—ফাইল চিত্র।
মাফিয়াদের হাতে মেধার পরীক্ষা ধ্বস্ত, ডাক্তারি পড়া থেকে অধ্যাপনা ও গবেষণার পরীক্ষার অঙ্গনে নেমে এসেছে ঘোর অন্ধকার। এই সময়ে আলোকবর্তিকা হাতে বোধ হয় ইউপিএসসি-র মতো একটি ক্লেদমুক্ত পরীক্ষা নিয়ামক সংস্থা।
গত ৪ জুন যখন গোটা দেশ টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে ছিল অষ্টাদশ লোকসভায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর স্কোর-কার্ড দেখতে, তখন খুব নীরবে ভারতের একটি বড় পরীক্ষা নিয়ামক সংস্থা এনটিএ তাদের পরিচালিত নিট (ইউজি) পরীক্ষার ফল প্রকাশ করল। দেখা গেল, ৭২০ নম্বরের পরীক্ষায় পূর্ণ মান পেয়েছে ৬৭ জন, যার মধ্যে ৮ জনই একই পরীক্ষা কেন্দ্রের। এই অভাবনীয় ফলের পর ক্রমে নিটের পরীক্ষা-পদ্ধতি নিয়ে অজস্র অভিযোগ এসে উপস্থিত হল, এমনকি প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগও উঠল। এনটিএ-র তরফে সাংবাদিক সম্মেলন করে আগেভাগেই বলা হল পরীক্ষায় কোনও কারচুপি হয়নি। অন্য দিকে দাবি উঠল পরীক্ষায় ঢালাও গ্রেস নম্বর দেওয়া হয়েছে।
বিরোধী দলগুলি এই বিষয়টি নিয়ে নতুন সরকারকে নাস্তানাবুদ করার পরিকল্পনা করে। ২৮ জুন রাষ্ট্রপতির ভাষণের আলোচনায় না গিয়ে বিরোধীরা সংসদের দুই সভাকে স্তব্ধ করে দেন। শিক্ষামন্ত্রী প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোনও অভিযোগ নেই। বলেন, যে-হেতু বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের কাছে আছে এবং কোর্ট ৮ জুলাই নির্দেশ দেবে, তাই এই বিষয়ে সরকারের কিছুই করণীয় নেই। পরে অবশ্য শিক্ষামন্ত্রী স্বীকার করেন, কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে।
ইতিমধ্যে বিহার সরকারের অর্থনৈতিক অপরাধ দমন সংস্থার কাছে তথ্য আসে যে, পটনা শহরে প্রশ্নপত্র বেরিয়ে চলে আসে এবং ‘সলভার গ্যাং’-এর সাহায্যে পরীক্ষার ১০-১২ ঘণ্টা আগে পরীক্ষার্থীদের একটি বাড়িতে নিয়ে গিয়ে উত্তর মুখস্থ করিয়ে দেওয়া হয়। জানা যায় যে, এই দুর্নীতির জাল অনেকগুলি রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং এই কেলেঙ্কারিতে প্রায় হাজার কোটি টাকার অর্থমূল্য জড়িয়ে আছে। এই পরীক্ষা মাফিয়াদের অবাধ খেলতে সাহায্য করেছে— প্রমাণ না হলেও গ্রেফতার হওয়া কিছু মানুষের এবং কিছু পরীক্ষার্থীর জবানবন্দিতে তা পরিষ্কার। পরীক্ষার্থীদের অভিভাবকদের দাবি, প্রশ্নপত্র ফাঁস কাণ্ডে এনটিএ-র আধিকারিকদের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। ইতিমধ্যে তামিলনাড়ু, কর্নাটক এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীরা দাবি করেছেন, পুনরায় রাজ্য স্তরে এই প্রবেশিকা পরীক্ষা হোক।
এর পরে ১৮ জুনে হওয়া ইউজিসি নেট পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে, যার দায়িত্বভার ন্যস্ত ছিল সেই এনটিএ সংগঠনটির উপর। ভারত সরকারের সাইবার ক্রাইম সংস্থার তোলা কিছু অভিযোগের ভিত্তিতে বিষয়টিকে সিবিআই তদন্ত করতে দেওয়া হয়। জানা গিয়েছে যে, গত ১৮ জুনের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ডার্কওয়েব-এ ফাঁস হয়ে যায়। এই পরীক্ষার একাধিক ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয় বিহার ও ঝাড়খণ্ড থেকে।
এর ঠিক পরে ওই এনটিএ সংস্থা আয়োজিত নিট (পিজি) পরীক্ষা যেটি হওয়ার কথা ছিল ২৩ জুন, তা পরীক্ষার আগের রাতেই বাতিল করা হয়। অভিযোগ আসে, এই পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। ব্যারাকপুর অঞ্চলের এক পরীক্ষার্থী অভিযোগ করেন, তাঁর কাছে ফোনে প্রস্তাব এসেছিল ৬৫ লক্ষ টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র পাওয়ার। ভাবলে অবাক লাগে, ডাক্তারি শিক্ষার বিভিন্ন বিভাগে এমডি বা এমএস ডিগ্রি লাভের প্রশ্নপত্রও কী ভাবে হাটে বিক্রি হয়ে যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা নিয়োগ দুর্নীতি দেশ জুড়ে আলোড়ন তৈরি করেছে এবং তার আগে শিরোনামে উঠে এসেছে মধ্যপ্রদেশের ব্যপম কেলেঙ্কারি। কিন্তু নিট কেলেঙ্কারি শুধু টাকার অঙ্কেই নয়, এক ধাক্কায় ২৪ লক্ষ পরীক্ষার্থীর ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট মন্তব্য করে, জালিয়াতি করে ডাক্তার হওয়ার এই বন্দোবস্ত সমাজের চরম ক্ষতি করে দিতে চলেছে।
এ বার ইউপিএসসি নামক সংস্থার কথা একটু বলা যাক। ৭৪ বছরের প্রাচীন এই সাংবিধানিক সংস্থায় ১৩ বছর কাজ করার সুবাদে জানি ইউপিএসসি বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়া কত ত্রুটিহীন ভাবে সমাধা করে। একমাত্র সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় প্রায় ১০-১২ লক্ষ আবেদন আসে এবং ৭-৮ লক্ষ পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় বসেন। আজ অবধি ইউপিএসসি-র বিরুদ্ধে কোনও বেনিয়মের অভিযোগ আসেনি। এর কর্মপদ্ধতিকে মডেল হিসেবে অন্য পরীক্ষা নিয়ামক সংস্থা অনুসরণ করতেই পারে, যা খুব দুরূহ বলে মনে হয় না। তবে পদ্ধতিগত পরিবর্তন করতে গেলে প্রাথমিক ভাবে প্রয়োজন সুস্থ মানসিকতা— সেটা এনটিএ-কে দেখাতেই হবে।
সব শেষে বলি, এই সব প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের উপর শুধু জোর না দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের স্কুল বোর্ড বা ডিগ্রি পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরকেও যোগ্যতার পরিমাপের ক্ষেত্রে মূল্যায়নে নেওয়া হলে প্রকৃত মেধা যাচাই করা সহজ হবে। প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করাই মুখ্য উদ্দেশ্য থাকবে না, ফলে দুর্নীতিও কমবে।