foreign relations

কূটনীতির মঞ্চে অবতীর্ণ চিন

শিয়া ইরান এবং সুন্নি সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্কের তিক্ততা বহু দিনের। দু’দেশই আরব দুনিয়ার নেতা হওয়ার জন্য নিজেদের মধ্যে রেষারেষি করে চলেছে।

Advertisement

প্রণয় শর্মা

শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০২৩ ০৬:১৭
Share:

সূচনা: ইরান, চিন ও সৌদি আরবের বিদেশমন্ত্রী। বেজিং, ৬ এপ্রিল। ছবি: পিটিআই।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চিন তার প্রভাব বাড়াচ্ছে দীর্ঘ দিন। তবে কোনও দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে চিনারা বিশেষ নাক গলাত না। বরং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক স্তরে— প্রধানত বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে— সম্পর্ক গড়ে তুলতেই বেশি সক্রিয় ছিল চিন। এ বার মোড় ঘুরল। এই মার্চে সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যে শান্তির সম্পর্ক স্থাপনে মধ্যস্থতা করে চিন আন্তর্জাতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল।

Advertisement

শিয়া ইরান এবং সুন্নি সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্কের তিক্ততা বহু দিনের। দু’দেশই আরব দুনিয়ার নেতা হওয়ার জন্য নিজেদের মধ্যে রেষারেষি করে চলেছে। তার উপর ইরানের পরমাণু শক্তি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা সৌদি এবং উপসাগরীয় এলাকায় আমেরিকার ঘনিষ্ঠতম মিত্র দেশ ইজ়রায়েলের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠছিল। এর মধ্যে ২০১৬ সালে সৌদি প্রশাসন সে দেশের বিশিষ্ট শিয়া ধর্মীয় নেতা নিমর আল-নিমরকে প্রাণদণ্ড দেওয়ার পরে দু’দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়। তাদের সম্পর্ক আরও তিক্ত হয় যখন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি বাতিল করে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এত দিন পরে চিনের মধ্যস্থতায় আবার সেই সম্পর্ক জোড়া লাগতে চলেছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই দু’দেশের বন্ধ থাকা দূতাবাস আবার খুলবে, তার ইঙ্গিত মিলেছে।

ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান এবং সোভিয়েট ইউনিয়নের ভাঙনের পরে আরব দুনিয়ায় আমেরিকাই ছিল সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী। সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে শান্তির সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় আমেরিকাও সক্রিয় হয়েছিল। আমেরিকার লক্ষ্য ছিল ইরানকে পরমাণু অস্ত্র তৈরির উদ্যোগ থেকে নিরস্ত রাখা, এবং উপসাগরীয় অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনা। একই সঙ্গে তারা সৌদি আরব ও ইজ়রায়েলের মধ্যে একটা বোঝাপড়া করে ইরানের বিরুদ্ধে প্রায় সব আরব রাষ্ট্রকে এক জোট করার চেষ্টাও চালাচ্ছিল। কিন্তু দেখা গেল, চিন আমেরিকাকে টেক্কা দিল।

Advertisement

চিনের এই কূটনৈতিক সাফল্যের জের কত দূর গড়াবে, এখনই বলা কঠিন। তবে ইতিমধ্যেই সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং কুয়েত ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে ইরানের বিচ্ছিন্ন অবস্থা কাটার ইঙ্গিত দিয়েছে। অন্য আরব দেশগুলিও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে পারে। এক কথায়, এই শান্তিচুক্তি ইরানকে আরব দুনিয়ার কাছে অনেকটাই বৈধ ও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারে। সম্প্রতি ইরান ও সৌদির বিদেশমন্ত্রীরা বেজিংয়ে নিজেদের মধ্যে বৈঠকও করলেন।

অন্য দিকে, এই চুক্তির জেরে ইয়েমেনের যুদ্ধ বন্ধ হতে পারে। সেখানকার হউদি আন্দোলনের লোকজন ইরানের পরোক্ষ মদতে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে এই আক্রমণ চালাচ্ছে। ২০১৯ সালে ইয়েমেনিদের ক্ষেপণাস্ত্র সৌদির তৈল শোধনাগারে আছড়ে পড়েছিল। সৌদি ইয়েমেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমেরিকার মদত চায়, কিন্তু আমেরিকা অস্বীকার করে। এর ফলে সৌদি কিছুটা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। তাই ইরানের সঙ্গে বোঝাপড়ায় ইয়েমেনের যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে সৌদিরও স্বার্থ রয়েছে। তাতে সৌদি আরবের তেলের খনি ও শোধনাগারগুলিতে ক্ষেপণাস্ত্র হানা বন্ধ হতে পারে, আর ইয়েমেনে ব্যয়বহুল যুদ্ধ থেকেও তারা বেরিয়ে আসতে পারবে।

এই চুক্তি কার্যকর হলে আমেরিকা এবং পশ্চিমি দুনিয়া নতুন করে ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে শান্তিপূর্ণ লক্ষ্যে বেঁধে রাখার বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করতে পারে তেহরানের সঙ্গে। যদি তা সফল হয়, তা হলে ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকার কঠোর নিষেধাজ্ঞা— চার দশক ধরে যা বলবৎ রয়েছে— শিথিল হতে পারে। ইরানের অর্থনীতি চাঙ্গা করতে চিন ইতিমধ্যেই সে দেশে চল্লিশ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। সেই সঙ্গে ২৫ বছরের জ্বালানি চুক্তি করার কথা বলেছে, যা ইরানকে কিছুটা হাঁপ ছাড়ার সুযোগ এনে দিয়েছে। সৌদি আরবকেও বঞ্চিত করেনি চিন। সৌদি আরবের তেলের সবচেয়ে বড় গ্রাহক চিনই। তারা জানিয়ে দিয়েছে, সৌদির অসামরিক পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যেতে সব রকম সাহায্য করবে চিন।

পশ্চিম এশিয়ায় চিন এখন যথেষ্ট জনপ্রিয়। গত বছর প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যখন সৌদি আরব সফর করেন, তখন তাঁকে বিপুল অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল। চিনা প্রেসিডেন্ট সৌদি, উপসাগরীয় রাষ্ট্রসমূহ এবং আরব লিগের সঙ্গে তিন তিনটি শীর্ষস্তরের বৈঠক করেন। যদিও আমেরিকার প্রভাব এখনও আরব দুনিয়ায় সবচয়ে বেশি, তবু ইরান এবং সৌদি আরব, দুই দেশেরই আস্থাভাজন হওয়ায় এই মুহূর্তে আরব দুনিয়ায় চিনের গ্রহণযোগ্যতাও কিছু কম নয়। আমেরিকার ঘনিষ্ঠ বলয়ে দীর্ঘ দিন ধরে থাকা সত্ত্বেও সৌদি আরব যে ভাবে চিনের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করল, তাতে স্পষ্ট যে, আরব দুনিয়ার দেশগুলি আর আগের মতো কেবল আমেরিকার অঙ্গুলিহেলনে চলতে রাজি নয়। নিরাপত্তার প্রশ্নে তারা আমেরিকার সঙ্গে পা মিলিয়ে চললেও, দেশের স্বার্থরক্ষার প্রয়োজনে চিন বা আঞ্চলিক কোনও শক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে পিছপা হবে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement