Bibha Chowdhuri

তাঁর নামেই নক্ষত্রের নাম

১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিভা দেবী (ছবি)। বেথুন স্কুলেই তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। প্রগতিশীল পরিবারে বেড়ে ওঠা বিভা দেবী উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য এগিয়ে আসেন।

Advertisement

অজন্তা বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০২৩ ০৫:৫১
Share:

বিভা চৌধুরী। ফাইল চিত্র।

বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিংশ শতাব্দীর বাঙালি মেয়েদের অসামান্য অবদানের প্রসঙ্গ আলোচিত হলেই, সে ক্ষেত্রে গুরুত্ব পায় তৎকালীন মহিলা চিকিৎসকদের কথা। কিন্তু গুরুত্ব হারায় সে কালের মহিলা বিজ্ঞানীদের প্রসঙ্গ। তাঁদের অনন্য প্রতিভা, বিজ্ঞান সাধনা, সর্বোপরি বিজ্ঞাননির্ভর উল্লেখযোগ্য গবেষণা বিস্মৃতির আড়ালেই থেকে যায়। বিভা চৌধুরী এমনই এক বিংশ শতকীয় বিজ্ঞানমনস্ক বিস্মৃত বাঙালি নারী, যাঁর গবেষণা শুধুমাত্র বাংলাতেই নয়, প্রশংসিত হয়েছিল সমগ্র বিজ্ঞান বিশ্বে। দ্য ম্যানচেস্টার হেরাল্ড পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল বিভা দেবীর গবেষণা কর্ম এবং সাক্ষাৎকার। তবুও ভারতীয় এই মহিলা বিজ্ঞানী আজও অপরিচিত সাধারণের কাছে।

Advertisement

১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিভা দেবী (ছবি)। বেথুন স্কুলেই তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। প্রগতিশীল পরিবারে বেড়ে ওঠা বিভা দেবী উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য এগিয়ে আসেন। স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৩৪-৩৬ শিক্ষাবর্ষে একমাত্র মহিলা হিসেবে বিভা চৌধুরী পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রিটি অর্জন করেছিলেন। পরবর্তী কালে বসু বিজ্ঞান মন্দিরে দেবেন্দ্রমোহন বসুর তত্ত্বাবধানে গবেষণার কাজ শুরু করেছিলেন। গবেষণার স্বার্থে দার্জিলিং, সান্দাকফুর মতো পাহাড়ি স্থান বেছে নিয়েছিলেন তাঁরা। প্রথম বাঙালি মহিলা পদার্থবিদ হিসেবে মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে কাজ করেছিলেন বিভা দেবী। তাঁরাই প্রথম ফোটোগ্রাফিক ইমালশন প্লেট ব্যবহার করেছিলেন এই ধরনের গবেষণায়। তাঁদের মহাজাগতিক কণার ভর নির্ণয় সংক্রান্ত গবেষণাপত্র ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। গবেষণার কাজে তাঁরা হাফটোন ফোটোগ্রাফিক প্লেট ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের প্রয়োজন ছিল ফুলটোন ইমালশন প্লেট, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে সেই সময় পাওয়া সম্ভব হয়নি। ফুলটোন প্লেটের সাহায্যে প্রায় একই গবেষণা পদ্ধতি অনুসরণ করে নোবেল পুরস্কার পান সিসিল ফ্র্যাঙ্ক পাওয়েল, যদিও বিভা দেবী ও ডি এম বসুর ফোটোগ্রাফিক প্লেটেই প্রথম ধরা পড়েছিল পাই-মেসন বা পায়ন এবং মিউইয়ন নামক দু’টি কণা। দুর্ভাগ্যবশত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে দুই বাঙালি বিজ্ঞানী গবেষক নোবেল পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। পাই-মেসনের আবিষ্কর্তা হিসেবে বিভা চৌধুরী এবং ডি এম বসু পরিচিত হতে পারতেন, যদি তৎকালীন ইংরেজ সরকার ভারতীয়দের গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো প্রদানে কার্পণ্য না করত।

বিভা দেবী ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে পাড়ি দিয়েছিলেন সুদূর ম্যানচেস্টারে। সেখানে তিনি পিএমএস ব্ল্যাকেটের তত্ত্বাবধানে গবেষণার কাজ শুরু করেন। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে ‘এক্সটেনসিভ এয়ার শাওয়ারস অ্যাসোসিয়েটেড উইথ পেনিট্রেটিং পার্টিকলস’ শীর্ষক গবেষণাপত্র জমা দেন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে তিনি পিএইচ ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তৎকালীন সময়পর্বে এক জন মহিলা বিজ্ঞানী হিসেবে এইরূপ উল্লেখযোগ্য কাজ করার জন্য তিনি অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখেন। পিএইচ ডি লাভের পর তিনি আমেরিকার মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। পরবর্তী কালে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি-তে পদার্থবিদ ব্রুনো রসির পরীক্ষাগারেও কাজ করেছিলেন বিভা দেবী। দেশে ফিরে টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ-এ যোগদান করেন। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সম্মেলনেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। বিভা দেবী ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে আমদাবাদে ফিজ়িক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে গবেষণার কাজে যোগদান করেন। কলকাতায় ফিরে এসে তিনি সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজ়িক্স ও ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অব সায়েন্স-এ অতিথি গবেষক হিসেবে গবেষণা করেন।

Advertisement

গবেষণার কাজেই থাকতে চেয়েছিলেন বিভা দেবী সব সময়। একনিষ্ঠও ছিলেন নিজের কাজের প্রতি, কিন্তু বিজ্ঞানের আঙিনায় প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছিলেন বার বার। প্রথমে ডি এম বসু তাঁকে গবেষণার কাজে নিযুক্ত করতে চাননি। বিভা দেবী পরবর্তী কালে ডক্টরেট ডিগ্রি জমা দেওয়ার পরে প্যারিসে গবেষণার কাজে যেতে চেয়েও সাময়িক ভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। বিজ্ঞানী হিসেবে মহিলা পদার্থবিদের অপ্রতুলতা সম্পর্কে তাঁর চিন্তা ছিল, উদ্বেগও, যা তাঁর দ্য ম্যানচেস্টার হেরাল্ড পত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়। পারমাণবিক শক্তি সম্পর্কে মেয়েদের জ্ঞান বৃদ্ধির উপরও জোর দিয়েছিলেন।

খুব কম বাঙালিই জানি যে, প্যারিসের ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন এইচডি ৮৬০৮১ নক্ষত্রটির নামকরণ করেছে— বিভা, এই বাঙালি নারীর বিজ্ঞানের প্রতি অবদানকে কুর্নিশ জানিয়ে। কিন্তু সাধারণ বাঙালির কাছে আজও তিনি অপরিচিত। জীবিত থাকাকালীন তাঁকে এ-দেশীয় বিজ্ঞানের প্রাঙ্গণ যথাযথ সম্মান দিতে পারেনি। বিজ্ঞানের সাধিকা বিভা চৌধুরীর মৃত্যু ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে।

একনিষ্ঠ গবেষণার মধ্য দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকার কথা তাঁর। কিন্তু আমরা তাঁকে যথেষ্ট চিনি কি?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement