজকে যাঁরা জানেন, চেনেন, তাঁরাই বলবেন এই দল চরম দক্ষিণপন্থাই অবলম্বন করবে; হলও তা-ই। নাইজেল নিজেই এক বিতর্কিত প্রসঙ্গে সুনক সম্বন্ধে বলে বসলেন “ও আমাদের ইতিহাস জানে না, বোঝে না”। ওরা বনাম আমরা ভেদটা স্বচ্ছ ভাবে বেরিয়ে এল। বিলেতের সাধারণ জনগণ অন্তত মুখের ভাষায়, জাতিবিদ্বেষী নন। কিন্তু বাস্তবেও তা-ই কি? এই নির্বাচন চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল এই ধারণা কতটাই ভঙ্গুর। নাইজেলের দলের এক সমর্থক সুনককে পরিষ্কার জাতি তুলে গাল দিয়েছেন। তাঁর বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্য শুনে অবশ্য সুনক বলেছেন, মাত্র কয়েক জনের জাতিবিদ্বেষ-প্রসূত মনোভাব। প্রশ্ন হল, সত্যিই কি এঁরা ‘স্মল মাইনরিটি’?
সুনক প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন সংসদীয় নেতা হিসেবে, শুধুমাত্র দলের সদস্যদের ভোটে। সেখানেও তিনি ছিলেন নেতা নম্বর টু, লিজ় ট্রাসের পিছনে। আজকে যদি আমেরিকার স্টাইলে বিলেতে নির্বাচন হয়, অথবা ব্রেক্সিট-এর মতো গণভোট, তা হলে কি সুনক নেতা হতে পারতেন? এই নির্বাচন তারই উত্তর চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী হিসেবে সুনকের ‘সিভি’ ভালই; কুড়ি মাসে প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও অনেক কিছুই করেছেন, তবু বিলেতের নাগরিকরা তাঁর কর্মপদ্ধতিতে আস্থা বা বিশ্বাস কোনওটাই দেখাল না।
বলা যেতেই পারে, সুনককে ধরাশায়ী করলেন ফ্যারাজই। ২০১৯-এর নির্বাচনের তুলনায় লেবার ২১২টা বেশি আসন পেলেও মোট ভোটের হিসাবে লেবার কিন্তু মাত্র ১.৬ শতাংশ বেশি ভোট পেয়েছে। তা হলে কনজ়ারভেটিভদের ভোটগুলো পেল কারা? ‘রিফর্ম ইউকে’, আবার কারা! সংসদে মাত্র চারটে আসনে জিতলেও, দেশের মোট ভোটের ১৪.৩ শতাংশ তারা পেয়েছে। শতকরা বিচারে তারাই তৃতীয় স্থানে।
ফ্যারাজ বলছেন, এই শুরু, অনেক পথ যাবেন তাঁরা। সেটা সত্যি হোক না হোক, রিফর্ম ইউকে-র সমর্থনে ভোটের সংখ্যা দেখে মনে হয় না এই দেশে আগামী কয়েক দশকে আর কোনও ভারতীয় বংশোদ্ভূত ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে থাকতে পারবেন।