চা বাগানের অধিকাংশ শ্রমিক মেয়ে। ফাইল চিত্র।
নারী-শ্রমিকরা কেমন আছেন তাঁদের কর্মক্ষেত্রে? যৌন হেনস্থা থেকে নিরাপত্তা পাচ্ছেন কি তাঁরা? কর্মক্ষেত্রে নারী-কর্মীদের যৌন হেনস্থা নিবারণের আইন (২০১৩) চালু হয় দশ বছর আগে। আইনে বলা আছে, যে কোনও নারী-কর্মী— স্থায়ী, অস্থায়ী, ঠিকাকর্মী, শিক্ষানবিশ, এমনকি কর্মপ্রার্থীও— এই আইনের সুরক্ষা পাবেন। চটকল সংগঠিত ক্ষেত্রের এক বৃহৎ নিয়োগকারী। সেখানে বহু নারী-কর্মী কাজ করেন, ইদানীং তাঁদের সংখ্যা আরও বাড়ছে। অথচ, দু’টি অসরকারি সংগঠনের যৌথ সমীক্ষায় ছ’টি চটকল থেকে যে ছবি উঠে এসেছে, তা আশাজনক নয়।
আইন বলছে, কোনও সংস্থায় দশ জনের বেশি কর্মী থাকলেই সেখানে যৌন হেনস্থা প্রতিরোধের অভ্যন্তরীণ কমিটি তৈরি করতে হবে। এই চটকলগুলিতে— বস্তুত, পশ্চিমবঙ্গের কোনও চটকলেই— কমিটি তৈরি হয়নি। নারী-শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, যৌন হেনস্থা প্রতিরোধের জন্য অভ্যন্তরীণ কমিটি সম্পর্কে তাঁরা কিছুই জানেন না। কিছু দিন আগে চটকল ইউনিয়নগুলি একটি সম্মিলিত দাবিসনদে অন্য অনেক দাবির সঙ্গে অভ্যন্তরীণ কমিটি গঠনের আর্জিও জানিয়েছে চটকল মালিকদের কাছে, এই পর্যন্ত। চটকলগুলোতে রাতের শিফ্টে বহু মেয়ে কাজ করছেন, অথচ তাঁদের সুরক্ষার আইনি কাঠামো তৈরি হয়নি আজও।
চা বাগানের অধিকাংশ শ্রমিক মেয়ে। অথচ, চব্বিশটি বাগানে করা সমীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছে যে, ৭৮ শতাংশ নারী-শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা নিবারণের আইন, বা নিজের কর্মক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা রয়েছে, সে বিষয়ে জানেন না। অভ্যন্তরীণ কমিটি তৈরি হলেই যে যৌন হেনস্থার প্রতিকার হয়, এমন অবশ্যই নয়। তবে কমিটি গঠন করা হল আইনটি কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগের প্রথম পদক্ষেপ। নারী-কর্মীরা পুরুষ সুপারভাইজ়র বা সহকর্মীর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনলে এখন খাপ পঞ্চায়েত ধরনের সভা বসিয়ে মেয়েটিকেই দোষারোপ করা, তাঁকে ছাঁটাই করা বা বদলি করা হয়। অভ্যন্তরীণ কমিটি তৈরি করা হল এই চলতি ব্যবস্থাটাকে বন্ধ করার প্রথম ধাপ। চটকল বা চা বাগানে সেটুকুও হচ্ছে না।
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি লোকসভায় জানিয়েছেন, আইন অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ কমিটি গঠন এবং তার সদস্যদের নাম প্রকাশ্যে জানানো বাধ্যতামূলক। কোম্পানি (অ্যাকাউন্টস) রুলস ২০১৪ অনুযায়ী, প্রত্যেকটি সংস্থাকে বার্ষিক রিপোর্টে ‘বোর্ড অব ডিরেক্টরস’-কে জানাতে হবে যে, সেই সংস্থায় অভ্যন্তরীণ কমিটি গঠন করা হয়েছে। এমন সুস্পষ্ট আইন ও বিধি থাকা সত্ত্বেও কী করে বড় বড় বাণিজ্যিক সংস্থা বছরের পর বছর আইন ভাঙতে পারছে? এমন নয় যে, কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থার ঘটনা ঘটছে না। ক্রাইম ইন ইন্ডিয়া রিপোর্ট অনুসারে এই অপরাধের সংখ্যা ২০১৯ সালে ৫০৯, ২০২০-এ ৪৮৫, ২০২১-এ ৪১৮। মনে রাখা ভাল, নারী-কর্মীদের যৌন হয়রানির অতি সামান্য অংশই অভিযোগ হিসাবে দায়ের হয়।
পাশাপাশি দেখা চাই সরকারের ভূমিকা কী। আইনে বলা আছে, যে সব সংস্থায় ১০ জনের কম কর্মী থাকবেন, সেগুলিতে অভ্যন্তরীণ কমিটি তৈরি বাধ্যতামূলক না হলেও, সেগুলির নারী-কর্মীদের নিরাপত্তার জন্য প্রত্যেক জেলায় একটি স্থানীয় কমিটি থাকবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে গঠিত এই স্থানীয় কমিটির সভাপতি (চেয়ারপার্সন) হতে হবে মহিলা। অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত মহিলারা যাতে তাঁদের নিয়োগকর্তা (গৃহপরিচারিকার ক্ষেত্রে গৃহস্বামী), সহকর্মী, বা যে কোনও হেনস্থাকারীর থেকে সুরক্ষা পান, প্রতিকার পান, প্রধানত সেই জন্যই এই স্থানীয় কমিটিগুলি গঠনের কথা বলা হয়েছে আইনে। পশ্চিমবঙ্গে নারী ও শিশুকল্যাণ দফতর ২০১৫ সালে সব জেলাশাসককে চিঠি দিয়ে এই কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছিল। দেখা যাচ্ছে, খাতায়-কলমে কমিটি তৈরি যদি বা হয়ে থাকে, তার কার্যকারিতার কোনও সাক্ষ্য মিলছে না। নারী-শ্রমিকরা জানেন না তাঁদের জেলার স্থানীয় কমিটি কোথায়, কী করে অভিযোগ জানাতে হয়।
সারা দেশেই ছবিটি এই রকম। মহারাষ্ট্রের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তথ্যের অধিকার আইনে একটি আবেদন করে (২০১৮) জানতে পারে যে, দেশের ৬৫৫টি জেলার মধ্যে মাত্র ২৯ শতাংশে স্থানীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে, এর মধ্যে মাত্র ১৬ শতাংশের চেয়ারপার্সন মহিলা।
এই আইনটি কার্যকর করার দায়িত্ব রয়েছে নারী ও শিশুকল্যাণ দফতরের উপর। সমস্যা হল, বাণিজ্যিক ও শিল্প সংস্থা, কারখানা, শ্রমিক সংগঠন, এগুলির সঙ্গে ওই দফতরের কোনও সংযোগ নেই। শ্রম দফতরের সঙ্গে সমন্বয়ের কোনও পরিকাঠামোও তাঁরা তৈরি করেননি। ফলে নির্দেশ জারি করাই সার হচ্ছে, তার রূপায়ণের দায় কোনও সরকারি দফতরই গ্রহণ করছে না। কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা নিবারণের আইন দশ বছর পেরোলেও মেয়েরা নিরাপত্তাহীন।