কলকাতা থেকে যেতে দু’ঘণ্টা। আসতে দু’ঘণ্টা। গাড়িতে। জায়গাটা প্রায় গ্রাম। সেখানে এক বইমেলা। ছোট্ট মাঠ ঘিরে কয়েকটি মাত্র বইয়ের স্টল। সেই বইমেলারই উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বসে আছি মঞ্চে, আরও কয়েক জন অতিথির সঙ্গে। এক অতিথি মাইকে কথা বলতে শুরু করেছেন সবেমাত্র। হঠাৎ ভাষণের মাঝপথে তিনি চুপ করে গেলেন। আমি অবাক। কিছু বুঝতে পারছি না। বক্তাও চুপ করেই দাঁড়িয়ে আছেন। আয়োজকদের এক জন আমাদের কাছে এসে খুব নিচু গলায় বললেন: “এখন আজান শুরু হয়েছে। বইমেলার বাইরেও তো মাইক আছে। যেন আজানের সময় মাইকের আওয়াজে বিঘ্ন না ঘটে, তাই বক্তাকে একটু নীরব থাকতে বলা হয়েছে।” এ বার খেয়াল করলাম, সত্যিই তো, আজানের সুর তো ভেসে আসছে! এ গ্রামে প্রবেশ করার সময় একটি ছোট মসজিদ পার হয়েছিলাম বটে। একটু পরেই আজান শেষ হল। বক্তা আবার তাঁর কথা শুরু করলেন।
এই হল আমাদের আসল বাংলা। আজান দেওয়া হচ্ছে মসজিদে, তাকে সম্মান জানিয়ে বক্তৃতারত ব্যক্তিকে নীরব থাকতে বলা হল। এই যে পারস্পরিক সম্মানদানের প্রথা বা ইচ্ছা, একে যাঁরা তোষণ বলেন, তাঁরা অনেকটাই বোঝেন না। আসগর আলি মণ্ডলরা, শফিকুল আলমরা এখনও বিজয়া করতে আসেন আমাদের বাড়ি। আমরা ইদের সময় তাঁদের বাড়ি ফিরনি খেতে যাই। সেই সম্প্রীতির মধ্যে বিষ মেশানোর চেষ্টা চলছে এখন।
দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলায় এসে এক আদিবাসী পরিবারে আহার করতে বসলেন। সেই ছবি ছাপা হল সংবাদপত্রে। কিন্তু আমরা ভুলে যাচ্ছি না তো যে, এই ‘আদিবাসী-দরদি’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মিছিল থেকেই ছিটকে বেরিয়ে কয়েক জন যুবক বিদ্যাসাগরের মূর্তি খণ্ড খণ্ড করে দিয়েছিল? অভিনেত্রী দেবলীনা দত্ত তাঁর খাদ্যরুচির কথা প্রকাশ করেছিলেন বলে দেবলীনার বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয় এবং গণ-ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয় তাঁকে। আমরা পুরুষ, আমরা বুঝব না, গণ-ধর্ষণের হুমকির সামনে পড়লে এক জন নারী কতখানি অপমানবোধ করেন। বিজেপি নেতা তরুণজ্যোতি তিওয়ারি বলেছেন: “বাক্-স্বাধীনতার নামে দেবলীনা যা খুশি তা-ই বলতে পারেন না।” অর্থাৎ, এ বার আমাদের কথা বলার ইচ্ছেকেও বিজেপি দ্বারা পরিচালিত হতে হবে। তা-ও কী নিয়ে কথা? রাজনীতি নিয়ে নয়, নিজেদের পছন্দ-অপছন্দ, খাদ্যরুচি নিয়ে।
আরও একটি সাঙ্ঘাতিক ঘটনা আমরা চোখের সামনে দেখলাম এই কথা বলার অধিকার বিষয়ে। দেশনায়ক সুভাষচন্দ্রের ১২৪তম জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যখন ভাষণ শুরু করলেন, তখন শ্রোতাদের একাংশ ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিতে আরম্ভ করল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এই ভাবে বাধা পেয়ে, নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলেন। তাঁর বক্তব্য পেশ করলেন না। তবে সভাস্থল পরিত্যাগও করলেন না, হয়তো সেই সভা দেশনায়ক সুভাষচন্দ্রকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানানোর সভা বলেই। একে সুবিবেচনার পরিচয়ই বলতে হবে, সংযমেরও। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যখন তাঁর ভাষণ দিলেন, তখন এক বারের জন্যেও তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে বাধাদানের নিন্দা করলেন না। এ-বিষয়ে নীরব থাকলেন। এটা কি সুবিবেচনা হল? তাঁর এই নীরবতা কি ওই বাধাদানকে এক প্রকার সমর্থন জানানো নয়? কেউ কেউ বলেছেন, ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে স্বাগত জানানো হচ্ছিল— এই সময় মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতা বন্ধ করে দেন। তা হলে প্রশ্ন, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের সময় তাঁকে স্বাগত জানিয়ে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি উঠল না কেন?
প্রধানমন্ত্রী মানে কিন্তু সমস্ত েদশের দায়িত্ব তাঁর হাতে। সেই ভারতের এক মুখ্যমন্ত্রীর অপমান ঘটল তাঁর সামনে, দেখেও তিনি চুপ করে থাকলেন। এর মানে কী? এর মানে স্পষ্ট— তিনি আর তখন প্রধানমন্ত্রী রইলেন না। তিনি কেবল এক জন বিজেপি নেতা হয়ে গেলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে গেলে যে উদারতা থাকা দরকার, তা এক জন বিজেপি নেতার কাছে আশা করা যায় না নিশ্চয়ই।
আমরা ভুলে যাব না যে, উনিশ বছর আগে এই নেতা যখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন সেখানে কী প্রকারের নরমেধযজ্ঞ ও অবর্ণনীয় ধর্ষণ-নির্যাতন সংগঠিত হয়েছিল। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর পুলিশ পুতুলের মতো দাঁড়িয়েছিল। তাঁর শাসনেই এমন ঘটনা ঘটেছিল, এই দেশেরই এক রাজ্যে।
সেই নেতা আজ যদি রবীন্দ্রনাথের মতো পোশাক পরে, সাদা লম্বা চুল দাড়ি রেখে, হাতে মোটা বই নিয়ে মিডিয়ার সামনে ছবি তোলান, কী ভাবব আমরা? ও-দিকে কিন্তু তাঁর শাসিত দেশেই দিশা রবি-র মতো এক একুশ বছরের তরুণী একটি টুলকিট শেয়ার করার জন্য গ্রেফতার হয়ে হাজতবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন। দিল্লিতে মাসের পর মাস কৃষকরা শান্তিপূর্ণ অবস্থানের আন্দোলন করছেন এবং একের পর এক কৃষক মারা যাচ্ছেন— এই বিষয়ে মেয়েটি সরকারের মতের বিরুদ্ধে নিজের বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করেন বলে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। জামিন তিনি পান। কিন্তু সমচরিত্রের ‘অপরাধ’-এ এখনও অনেক সাংবাদিক, সমাজকর্মী জেলে অবরুদ্ধ। ভারতবর্ষ এ কাদের হাতে পড়ল?
এই রাজ্যের কথা যদি ভাবি, বলা যাবে না যে এখানে কোনও সমস্যা নেই। সমস্যা অনেক, কিন্তু গত দশ বছরে রাজ্যের প্রশাসক হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে অনেক কাজ করেছেন, এও স্বীকার করতেই হবে। তাঁর উদ্যোগেই ‘কন্যাশ্রী’, ছাত্রছাত্রীদের সাইকেল দেওয়া, প্রথমে অতি অল্প দামে এবং পরে বিনামূল্যে চাল দেওয়া, ‘দুয়ারে সরকার’, ‘স্বাস্থ্যসাথী’। স্বাস্থ্যব্যবস্থায় নিশ্চয়ই এখনও হাজারো সমস্যা, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী পদে এসেই দশ বছর আগে তিনি হাসপাতালগুলিতে নিজে উপস্থিত হয়ে, সেগুলি পরিদর্শন করে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করেছিলেন, ভোলা যাবে না। বেসরকারি হাসপাতালগুলির কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিদের ডেকে বৈঠক করে সতর্কবার্তা দিয়েছেন, তাঁরা যেন সামান্য চিকিৎসায় রোগীদের কাছে অতিরিক্ত অর্থ দাবি না করেন। আনাজের মূল্যবৃদ্ধি ঘটলে নিজে চলে যাচ্ছেন বাজার পরিদর্শন করতে, এমন মুখ্যমন্ত্রী ভারতে আজও কম। কোথাও ব্রিজ ভেঙে পড়লে দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে উদ্ধারকার্য তদারক করছেন। আমপানের সময় কোমর বেঁধে নিজে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন, করোনা-সঙ্কটে সবাই যখন ঘরে, তিনি রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে মানুষকে সতর্ক করেছেন। পথে নেমে কাজ করার এমন ক্ষমতা আজ এই দেশে খুব কম নেতারই আছে।
উল্টো দিকে, বাংলার মনীষীদের ‘সম্মান’ জানাতে উঠেপড়ে লেগেছেন কিছু নেতা। কিন্তু মুশকিল হল, তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন, মুখোশটা কিন্তু মুখোশই, মুখোশের তলায় যে মুখ, সেটা আজও মানুষ দেখতে পায়।