এক কোটি আশি লক্ষ প্রবীণ মানুষ এই মুহূর্তে আমাদের দেশে গৃহহীন। প্রতীকী ছবি।
সীতা রাও বাড়ি ফিরলেন। তিনি হারিয়ে গিয়েছিলেন, এটা কোনও খবর নয়। আসল কথা তিনি বাড়ি ফিরলেন এবং বাড়ির লোকজন সাদরে তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন। এই নির্বিকার, বিবেকহীন, প্রেমহীন সময়েও এক বৃদ্ধা জীবনের শেষ আশ্রয়টুকু হারাতে হারাতেও হারালেন না। জানুয়ারি মাসে গঙ্গাসাগরের মেলায় এসেছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশের একদল মানুষ। ফেরার পথে তাঁদের বাস কলকাতায় থামে। অশীতিপর সীতা শৌচাগারে যাবেন বলে বাস থেকে নামেন এবং ফিরে এসে সেই বাস আর খুঁজে পাননি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তিনি আহত হন অন্য এক গাড়ির দ্বারা। তাঁর শরীর, মস্তিষ্ক সবই অসুস্থ হয়ে পড়ে। বেশ কিছু দিন পরে পথে তাঁকে পড়ে থাকতে দেখে লোকজন হাসপাতালে দেন। তাঁর চিকিৎসা হয়। কর্তব্যরত পুলিশ তাঁর অবোধ্য ভাষা এবং মানসিক অসুস্থতার কারণে কিছুতেই বৃদ্ধার বাড়ির ঠিকানা পাচ্ছিলেন না। শেষে হ্যাম রেডিয়োর দৌলতে জানা যায় তিনি অন্ধ্রপ্রদেশের বিজয়ওয়াড়ার বাসিন্দা। জানা যায়, তাঁর পরিবারের লোকও কয়েক বার এ শহরে ঘুরে গিয়েছেন বৃদ্ধার সন্ধানে। শেষে সীতার এই অকাল ‘বনবাস’ সমাপ্ত হল। বৃদ্ধার ছেলে এবং নাতি এসে তাঁকে নিয়ে গেলেন। নাতির ভাষায়, “ওঁকে যে বাড়ি নিয়ে যেতে পারছি, তাতেই স্বস্তি।”
স্বস্তি শুধু সীতা রাও-এর পরিবারের নয়, আমাদেরও। যে সমকাল পরিবার বৃক্ষের শুকিয়ে যাওয়া পাতাগুলিকে পারলে হিংস্র হাতে ছিঁড়ে ফেলে, প্রকৃতির নিয়মে শান্ত অবকাশে যোগ্য মর্যাদায় তাদের ঝরে যাওয়ার সুযোগটুকু পর্যন্ত দেয় না, সেই সময়ের নৌকায় চেপেই ভিনরাজ্য থেকে পরিজন এসে এক তথাকথিত বাতিল বৃদ্ধাকে ভালবেসে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যান। প্রমাণ হয়, ‘মনুষ্যত্ব’ এখনও মরতে মরতেও মরেনি। নদী-সাগরের মিলন স্থলে মকর সংক্রান্তির মেলা উপলক্ষে প্রত্যেক বছর লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রী আসেন। এ বারও নাকি ত্রিশ লক্ষের বেশি মানুষ এসেছিলেন। তাঁরা যখন চলে যান, ফেলে যান অসংখ্য অপ্রয়োজনীয় বস্তু৷ ফুরানো মুড়ির ঠোঙা, চিপসের ছেঁড়া প্যাকেট, ঝরে পড়ে যাওয়া ফুলপাতার সঙ্গে এক আধজন মানুষও থেকে যাওয়া অসম্ভব নয়। ক’জনই বা উতলা হয়ে দীর্ঘ সন্ধান চালান তাঁদের জন্য, যদি তাঁরা সংসারের মাঠ থেকে সরে গিয়ে গ্যালারিতে বসে যাওয়া মানুষ হন? রেলস্টেশন, বাস ডিপো, কর্মব্যস্ত শহর— দুর্বল, বয়স জর্জর বৃদ্ধ-বৃদ্ধার জন্য কারই বা দাঁড়ানোর সময় আছে? গঙ্গাসাগর, প্রয়াগ, সোনারপুর স্টেশন অথবা দিল্লির বাস আড্ডা— পরিবার পরিত্যক্ত প্রবীণ মানুষের তো অভাব নেই এই দেশে!
বৃদ্ধার বাড়ি ফেরার কাহিনি তাই বিশেষ ভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। ২০৫০ সালের মধ্যে এই দেশের নাগরিক জীবনের উনিশ শতাংশ প্রবীণ মানুষজন দখল করবেন। এক সময় তাঁরা আমাদের মাথার উপর ভরসার আকাশ মেলে ধরেছিলেন। আজ তাঁদেরও একটা আকাশ চাই। আমরা কি তা দিচ্ছি তাঁদের? এক কোটি আশি লক্ষ প্রবীণ মানুষ এই মুহূর্তে আমাদের দেশে গৃহহীন। কেউ কি তাঁদের ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন? তাঁরা তো শুধু ঘর হারাননি; হারিয়েছেন সম্পর্ক, হারিয়েছেন সাহচর্য, সাহস, সম্বল। এঁদের মাথার উপরে নিজের কোনও ছাদ নেই। আবার যাঁদের ছাদ আছে, তাঁদের কাছে নেই নিজের মানুষ। কাজেই এঁদের নদীগুলো কিছুতেই সাগরের সঙ্গে মিশতে পারছে না। এই মুহূর্তে কেরলের এক হাসপাতালের মাটিতে ভাঁজ করা প্যাকিং বাক্সের উপর পড়ে আছেন ছ’জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা যাঁদের আর কেউ নিতে আসবে না বাড়ি থেকে। শুধু মহারাষ্ট্রেই গত পাঁচ বছরে ছ’হাজারের উপর প্রবীণ মানুষকে হাসপাতালে ফেলে পালিয়েছে বাড়ির লোক। কলকাতার মানসিক হাসপাতালে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত বৃদ্ধ বাবাকে রাখতে এসেছেন চাকরিরত ছেলে-বৌ। ডাক্তার অরাজি হলে তাঁকে কোর্টের অর্ডার ধরাচ্ছেন। শেষে বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে বৃদ্ধ পৃথিবীর পাট চুকিয়ে দিচ্ছেন। ভারতের স্বীকৃত বৃদ্ধাশ্রমগুলির প্রায় অর্ধেক বাধ্য হচ্ছে বিনা পয়সায় প্রবীণদের আশ্রয় দিতে, কারণ তাঁদের হয়ে বিল মেটানোর কেউ নেই। এই মুহূর্তে বৃন্দাবনে পরাশ্রয়ে, ভিক্ষান্নে দিন কাটাচ্ছেন পনেরো হাজারের মতো বৈধব্য পীড়িত সংসারের ‘উচ্ছিষ্ট’ হয়ে যাওয়া নারী। সেই পরিকীর্ণ নিষ্প্রাণ ক্যানভাসে সীতার আত্মীয়রা একটি প্রাণের ছবি আঁকলেন।
গুরুগ্রামের এক বৃদ্ধাশ্রমের কর্মী গল্প শোনাচ্ছিলেন এক জন বৃদ্ধের। তিনি মারা যাওয়ার পর দেহে পচন শুরু হওয়া পর্যন্ত বারংবার ফোন করেছিলেন ছেলেকে। ফোটোগ্রাফার ছেলে জানিয়ে দেন, কোম্পানির ক্ষতি করে তিনি কিছুতেই আসতে পারবেন না। বৃদ্ধাশ্রমকেই নির্দেশ দেন বাবার দেহ সৎকার করে দিতে। আমাদের আদরের ‘সভ্যতা’র বুকে সে-দিন যে সঙ্কটের ঝড় উঠেছিল, তেমনই এক ঝড়ে সাগর ফেরত তীর্থযাত্রীরা মায়ের বুক থেকে বালক রাখালকে ‘ছিঁড়ি কাড়ি’ জলে ছুড়ে ফেলেছিলেন ‘দেবতার গ্রাস’-এ। আমাদের রবি ঠাকুর বোধ হয় সে-দিন বুঝতে পারেননি, ভোগবাদের ঝড় এক দিন রাখালের হাত দিয়ে তার মা মোক্ষদাকেও জলে ঠেলে ফেলবে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা অথবা আসতে বাধ্য হওয়া প্রবীণদের কোনও পথ আর বাড়ির দিকে ফিরে যায় না। তাই ঘরে ফেরার গল্পটা অবশ্যই আজ আমাদের সকলের পড়া দরকার।