পথিকৃৎ: ড্যানিয়েল কানেম্যান। গেটি ইমেজেস।
অর্থনীতির ছাত্র না হয়েও কি প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ হওয়া যায়? অর্থনীতিতে যুগান্তকারী গবেষণার জন্য পাওয়া যায় নোবেল পুরস্কার? সাধারণ বুদ্ধিতে বলে, অসম্ভব। কিন্তু এই অসম্ভবকেই সম্ভব করে দেখিয়েছিলেন সদ্যপ্রয়াত ইহুদি-আমেরিকান মনস্তত্ত্ববিদ ড্যানিয়েল কানেম্যান (১৯৩৪-২০২৪)। তাঁকে এই মুহূর্তে অর্থশাস্ত্রের অন্যতম চর্চিত শাখা বিহেভিয়রাল ইকনমিক্স বা আচরণবাদী অর্থনীতির জনক বললে এক বিন্দু অত্যুক্তি হবে না।
গত শতকের সত্তরের দশক পর্যন্ত মূলধারার অর্থনীতির তত্ত্বে মানুষের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ার বিশ্লেষণে মনস্তত্ত্বের কোনও ভূমিকা ছিল না বললেই চলে। রক্তমাংসের মানুষের পরিবর্তে ‘হোমো-ইকনমিকাস’ বা মনহীন, মস্তিষ্কসর্বস্ব, স্বার্থপর, প্রখর যুক্তিসম্পন্ন প্রায় রোবটের মতো অর্থনৈতিক মানবকে নিয়েই ছিল অর্থনীতিবিদদের কারবার। এই ‘অর্থনৈতিক মানব’-এর সঙ্গে আমার-আপনার মতো রক্তমাংসের হোমো স্যাপিয়েন্স-এর মিল সামান্যই। আমরা সব সময় যুক্তি দিয়ে বিচার করে সিদ্ধান্ত নিই না, ভুল করি, আমরা কুঁড়ে, ভিতু, অনিশ্চয়তায় ভুগি, অনেক সময় নিজের স্বার্থ ত্যাগ করেও অন্যের ভাল করার কথা ভাবি। তাই হয়তো মূলধারার অর্থশাস্ত্র দিয়ে সাধারণ মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াটিকে বোঝা যেত না তেমন ভাবে। আর, বোঝা না-গেলেই তাকে দাগিয়ে দেওয়া হত ইর্যাশনাল বা অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত বলে। সাবেক অর্থনীতির অত্যন্ত বড় এই ত্রুটিটিই মেরামত করেছিলেন কানেম্যান— মনস্তত্ত্বকে অর্থনীতির একেবারে কেন্দ্রে নিয়ে এসে। মনস্তত্ত্বের মেধাবী ছাত্র ছিলেন বলেই তিনি এ বিষয়ে প্রথম থেকে নিশ্চিত ছিলেন যে, মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় মনস্তত্ত্বের ভূমিকা অসীম। তাই সেটা ঠিক ভাবে বিশ্লেষণ করতে গেলে তা করতে হবে মনস্তত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকেই।
মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় মনস্তত্ত্বের ভূমিকা সম্বন্ধে জানার আগ্রহ কানেম্যানের তৈরি হয়েছিল একটি অদ্ভুত ঘটনার মধ্যে দিয়ে। এক আত্মজৈবনিক রচনায় তিনি লিখেছিলেন: “১৯৪১ কিংবা ১৯৪২ সাল। আমার তখন সাত বছর বয়স, প্যারিসে থাকি। সেখানে ইহুদিদের জন্য রাতে কার্ফু, বাইরে বেরোনো নিষেধ। এক দিন বন্ধুর বাড়ি থেকে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলাম রাতে। গায়ের সোয়েটারটা উল্টো করে পরে নিয়েছিলাম, কারণ সেটায় ‘স্টার অব ডেভিড’ আঁকা ছিল (যা ইহুদি ধর্মের স্বীকৃত প্রতীক)। বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গেছি, এমন সময় এক জার্মান সৈনিক আমাকে দেখে ফেললেন। এঁদেরকে ভয় পেতাম খুব, কারণ আমাদের জন্য তাঁরা ছিলেন সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। তিনি আমাকে কাছে ডাকলেন, কোলে তুলে নিলেন, তার পর সোয়েটারের ভিতরের দিকটা দেখলেন। স্টার অব ডেভিড ঠিকই চোখে পড়ল তাঁর। কোল থেকে নামিয়ে পার্স থেকে আমারই বয়সি একটি ছেলের ছবি বার করে দেখালেন আমায়। তার পর আমাকে কিছু অর্থ দিয়ে চলে গেলেন। আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, হত্যাকারীরা যদি এ রকম ব্যবহার করতে পারে, তা হলে নিশ্চিত যে, মানুষের মন অত্যন্ত জটিল, এবং যে প্রক্রিয়ায় তারা সিদ্ধান্ত নেয় সেটা অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক।”
আচরণবাদী অর্থনীতির অণু-পরমাণুতে মিশে রয়েছে কানেম্যানের কাজ। সেই কাজের অনেকটাই তিনি করেছিলেন সহকর্মী এবং বন্ধু অ্যামোস ট্ভর্স্কির সঙ্গে যৌথ ভাবে। কানেম্যান এবং ট্ভর্স্কির বন্ধুত্বের সূত্রপাত ১৯৬৯-এ হিব্রু ইউনিভার্সিটিতে। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে ক্যাম্পাস থেকে পিএইচ ডি শেষ করে কানেম্যান তখন সেখানে অধ্যাপনা করছেন। আলাপের কিছু দিনের মধ্যেই কানেম্যানের মনে হতে শুরু করে, ট্ভর্স্কি আর তিনি যেন একই মস্তিষ্ক ভাগ করে নিচ্ছেন! প্রথমে মনস্তত্ত্বে এবং তার পরে আচরণবাদী অর্থনীতিতে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাপত্র লিখেছেন দু’জন মিলে প্রায় তিন দশক ধরে— ১৯৯৬-তে ট্ভর্স্কির অকালমৃত্যু পর্যন্ত। ২০১১-য় প্রকাশিত কানেম্যানের বিখ্যাত বই থিঙ্কিং, ফাস্ট অ্যান্ড স্লো-র একটা বড় অংশ জুড়ে আলোচিত হয়েছে সেই সমস্ত গবেষণা। তাঁর জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা যে বন্ধু ট্ভর্স্কির সঙ্গে যৌথ গবেষণা, চিরকাল তা স্বীকার করেছেন কানেম্যান।
তাঁর অসংখ্য কাজের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চর্চিত সম্ভবত ‘টু সিস্টেম থিয়োরি’। মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া বোঝার জন্য এর চেয়ে বাস্তবসম্মত কাঠামো আজ অবধি আবিষ্কৃত হয়নি। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, মানুষের মস্তিষ্কে দু’টি সিস্টেম সমান্তরাল ভাবে কাজ করে— সিস্টেম ১ এবং সিস্টেম ২। এই দু’টি সিস্টেমের যে কোনও একটি ব্যবহার করে মানুষ তাদের প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত নেয়। সিস্টেম ১ স্বয়ংক্রিয় কাজ করে বিশেষ কোনও রকম প্রচেষ্টা ছাড়াই, এটির দ্বারা সাধারণত নির্ধারিত হয় আবেগ। সিস্টেম ২, অন্য দিকে, প্রচেষ্টামূলক মানসিক ক্রিয়াকলাপগুলির প্রতি মনোযোগ বরাদ্দ করে— এটি নির্ধারণ করে চেতনা। সিস্টেম ১ কাজ করে অত্যন্ত দ্রুত, সিস্টেম ২ কাজ করে ধীর লয়ে। মানুষ যখন সিস্টেম ২ ব্যবহার করে তার সিদ্ধান্ত নেয়, সে সত্যিই যুক্তিবুদ্ধি ব্যবহার করে সিদ্ধান্ত নেয়, তাই সেই সিদ্ধান্তে ভুল-ভ্রান্তি হওয়ার সম্ভাবনা কম। অন্য দিকে, যখন সে সিস্টেম ১ ব্যবহার করে সিদ্ধান্ত নেয়, তখন যে-হেতু সেখানে যুক্তিবুদ্ধি ব্যবহৃত হয় না (বা কম হয়), সেই সিদ্ধান্ত অনেক সময়ই ভুল হয়ে যায়, যাকে পরিভাষায় বলে কগনিটিভ বায়াস।
সিস্টেম ১ ব্যবহার করে মানুষ কী ভাবে সিদ্ধান্ত নেয় সেটা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কানেম্যান উপস্থাপন করেছিলেন হিউরিস্টিক তত্ত্বের, যেটিকে বাদ দিয়ে আধুনিক আচরণবাদী অর্থনীতির কথা ভাবাই যায় না। হিউরিস্টিক বলতে বোঝায় বিভিন্ন রকমের মানসিক ‘শর্টকাট’, যার ভিত্তিতে আমরা চটজলদি নানা রকম সিদ্ধান্ত নিই প্রতিনিয়ত। কী রকম শর্টকাট? ধরুন আপনি কলকাতা থেকে ভুবনেশ্বর যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। বিমানে যাবেন, না গাড়িতে, সেই নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত— যদিও জানেন যে, বিমানে যাওয়াটা গাড়িতে যাওয়ার থেকে সুবিধাজনক। হঠাৎ আপনার মনে পড়ল গত কাল কাগজে পড়া আফ্রিকায় একটি বিমান-দুর্ঘটনার খবর। আপনি তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, গাড়িতেই যাবেন, কারণ বিমানে যাওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ। এই সিদ্ধান্ত যুক্তির দ্বারা নির্ধারিত নয় (কারণ সাধারণত বিমান-দুর্ঘটনার সম্ভাবনা অতি নগণ্য)। বরং, এই ক্ষেত্রে আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন এক রকমের হিউরিস্টিক ব্যবহার করে, যাকে কানেম্যান বলছেন ‘অ্যাভেলেবিলিটি হিউরিস্টিক’।
আটষট্টি বছরে বয়সে ২০০২ সালে নোবেল পুরস্কার পান কানেম্যান অর্থনীতিবিদ ভার্নন স্মিথের সঙ্গে যুগ্ম ভাবে ‘মনস্তত্ত্বের বিবিধ গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব অর্থবিজ্ঞানে সংযুক্ত করার জন্য’। কানেম্যানের প্রয়াণে নবতিপর স্মিথ মনে করিয়ে দিয়েছেন, মানুষের সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া এবং মানুষের সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক নিয়ে অর্থবিজ্ঞানের জনক অ্যাডাম স্মিথের যে বিস্ময়কর চিন্তাভাবনা ধরা রয়েছে ২৬৫ বছর আগে প্রকাশিত দ্য থিয়োরি অব মরাল সেন্টিমেন্টস বইটিতে, সেই চিন্তাভাবনাই বিকশিত হয়েছিল কানেম্যানের মৌলিক গবেষণার মধ্যে দিয়ে। তাই স্মিথের মতে, কানেম্যান কেবল এক জন গুরুত্বপূর্ণ সমাজবিজ্ঞানীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন অ্যাডাম স্মিথের যোগ্য উত্তরসূরি।
সমাজবিজ্ঞানের অন্য শাখাগুলির প্রতি অর্থনীতিবিদরা যথেষ্ট শ্রদ্ধাবান নন, এমন একটি অভিযোগ শোনা যায়। কথাটাকে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেওয়া মুশকিল। এই অর্থশাস্ত্রের সাম্রাজ্যে ‘বহিরাগত’ হয়েও প্রায় অর্ধশতক ধরে কানেম্যান বিপুল বিক্রমে তাঁর রাজপাট চালিয়েছেন, অর্জন করেছেন স্বপ্নাতীত সাফল্য। কানেম্যানের এই যাত্রাপথের কথা ভাবলে হারবার্ট উপন্যাসের সেই অমোঘ বাক্যটি একটু পাল্টে নিয়ে বলতে ইচ্ছা করে: “কী ভাবে বিস্ফোরণ ঘটবে এবং কে তা ঘটাবে সে সম্বন্ধে জানতে এ পৃথিবীর এখনও বাকি আছে।”