রবীন্দ্রনাথ হয়তো বলতেন ‘দুর্দান্ত পাণ্ডিত্যপূর্ণ দুঃসাধ্য সিদ্ধান্ত’
Rabindra Sangeet

‘বড়’ করে ভাবা বন্ধ?

খোদার উপর খোদকারির চেষ্টা যুগে-যুগে বহু হয়েছে। তাবড় সাহিত্যনেতারা শেক্সপিয়রকে কখনও অর্বাচীন আখ্যা দিয়েছেন, তাঁর ‘ভুল’ সংশোধনেও প্রয়াসী হয়েছেন। প্রশ্ন হল, লাভের লাভ কী হল?

Advertisement

সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৭:৫৫
Share:

আহ্বায়ক: তাঁর গান দিয়ে শুরু হল স্বদেশি আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯০৬ (আনুমানিক) —ফাইল চিত্র।

বলাই যায় যে, শ্রীকৃষ্ণকে ভগবদ্‌গীতা বোঝানো, বুদ্ধদেবকে নির্বাণের সন্ধান দেওয়া, আমির খসরুকে উর্দু শেখানো, বিদ্যাসাগরকে অ-আ লিখতে সহায়তা করা বা রবীন্দ্রনাথের গান সংশোধন— এ সব এক গোত্রের ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষা’।

Advertisement

‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানের শব্দ-বদল নিয়ে লেখার শুরুতেই তিনটি কথা বলা জরুরি— এক, রবীন্দ্রনাথের ‘ঐতিহাসিক’ গানের পরিবর্তন একটি অপরাধ। দুই, শুধু রবীন্দ্রনাথই নন, কুরুক্ষেত্র কর্মকারের কাব্য, আনারস আমিনের অঙ্কন, যাচ্ছেতাই যাজ্ঞবল্ক্যের বন্দিশ কিংবা যে-কারও লিখিত-অঙ্কিত-রচিত যে-কোনও চিহ্নিত সৃষ্টিকর্মে কণামাত্র পরিবর্তন ঘনিয়ে তোলার ‘অপচেষ্টা’ না করাই সভ্যতার পাঠ। এবং সেই যুক্তিতেই ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ বা ‘কারার ঐ লৌহকপাট’-এর মতোই ‘আমি কলকাতার রসগোল্লা’ গানেরও শব্দ-সুর বিকৃতির বিরোধিতা কর্তব্য। তিন, এই লেখা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়, বরং কন্যাশ্রী-সবুজ সাথী-স্বাস্থ্য সাথীর মতো সামাজিক ভাবনা-দিশার সমর্থক এক নাগরিকের প্রতিবাদ— গান নিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের।

ঘটনা হল, খোদার উপর খোদকারির চেষ্টা যুগে-যুগে বহু হয়েছে। তাবড় সাহিত্যনেতারা শেক্সপিয়রকে কখনও অর্বাচীন আখ্যা দিয়েছেন, তাঁর ‘ভুল’ সংশোধনেও প্রয়াসী হয়েছেন। প্রশ্ন হল, লাভের লাভ কী হল? আজ কোন শেক্সপিয়র বসত করেন রসিকের ঘরে আদতে, আখর-স্বাক্ষর পরিবর্তনের প্রয়োজন কী, কার বদল কে করছেন— সে-প্রশ্ন স্বয়ং মহাকালের! আজু গোসাঁই রামপ্রসাদ সেনের ‘প্যারডি’ করে বেড়াতেন। প্রশ্ন হল— আমরা কাকে মনে রেখেছি? রামপ্রসাদ না আজু?

Advertisement

‘বাংলার মাটি’র বদল অবশ্য ‘প্যারডি’র মতো মজারু নয়, সরাসরি কবিভাবনায় সরকারি হস্তক্ষেপ! শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীতে বদল ব্যক্তি করলে পাত্তা না দেওয়াই যায়, কিন্তু রাষ্ট্রশক্তি বা ব্যবস্থা করলে বিষয়টি তলিয়ে ভাবার। কারণ, রাষ্ট্রীয় বা ব্যবস্থাজনিত বদল ক্রমে স্থিতাবস্থার ‘স্বাভাবিকতা’য় পর্যবসিত হয়। এমনিতে রাজ্যসঙ্গীতের ভাবনাটি যথেষ্ট সাধুবাদযোগ্য। সংস্কৃতিমনা প্রশাসনই কাম্য। কিন্তু অন্যের সৃষ্টির ভাবনা-বদলের ভাবনা সংস্কৃতি হয় না, হয় ক্ষমতার প্রদর্শনী। কৌশলী কারণে গানের কথা-সুর বদলে স্রষ্টাকে ‘ধন্য’ করার এই বাসনাটি অনেকটা সেই রবীন্দ্রনাথ উল্লিখিত ‘দুর্দান্ত পাণ্ডিত্যপূর্ণ দুঃসাধ্য সিদ্ধান্ত’ গোছের (‘ছন্দের অর্থ’ প্রবন্ধ)! ভুল ব্যাখ্যায় দুর্দান্ত সাফল্য অর্জন না করলে ‘বাঙালি’ শব্দটিকে ‘বাংলা’ করার দুঃসাধ্য সিদ্ধান্তটি নেওয়া সম্ভব হত না!

বিস্ময় হল, যে-ভাবনায় এই বদল, তা যেমন ভুল, তেমনই আপত্তিজনক ভাবনার প্রয়োজনীয়তাটি। গানটি যে-হেতু রাজ্যসঙ্গীত হিসাবে বিবেচিত, তাই বাংলার মাটি-জল-বায়ু-ফল-ঘর-হাট-বন-মাঠে চাপ নেই। কিন্তু বয়ানে ‘বাঙালি’ এলেই নাকি বিপদ! কারণ, বাংলায় তো অবাঙালিরাও থাকেন! তাঁরা গান শোনার পাশাপাশি ভোটও দেন, লগ্নিও করেন। সুতরাং, পরিসর ‘বাঙালি’ থাকলে সঙ্কুচিত আর ‘বাংলা’ রাখলে প্রসারিত! এই উৎকট ভাবনাটি পূর্ণমাত্রায় রাজনৈতিক এবং অসমর্থনীয়।

মূল গানটিও রাজনৈতিক এবং সে রাজনৈতিকতা নৈতিকতার অগ্নিগিরি। বিশ্বে এমন নান্দনিক প্রতিবাদ আর দু’টি সংগঠিত হতে পেরেছে কি না সন্দেহ, যার বিভূতি-মশাল এই রবীন্দ্রগান। ১৯০৫-এর ১৬ অক্টোবর যখন বঙ্গভঙ্গের অশনি সত্য হয়ে উঠল, প্রতিবাদে নগর-সঙ্কীর্তনে নেমেছিলেন রবীন্দ্রনাথেরা। এই উপলক্ষে বাঁধা একাধিক গানের একটি ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’। কবি গান গেয়ে, রাখিবন্ধনের মাধ্যমে একতার শপথ নিয়েছিলেন অখণ্ড বাংলাদেশের হৃদয় রক্ষার— সত্যজিৎ রায়ের রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তৈরি তথ্যচিত্রে যে প্রয়াসকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘ইন আ ফর্ম অব প্রোটেস্ট দ্যাট ওনলি আ পোয়েট ক্যান কনসিভ’ (এক জন কবিই শুধু ভাবতে পারেন এমন পথে প্রতিবাদ)। সমস্যা হল, আজকের রাজনীতি বুঝে উঠতে পারে না, যে মৈত্রীকে কবি ‘বিধির বাঁধন’ বলছেন, তা ভোট-রাজনীতির আবেগ নয় এবং ‘দেশাত্মবোধ’ রাজনীতির ঔরসজাত নয়— বৃহৎ ঐক্যের অভিকর্ষজাত। সে অভিকর্ষের বাঁধন-মমত্বও বেশি, বিস্তারও বিস্তর। হীনম্মন্যতার অবসাদ সেখানে নেই।

রবীন্দ্রনাথই পারেন ‘বাংলা’ থেকে ‘বাঙালি’তে আসতে। কেন কবি আট বার ‘বাংলার’ বলার পরেও সাত বার ‘বাঙালির’ লিখলেন (পাণ্ডুলিপি দেখাচ্ছে, ভেবেচিন্তে ‘বাঙালির’ লিখছেন কবি)? কেন ‘বাংলার ঘর’ লেখার পরেও ‘বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন’ লিখলেন? ‘বাংলা ভাষা’ না বলে ‘বাঙালির ভাষা’ বললেন কেন? এবং ‘সত্য হউক’ প্রার্থনায় কেনই বা তিনি বাংলার বদলে বাঙালির আশা-কাজ-ভাষার কথা বললেন?

শুধু ‘বাঙালির ভাষা’র বিন্দুতেই সিন্ধুদর্শন সম্ভব। বাংলাভাষার যুগনির্মিত দেউলের শত প্রকোষ্ঠে সঞ্চিত স্থান-কাল মাহাত্ম্যের নানা ভাষা-প্রকরণের কাছে কবি প্রণত যেমন এ-গানে, তেমনই ঋণী প্রতিবেশ-যাপন-মিলন সূত্রে নানা শব্দভান্ডারের ধাত্রীকল্যাণে গড়ে ওঠা বাঙালির বৃহত্তর ভাষা-প্রতিমার প্রতি। রবীন্দ্রনাথের মাপের কবি যে তাই ‘বাঙালির ভাষা’ বলবেন, আশ্চর্য কী!

‘বাঙালির ভাষা’ বা ‘বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন’ রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয় ছন্দ মেলাতে লেখেননি! ‘বাংলার ভাষা’ বা ‘বাংলার ঘরে যত ভাই বোন’ লিখলেও ছন্দোবদ্ধই থাকত এবং ছান্দসিক কবি চাইলে কণামুহূর্তে নবছন্দের আবিষ্কার ঘটাতে পারতেন। তাই রবীন্দ্রনাথের ‘ভুল’ সংশোধনের রাষ্ট্রীয় বাতিকটি প্রলাপ! বাংলায় বৃহত্তর অর্থের অধিবাসীর যে প্রসঙ্গ ভেবে শব্দ-বদল, তা যে আগেই কবি সম্পন্ন করে রেখেছেন, তা মাথায় এল না কারও? গানে ‘বাংলার ঘর’ তো আগেই বলা হয়েছিল। সে-ঘরে নিশ্চয়ই ইটকাঠ, জনপ্রতিনিধি বা ইকমিক কুকারই থাকবে না শুধু, পরিবার-পরিজন, মা-বাবা, ভাইবোনও থাকবেন। তা হলে ফের ‘বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন’ কেন? কারণ, এইখানেই ‘যত ভাই বোন’ বাংলায় জন্মার্থে বাঙালি-মাত্র রইলেন না! বাংলার সব ঘরের সব সম্প্রদায়-জাতি-আখরভাষের সকল সদস্য হয়ে উঠলেন এবং কবি-প্রার্থনা— সবাই ‘এক হউক’! এটা বিস্তৃতির দর্শনালঙ্কার। খানিকটা স্বামী বিবেকানন্দ-কথিত ভাষণে ‘সিস্টার্স অ্যান্ড ব্রাদার্স অব আমেরিকা’ সম্বোধনের মতো। সমস্যা হল, বড় ভাবে ভাবার অভ্যাসটিকে খুন করেছি আমরা!

মাঝখান থেকে বহু বিপন্নতার শঙ্কাপথ তৈরি হল। কারণ, ভুল পথে খাল কাটার বাসনা কুমির-অভ্যর্থনার সুচারু পরিসর রচনা করে! রাজ্যসঙ্গীতে শব্দ-বদল মান্যতা পেলে জাতীয় সঙ্গীতের বদল চেয়ে আবারও গো-রব শোনা যাবে না তো? গৈরিক মন্দুরায় আগেই আওয়াজ উঠেছে জাতীয় সঙ্গীত থেকে ‘সিন্ধু’ শব্দটি বাদ দেওয়ার, জাতীয় সঙ্গীত বদলেরও। চেতনার সর্বনাশে আখেরে লাভ উগ্র জাতীয়তাবাদেরই। উগ্রতার, প্রাদেশিকতার মূলে কুঠারাঘাত যে কবির, ঘেরাটোপ-দেশভাবনার ঊর্ধ্বে যিনি জীবনভর, তিনি আমাদের সামান্য চিন্তাচর্চাও আকাঙ্ক্ষা করতে পারেন না? এতে তো কার্যত ‘বাঙালির মন’ও অপমানিত হল!

‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ শব্দবন্ধটি বেজায় ভাল। তবে তার প্রয়োগে ভাবনার পিণ্ডদান সুসম্পন্ন হলে পাথার অকূল হয়। ‘মিলন’ সর্বার্থেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বলপূর্বক তার সম্পাদন অসম্ভব। তাঁর একটি কবিতায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত নানা জাতি-ভাষা-সত্তার মিলনপথের একটা আন্দাজ দিয়েছিলেন— “প্রতিভার তপে সে ঘটনা হবে... জাগিবে না দ্বেষাদ্বেষি”। কিন্তু ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ হতে গেলে যে ‘দ্বেষাদ্বেষি’র আশঙ্কা থাকেই! রাজ্যসঙ্গীতে জাতিসাম্যের প্রয়োজনে ‘বাঙালি’র বদলে ‘বাংলা’ আনলে সম্প্রদায়-সাম্যের স্বার্থে ‘পুণ্য হউক হে ভগবান’ পঙ্‌ক্তিতে ‘গড’, ‘আল্লা’ প্রভৃতি সংযুক্তির দাবি উঠবে না তো? আবার সর্বশক্তিমানে অবিশ্বাসী নাগরিক ঈশ্বর-সম্পর্কিত শব্দবন্ধেই আপত্তি জানাতে পারেন! একই ভাবে গানের সুরকাঠামো ‘কীর্তন’ই থাকবে কেন, তা নিয়ে প্রশ্নও ‘অস্বাভাবিক’ নয়!

রবীন্দ্রনাথের মতে, ভাষার প্রকাশ দুই শ্রেণির। “একটাতে প্রতিদিনের প্রয়োজন সিদ্ধ হতে হতে তা লুপ্ত হয়ে যায়... আর-একটাতে প্রকাশের পরিণাম তার নিজের মধ্যেই। সে দৈনিক আশুপ্রয়োজনের ক্ষুদ্র সীমায় নিঃশেষিত হতে হতে মিলিয়ে যায় না। সে শাল-তমালেরই মতো; তার কাছ থেকে দ্রুত ফসল ফলিয়ে নিয়ে তাকে বরখাস্ত করা হয় না!”

কবি জীবদ্দশায় কাকে কী অনুমতি দিয়েছেন বা দেননি, তা না ভেবে এবং কবির ভেবেচিন্তে লেখা শব্দকে ‘বরখাস্ত’ করে রাজনৈতিক ফসল ফলানোর চেষ্টা না করে নতুন গান বেঁধে নিলেই তো হয়! রাজ্যে সুযোগ্য গীতিকার-সুরকারেরা রয়েছেন। তাঁদের কারও উপর ভার দেওয়া হলে নিশ্চিত শ্রুতিসুন্দর সঙ্গীত পাওয়া যাবে।

নতুন গান পেলে শিল্পীদেরও আর ‘কাগজে যা ছিল গেয়েছি’ গোছের দুগ্ধপোষ্য যুক্তি দিতে হয় না!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement