সকলে মিলে ছোটদের মারছি, নানা ভাবে, বুঝতে পারছি তো?
Education system

শিক্ষাপ্রহসন ও গিনিপিগেরা

আমাদের মফস্‌সলের স্কুলে দিদিমণিরা, কোথাও বা মাস্টারমশায়েরা যত্ন করে পড়াতেন, আঁকাতেন, সাড়ে চার বছর বয়সে মা-বাবাকে শুনতে হয়নি মেয়ে কেন যোগ-বিয়োগ করতে পারে না।

Advertisement

ঈশানী দত্ত রায়

শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০২৩ ০৪:২৯
Share:

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

গোড়াতেই বলে নেওয়া ভাল, এই সময়ে জন্মালে লেখাপড়া শেখা আর হয়ে উঠত না। প্রথমত পরিবারের ক্যাপিটেশন ফি বা মোটা মাইনে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। দ্বিতীয়ত সাড়ে চার বছর বয়সে আমার বুদ্ধির দৌড়। শুনেছি, ছোট আর বড় হাতের ইংরেজি অক্ষর লেখা শেখাতে গিয়ে মাতৃদেবীর চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে গিয়েছিল আক্ষরিক অর্থেই। আমাদের মফস্‌সলে তখনকার সবচেয়ে নামী ও বাংলা মাধ্যম স্কুলে ভর্তির পরীক্ষায় নিয়ে যাওয়ার সময়ে আমাকে সাদা রঙের ফ্রক পরানো হয়েছিল, যাতে রং না গুলিয়ে ফেলি। যা-ই হোক, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। আমাদের প্রজন্মের (এখন যাঁরা মধ্য পঞ্চাশ পেরিয়েছেন) কমবেশি অনেকেরই অভিজ্ঞতা এমন ছিল। কিন্তু সময় নিজের নিয়মেই বদলায়, আর তা যে বদলাচ্ছে তা বুঝতে পারি, যখন কলেজে যেতে গিয়ে ট্রামে শুনলাম, মায়েরা বলছেন, “কাল আমাদের ক্লাসে এটা পড়িয়েছে, তোমাদের কী পড়িয়েছে।” সন্তানদের লেখাপড়া ৮০-র দশকের মাঝামাঝি থেকেই মা-বাবাদের হতে শুরু করেছে। তবে হেয়ার, হিন্দু স্কুলের নাম ডাক তখনও ছিল।

Advertisement

আমাদের মফস্‌সলের স্কুলে দিদিমণিরা, কোথাও বা মাস্টারমশায়েরা যত্ন করে পড়াতেন, আঁকাতেন, সাড়ে চার বছর বয়সে মা-বাবাকে শুনতে হয়নি মেয়ে কেন যোগ-বিয়োগ করতে পারে না। দুষ্টুমি করলে পিটুনি ছিল, বক্রোক্তি ছিল, কিন্তু মেধাবী দিদির ছায়ায় বা তুলনায় বোন কষ্ট পাচ্ছে দেখে দিদিমণির বলার সৎসাহস এবং হৃদয় ছিল যে, তিনি আর কোনও দিন কারও সঙ্গে কারও তুলনা করবেন না। কিন্তু এখন প্রি স্কুলেই শুনতে হয় আপনার বাচ্চা ম্যাথস-এ কাঁচা। প্রশ্ন হল, বাড়িতেই যদি সব শিখিয়ে পড়িয়ে দিতে পারতেন, তা হলে মা-বাবা টাকা খরচ করে স্কুলে পাঠাবেন কেন? কী শেখাতে?

প্রশ্ন করতেই পারেন, এখন কি নিষ্ঠা নেই, হৃদয় নেই, দায়বদ্ধতা নেই? অবশ্যই রয়েছে। তা না হলে আর দুনিয়াটা চলছে কী করে? কেন ভিডিয়োয় দেখে মুগ্ধ হচ্ছি, কী ভাবে বাংলা আর ইংরেজি ব্যাকরণ শেখাচ্ছেন মাস্টারমশাই, দিদিমণিরা, গ্রামের স্কুলে। প্রাণ ভরিয়ে, তৃষা হরিয়ে-র সঙ্গে প্রাণ ভরে নাচছে এক বালক আর তা মুগ্ধ হয়ে দেখছে, তার ছেলে-মেয়ে সহপাঠীরা। কেউ কিন্তু হাসছে না, কেন একটা ছেলে নাচছে বলে। এ কী কম বড় শিক্ষা!

Advertisement

কিন্তু তার বাইরে আরও একটা জগৎ রয়েছে, যেখানে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে প্রি-স্কুলে পাঠিয়েও শুনতে হয়, আপনার সন্তান এখনও কেন অ্যাডিশন মানে যোগফল পারে না, ওই বাচ্চা শান্ত, আপনার বাচ্চা কেন এত দুরন্ত। আর মা-বাবা তুলনা করতেই থাকেন অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে। প্রশ্ন করুন, উত্তর আসবে, এখন প্রতিযোগিতার যুগ, তোমাদের মতো হলে আর করে খেতে হবে না। এই পত্রিকাতেই চন্দ্রযান, সূর্যযানের সঙ্গে যুক্ত সফল বিজ্ঞানীদের যে তালিকা বেরিয়েছিল, তাঁরা কোন স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন? দেখে নেবেন দয়া করে।

দোষ কারও একার নয়। প্রাথমিক শ্রেণিতে ইংরেজি পড়ানো হবে না এই সিদ্ধান্ত নিয়ে একটা প্রজন্ম শেষ করে দেওয়া হল। আর এখন তিলে তিলে শেষ করে দেওয়া হচ্ছে একটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে, যেখানে এক জন উচ্চ মাধ্যমিক পাশ নির্ভুল ভাষায় দু’পাতা লিখতে পারবে না। যে সব স্কুলের নাম শুনে বড় হয়েছি, সেখানে সন্তানদের পাঠাতে আমাদের প্রজন্মই নাক সিঁটকিয়েছে, কেন? উত্তরটা সরকারকে দিতে হবে। উত্তরটা রাজনৈতিক শাসক দলদের দিতে হবে এবং অবশ্যই আমাদের দিতে হবে, যারা বছরের পর বছর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কামু-কাফকা কপচিয়ে স্রেফ চোখ বন্ধ করে রেখেছি।

ছোটবেলায় পড়েছিলাম, টম ব্রাউনস স্কুল ডেজ়— সেখানে দুরন্ত টমকে বহিষ্কার থেকে বাঁচাতে নরম-সরম একটি ছেলেকে ভর্তি করিয়েছিলেন প্রিন্সিপাল, যাতে টমের দায়িত্ববোধ জন্মায় দুর্বলকে রক্ষা করতে গিয়ে। এখন, ‘বাবা, আমার ছেলেটাকে দেখে রাখিস’ বললে পরে জানতে হয়, ছেলেটার শরীরে বা মনে প্রথম মারটা তার হাত থেকেই এসেছিল। প্রি-স্কুল থেকে অভিযোগ আসে, বাচ্চা কেন এত দুরন্ত। বাচ্চাকে কিছু শিখিয়ে আনেননি? তা হলে স্কুলে আপনি কী শিক্ষা দিচ্ছেন বা দেবেন? কেনই বা স্কুলে পাঠানো হচ্ছে? উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পড়ুয়ারা ভয়ের চোটে নাম না দিয়ে খোলা চিঠি পাঠায় সংবাদমাধ্যমকে যে, কমিটি থাকা সত্ত্বেও অধ্যাপকেরা ছাত্রের সমস্যাই শোনেন না, বলে দেন, সময় নেই, নিজেরটা নিজে বুঝে নাও।

কেন এখনও এক জন একাকী মাকে কুঁকড়ে থাকতে হয়, স্কুলে শিশুকে ভর্তি করানোর লাইনে দাঁড়াতে, কারণ তিনি একক মা। চিঠি লিখতে হয়, কেন তিনি একা এসেছেন ইন্টারভিউয়ে। কেন লিখতে হবে? দেশের আইন কী বলে, স্কুলের বিধি কী বলে? দেশের আইন, স্কুলের বিধি একক মাকে স্বীকৃতি দেয়, স্কুলে ভর্তিতে মাকে স্বীকৃতি দেয়, কিন্তু স্কুল মানে? মানবে? নামী স্কুল, দামি স্কুল কোথায় কবে কী বিধি হয়েছিল, কেউ নেড়েও দেখবে না। এক নামী চিত্রশিল্পী এক বার শুনিয়েছিলেন তাঁর লড়াইয়ের কথা, এই কলকাতা শহরে, তাঁর সন্তানকে ভর্তি করানোর জন্য। কেন স্কুলের বাচ্চারা এত হিংস্র? কেন বাবা নেই বলে, কেন গায়ের রং কালো বলে, উত্ত্যক্ত করা হবে শিশুকে? বাবার নাম নিয়ে হাসাহাসি করবে? বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়েছে বলে কেন হাসবে সহপাঠীরাই? কে শেখাল?

দোষ আমাদের সকলের। তাই ঠিক শিক্ষা দিতে পারব না, দেওয়ার চেষ্টাও করব না, গুচ্ছের পুরস্কার দেব নইলে চড়িয়ে লাল করব, ভাগ করে খেতে, খেলতে শেখাব না, পাড়া প্রতিবেশী দূরস্থান আত্মীয়ের পাশে দাঁড়াতে শেখাব না। এমন একটা পৃথিবী গড়ে তুলেছি আমরা সকলে মিলে, যেখানে থেরাপিস্টের কাছে যাওয়াই দস্তুর হয়ে উঠেছে। কাগজের প্লেন ওড়াতেন তো ছোটবেলায়? এখন রিভলভারের ট্রিগার টিপতে হবে, উপরে বসানো প্লেন উড়ে যাবে সামনে। মাঠে খেলতেন? এখন মাঠ ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, হয় প্রোমোটারকে নয় রাজনৈতিক দলকে। খেলার জায়গা নেই, জায়গা থাকলেও সুযোগ নেই, পড়তে যেতে হবে।

এতটা জায়গা খরচ করে নতুন কিছু কি বলা গেল? হয়তো নয়। কিন্তু ওই যে শিশু স্কুলের একেবারে নিম্ন শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারল না বলে বেধড়ক মার খেল, পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়েই প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য হল, ভুল উত্তর দিয়েছে বলে সকলের সামনে লাঞ্ছিত হল, তার কী হবে?

অস্বীকার করার উপায় নেই, দুনিয়াটা দিন দিন প্রতিযোগিতার হয়ে উঠেছে। ভাল চাকরি তো বটেই, যে কোনও চাকরিরই একান্ত অভাব। ঘাস কাটার চাকরির জন্য উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্তরা লাইন দিচ্ছেন, এ দৃশ্য তো দুর্লভ নয়। বি এ চাওয়ালা, এম এ চাওয়ালা শুধুই ‘ইন থিং’ নয়। চপ ভাজা, ম্যাগির দোকান করাটাই শিল্প। উচ্চশিক্ষায় সরকারি টাকা নেই, গবেষণায় অর্থ বন্ধ। কিন্তু সরকারি স্কুল ধ্বংস করে বেসরকারি দামি স্কুলকে ফুলেফেঁপে দেওয়ার চেষ্টা আঠারো আনা। কোথাও স্কুল থাকবেই না, কোথাও থাকলেও যাওয়ার অর্থই নেই, ফলে কিছু বিশেষ স্কুলে লাইন বাড়বে, কিছু স্কুলে ভর্তি হতে না পারলে জীবন সার্থক হবে না।

তাই ‘কোটা-ফ্যাক্টরি’তে পড়ুয়া কেন গলায় দড়ি দিল, তা নিয়ে ওটিটি সিরিজ় হবে, থ্রি ইডিয়টস-এ আদতে গুণগান হবে সাফল্যের,— ‘ওই যে আমার ছেলে পড়ে না, কিন্তু ফার্স্ট হয়’। ওই রকম আর কী।

আসলে আমরা সকলে বাচ্চাগুলোকে মারছি, বিভিন্ন বয়সে, বিভিন্ন ভাবে। পড়াশোনা শিখতে হবে, চাকরি পেতে হবে, মানুষ হতে হবে, সব ঠিক। কিন্তু কী ভাবে হবে? ওই যে দেখুন, খাঁচায় খাঁচায় ছোট্ট গিনিপিগগুলো বসে আছে, খাচ্ছে। পড়ছে। মরবে বলে।

আবার বলছি মরবে বলে। ভেবেচিন্তে বলছি কথাটা। নইলে একটি প্রি-স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে কেন এক জন যুবক বাবা বলেছিল, “ছেলেটাকে যখন স্কুল থেকে আনতে যাই, মনে হয় অক্ষত বেরোলেই হল।” পেনসিল চোখে ঢুকিয়ে দেওয়া, পেটে লাথি, বিস্মিত হবেন না। এই কলকাতা শহরের স্কুলে এ সবই চলে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement