—প্রতীকী ছবি।
২০১৯ সালে প্রকাশিত হয় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-এর ইন্ডিয়া করাপশন সার্ভে ২০১৯। সমীক্ষার মূল জিজ্ঞাস্য ছিল, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের বাসিন্দাদের বিভিন্ন সরকারি কাজকর্ম সম্পর্কিত পরিষেবা এবং অন্যান্য কারণে উৎকোচ প্রদান করতে হয় কি? কোন রাজ্যে কত শতাংশ মানুষকে উৎকোচ দিতে হয়? অর্থাৎ, একটি সঙ্কীর্ণ অর্থে হলেও এই সমীক্ষা থেকে ভারতের রাজ্যগুলিতে দুর্নীতির মাত্রার একটি মাপ পাওয়া যায়। সেই হিসাব অনুযায়ী বেশি, মাঝারি এবং কম দুর্নীতিগ্রস্ত— এই তিন শ্রেণিতে রাজ্যগুলোকে ভাগ করা হয়েছে। সমীক্ষার ফলাফল অনুসারে, বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত রাজ্যের তালিকায় রয়েছে উত্তরপ্রদেশ, বিহার, রাজস্থান, পঞ্জাব, কর্নাটক, তামিলনাড়ু; মাঝারির দলে মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ; তৃতীয় দলে অর্থাৎ দুর্নীতির এ ধরনের পরিমাপের নীচের দিকে আছে পশ্চিমবঙ্গ, গুজরাত, ওড়িশা, কেরল। এটা দুর্নীতি মাপার যথাযথ পন্থা কি না, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে— কিন্তু, যে কোনও পন্থা নিয়েই সে প্রশ্ন ওঠার সম্ভাবনা আছে।
কিছু বছর আগে কলকাতার সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস কলকাতা-র এক গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, দক্ষিণ ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে উন্নয়নের হাত ধরে প্রচুর গ্রামাঞ্চল বেশ সচ্ছল হওয়া সত্ত্বেও— অর্থাৎ সেখানে ধনী মানুষদের সংখ্যা বেশি হওয়া সত্ত্বেও— সেখানে দারিদ্রসীমার নীচে থাকা মানুষরা তাঁদের প্রাপ্য অনুদান থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। গরিবের অনুদান বড়লোকদের পাইয়ে দেওয়া নিশ্চয়ই দুর্নীতি। কিন্তু ‘বড়লোক বলে কি কিছুই পাবে না?’— এই যুক্তি দিয়ে অনুদানের নীতি নিশ্চিত করা হয় রাজনৈতিক স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে, না হলে সে সব গ্রাম ভোট দেবে না। সচ্ছলদের লোভ, প্রতিপত্তি এবং রাজনীতিকে প্রভাবিত করার ক্ষমতার কাছে নীতিকে নতজানু হতেই হয়।
এর একমাত্র দাওয়াই হল, খাতায়-কলমে টার্গেটেড পভার্টি অর্থাৎ সঠিক ভাবে বিপিএল গোষ্ঠীকে নির্দিষ্ট করে শুধু তাদের অনুদান দেওয়া। কিন্তু, কোনও রাজনৈতিক দলই সঠিক ভাবে গরিব বড়লোক নির্দিষ্ট করতে চায় না, কারণ তা হলে হয়তো পাইয়ে দেওয়ার জন্য তেমন কিছু থাকবে না। ভারতের অর্থনৈতিক প্রগতির জন্য গরিব বড়লোকের ছাপ নতুন করে হওয়া আবশ্যিক। কিন্তু তাতে রাজনৈতিক আশঙ্কা সুপ্রচুর। অথচ দীর্ঘকাল আগে অমর্ত্য সেন এই টার্গেটেড নীতির কথা বলেছিলেন বিশদ ভাবে। সে সব আমরা দেখি না। দারিদ্র মোচনে দারিদ্রের অবিনশ্বরতাই আমাদের গবেষণার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। তাই অনেক ক্ষেত্রে উন্নয়ন হলেও দুর্নীতি চলতে থাকে।
পশ্চিমবঙ্গে ২০১১ সাল থেকে বহু সরকারি প্রকল্প নিয়ে নতুন কাজ শুরু হয়েছে। যাঁরা কাজকর্মের নির্দিষ্ট দায়িত্বে ছিলেন হয়তো তাঁদের কারও কারও শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে, কিন্তু তাঁদের মধ্যে অনেকেই নিজ নিজ এলাকায় প্রচুর কাজ করেছেন, মানুষ উপকৃত হয়েছেন, এ কথাটাও ভীষণ ভাবে সত্যি। অর্থনীতির খুব গোড়ার দিকের শিক্ষা বলে, যদি দুর্নীতির পরিমাণ শূন্য করাটাই সরকারের উদ্দেশ্য হয়, তা হলে সেই সরকারের পক্ষে শেষ পর্যন্ত কোনও কাজ করাই সম্ভব হবে না। আবার মাত্রাহীন দুর্নীতির সমস্যাও সুপ্রচুর। অর্থনীতি সব সময় একটি ভারসাম্যের কথা বলে।
প্রশ্ন হল: সেই ভারসাম্যটি কোথায়? ধরা যাক, সরকার বাড়ি করতে গরিব মানুষদের এক লাখ টাকা দিচ্ছে। যাঁরা তাঁদের কাছে এই অনুদান পৌঁছে দেবেন তাঁরা জানেন যে, সেখান থেকে বাড়িপিছু ১০ শতাংশ কমিশন দিলেও অনুদানটি পরিবারটির কাছে সুপ্রচুর এবং কমিশনের ফলে অনুদানটি পৌঁছে দেওয়ার গতিও বেশ বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু, দুর্নীতি মানতে নারাজ সরকার স্থির করল, কমিশনের খবর পেলেই সরকারি তথা রাজনৈতিক প্রতিনিধির হাতটি কেটে দেওয়া হবে। কিন্তু তবুও অনুদানটি পৌঁছে দেওয়ার সময়টি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না, কারণ পরিবারটির সেটি প্রাপ্য কি না, সেটাও তো জানতে হবে। যাচাই করতে হবে। নিষ্ঠাবান সৎ কর্মচারী অনেক সময় নিয়ে যাচাই করবেন ইত্যাদি। অর্থাৎ সরকারের মূল উদ্দেশ্য, সেটি সুনীতি কার্যকর করা বা নিছক ভোটের জন্য স্বার্থসিদ্ধি, যা-ই হোক না কেন, ব্যর্থ হবে। কমিশন বা কাটমানির পরিমাণ নির্ধারিত হওয়ার পিছনেও একটি অর্থনীতি আছে। সেইমতো দুর্নীতি বনাম উন্নয়নবিহীন অস্তিত্বের মধ্যে কোনটি পছন্দ হবে, সেটাই ভাবার কথা।
দুর্নীতির মাত্রা কী ভাবে নির্ধারিত হবে? তিন দলের মানুষ আছেন এই খেলায়। যিনি বাড়ি পাচ্ছেন, মধ্যস্বত্বভোগী, এবং সরকার। যদি মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি সরকার এবং উপভোক্তা, এই দু’দলের চেয়ে ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন, তা হলেই কমিশনের পরিমাণ বাড়তে থাকবে। মানুষের উষ্মা বাড়বে। কিন্তু কমিশন শূন্য হলে কাজ হবে না, কারণ কাজ করাতে গেলে একটা দাম কাউকে দিতে হবে।
হতেই পারে যে, কমিশনের বাড়বাড়ন্তের কথা শুনে কেন্দ্রীয় সরকার উদ্বিগ্ন হয়ে হস্তক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু সে ক্ষেত্রে পুরো ব্যাপারটি একটা অন্য মাত্রা পাবে। এ রকমটা হতেই পারে যে, কমিশন শূন্য হলে উন্নয়ন থমকে গেল। তাতে রাজ্য সরকার বিপদে পড়বে কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার নয়, কারণ একই দলের দুই সরকার না-ই হতে পারে। ফলে কেন্দ্রীয় সরকার নৈতিক কারণে কমিশন বন্ধ করতে চাইছে, না রাজ্য সরকারের গতি ওল্টাতে চাইছে, সেটা খুব পরিষ্কার ভাবে বোঝা যাবে না। উন্নয়ন প্রক্রিয়া যদি ভীষণ ব্যাহত হয় বা বন্ধ হয়ে যায়, সেটা রাজ্য সরকারেরই দোষ হিসাবে প্রতিপন্ন করা খুব একটা শক্ত হবে না।
আরও একটি ব্যাপার মনে রাখা উচিত। ধরুন দু’জন অনুদানগ্রহীতার মধ্যে এক জন সত্যি গরিব, অন্য জন সত্যি বড়লোক— তা হলে যিনি বড়লোক, তিনি হয়তো কমিশন নিয়ে অত বাছবিচার করবেন না। ফলে কমিশনের পরিমাণ এবং দৃশ্যত দুর্নীতির পরিমাণ অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধ এলাকায় বেশি হতে পারে। সেখানেও ওই পাইয়ে দেওয়ার সমস্যা এবং টার্গেটিং বা নির্দিষ্টকরণের সমস্যা। মনে রাখতে হবে, যিনিই শাসন করুন না কেন, যে মুহূর্তে সঠিক নির্দিষ্টকরণের মাধ্যমে কিছু লোক আর অনুদান পাবেন না, সব বিরোধী পক্ষ এক হয়ে লড়াই শুরু করবে। ফলে ঝামেলা এড়াতে বুদ্ধিমান শাসকও এই দুর্নীতি সয়ে গণতন্ত্রের মান রক্ষা করবেন। দুর্নীতি বেশি হলে গরিব মানুষদের ক্ষতি হয়, কারণ অপেক্ষাকৃত বিত্তশালী অনুদানহীনতারাই কমিশনের মাত্রা ঠিক করে দেন। কিন্তু তবুও কমিশন ছাড়া প্রকল্প রূপায়ণ অসম্ভব হতে পারে। কমিশনের নির্ধারিত মূল্য নিয়েই সব সমস্যার সূত্রপাত। কিন্তু, দুর্নীতি রোধে উৎসাহ আসলে ঘুরপথে উন্নয়নমুখী প্রকল্পকে কার্যকর হতে না দেওয়ার চেষ্টাও হতে পারে।
অর্থশাস্ত্রের তত্ত্ব বলবে, কমিশনের পরিমাণ খুব বেশি হলে মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে সরকারকে আর ভোট দেবেন না। কিন্তু, নির্বাচন ব্যাপারটি আরও অনেক কারণের উপর নির্ভরশীল। তাই, মানুষ খানিকটা বেশি কমিশন সহ্য করেই একই শাসনকালকে পুনরায় নির্বাচন করতে পারেন। যদি কমিশন-কেলেঙ্কারিতে শাসক দল অপসারিত হয়, তা হলে সমস্যা নেই— কিন্তু, কমিশনের উৎপাত সত্ত্বেও যদি সেই শাসক দল আবার রাজ্যে ক্ষমতায় আসে, তা হলে কেন্দ্রের দুর্নীতি-বিরোধী অবস্থান আরও বেশি করে মাথাচাড়া দিতে পারে, যাতে সম্পূর্ণ উন্নয়ন প্রক্রিয়াটাই বন্ধ হয়ে যায়, বা বিশেষ ভাবে ব্যাহত হয়।
সাম্প্রতিক ভারতে সময়ের ঐতিহাসিক বিবর্তন দিয়ে নির্ধারিত যে কোনও জায়গায় কোনও না কোনও ভাবে যে কোনও সরকারি প্রকল্প, এমনকি সরকারি প্রকল্পের বেসরকারি মালিকানায় হস্তান্তর ইত্যাদি যে কিছুটা কমিশনধর্মী, সে কথাটা এ দেশের একটু সচেতন মানুষই মেনে নেবেন। যদিও তাতে ভাল হচ্ছে, এমনটা কেউ বলতে চাইবেন না। ফলে কমিশন, উন্নয়ন, প্রগতি, দুর্নীতি, বৈষম্য রাজনৈতিক সাফল্য, পক্ষপাত, সবই এক সঙ্গে এগোচ্ছে। তাই কমিশন বন্ধ হওয়ার ব্যাপারটি এক অর্থে এই মুহূর্তে অসম্ভব এবং অবাস্তব একটি ঘটনা। উন্নয়ন বন্ধ না করলে উন্নয়নজাত কমিশন বন্ধ করা যাবে না।
সাদামাঠা যুক্তি বলে, যদি রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে উন্নয়ন এসে থাকে, যদি কমিশন সংক্রান্ত দুর্নীতির ডজন ডজন উদাহরণের পর রাজনৈতিক ফলাফল বিরোধী পক্ষের আশানুরূপ না হয়, তা হলে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে দুর্নীতি রোধের নামে উন্নয়নের প্রক্রিয়াটিই বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া বিরোধী পক্ষের আশানুরূপ রাজনৈতিক পরিবর্তনের আর তেমন কোনও রাস্তা থাকবে না। কোনও নতুন প্রকল্প, কোনও নতুন সরকারি কাজকর্ম না থাকলে, কমিশনই বা থাকে কী করে? যদি শুধু কমিশন-শূন্য করতে চাই অনেক উন্নয়নও শূন্য হয়ে যাবে।
যদি সত্যিই আমরা পরিবর্তন চাই, তা হলে দুর্নীতি নিবারণী সমিতির দুর্নীতিগুলোও নির্মূল করতে হবে।