Central Government

নাগরিকের চিন্তার উপর নিয়ন্ত্রণ

অনেক সময় অবশ্য সত্যিটাকে শুধু উহ্য রাখলেই কাজ হয়ে যায়। সে দিন প্রধানমন্ত্রী বললেন যে, ব্যবসা করা দেশের নির্বাচিত সরকারের কাজ নয়।

Advertisement

অভিরূপ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২১ ০৫:১১
Share:

জর্জ অরওয়েলের নাইনটিন এইটি-ফোর’এ শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব যে মন্ত্রকের উপর ছিল, তার নাম ‘শান্তি মন্ত্রক’। ‘সত্য’ মন্ত্রকের দায়িত্বের মধ্যে ছিল সংবাদ নিয়ন্ত্রণ করা আর লিখিত ইতিহাস প্রয়োজন মতো পাল্টে দেওয়া। সর্বাধিপত্যকামী একনায়কতন্ত্রের অস্ত্র ‘ডাবলথিঙ্ক’। অরওয়েলের সংজ্ঞা ব্যবহার করলে এই কথাটার অর্থ হল: একই সঙ্গে জানা এবং না-জানা; একই সঙ্গে সত্য সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন হওয়া এবং অতি যত্ন সহকারে মিথ্যের জাল বুনে চলা; পরস্পরবিরোধী কথাকে উচ্চারণ করে চলা যুগপৎ, এটা জেনে যে, কথা দুটো পরস্পরবিরোধী এবং একটা অন্যটাকে কাটে— এবং একই সঙ্গে সেই দুটো কথাতেই বিশ্বাস করে চলা; নৈতিকতার দাবি করা, অথচ নৈতিকতাকে নস্যাৎ করে দেওয়া; একই সঙ্গে মনে করা যে গণতন্ত্র অসম্ভব, এবং এই শাসকরাই গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী; প্রয়োজন অনুসারে কোনও কথা ভুলে যাওয়া, এবং প্রয়োজন পড়লে ফের তাকে স্মরণে নিয়ে আসা। অর্থাৎ, একনায়কের পক্ষে অনুকূল একটি সর্বগ্রাসী ‘বাস্তব’ নির্মাণ করে নেওয়া।

Advertisement

অনেক সময় অবশ্য সত্যিটাকে শুধু উহ্য রাখলেই কাজ হয়ে যায়। সে দিন প্রধানমন্ত্রী বললেন যে, ব্যবসা করা দেশের নির্বাচিত সরকারের কাজ নয়। কথাটা খুব ভুল নয়। কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী তার পরেই জানালেন, সেই জন্যই নাকি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি বেচে দেওয়া ভীষণ প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী যে কথাটা বললেন না, সেটা হল, মুনাফা করার জন্য সরকারি সংস্থাগুলো তৈরি হয়নি, তৈরি হয়েছিল জনসেবা করার জন্য। ভারতীয় রেলের উদ্দেশ্য ছিল বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান করিয়ে রেলপথে যাতায়াত সাধারণ মানুষের কাছে সুলভ করা। বিএসএনএল-এর কাজ ছিল যত বেশি মানুষের কাছে সম্ভব টেলিফোন পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া— কোনও বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে মুনাফার প্রতিযোগিতায় নামা নয়। এই কথাগুলোকে সুবিধা মতো ভুলে গেলে, এবং ভুলিয়ে দিতে পারলে, সাঙাতদের হাতে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেচে দিতে আর কোনও নৈতিক আপত্তি থাকে না।

ফ্যাসিবাদকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন এক শত্রুপক্ষের, এ দেশে যে ভূমিকাটি মুসলিম সমাজ পালন করে চলেছে বহু দিন ধরে। বার বার বলা হচ্ছে, মুসলিম পরিবারগুলোতে জন্মের হার এতটাই বেশি যে, বছর ত্রিশ পরে নাকি দেশে আর কোনও হিন্দু মুখমন্ত্রী হবেন না। সাধারণ অঙ্ক কষেই কিন্তু দেখানো যায় যে, ২০০১ সালের জন্মের হার বজায় থাকলেও ভারতের মুসলিম জনসংখ্যা হিন্দুদের সমান হতে কম করে ২২০ বছর লাগবে। সেটাও কোনও দিনই সম্ভব নয়, কারণ জন্মের হার সময়ের সঙ্গে কমছে। সব জনগোষ্ঠীরই, মুসলমানদেরও। কিন্তু, সেই বাস্তব গুলিয়ে দেওয়াই তো ‘ডাবলথিঙ্ক’-এর কাজ।

Advertisement

প্রধানমন্ত্রীর ক্যারিশমা এমনই যে, উনি হুকুম করলে জনগণ নির্দিষ্ট সময়ে বারান্দায় সমবেত হয়ে থালা পেটাতেও রাজি। চার ঘণ্টার নোটিসে নোট বাতিল করে দিলে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন চুপ করে ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সিয়াচেনের সৈন্য ভাবে জনতা; অন্য সরকারের রাজত্বে রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম পাঁচ টাকা বাড়লেও বিক্ষোভে ফেটে পড়ত, এখন ১০০ টাকা বেড়ে গেলেও ভ্রুক্ষেপ করে না। অকারণে নয়। সর্বাধিপত্যকামী রাজনীতি তাদের বুঝিয়েছে যে, মোদীজির অনেক বড় কিছুর পরিকল্পনায় তারা ভাগীদার হচ্ছে এই সামান্য কিছু বলিদান স্বীকার করে। অস্বীকার করার উপায় নেই, সব রাজনীতিই মানুষকে বোঝাতে চায় যে, তাদের দলই সাধারণ মানুষের নির্বিকল্প মসিহা। কিন্তু, বোঝাতে পারে তারাই, যারা ‘ডাবলথিঙ্ক’-এর আয়ুধ ব্যবহার করতে জানে। মানুষের ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাই ‘ডাবলথিঙ্ক’-এর চূড়ান্ত সাফল্য।

এই আধিপত্যের সুবিধা অনেক। ‘প্রজা’দের চোখে আঙুল দিয়ে মাঝে-মাঝেই তিনি চিনিয়ে দেন, কাদের থেকে সাবধানে থাকতে হবে— দাড়ি-টুপিওয়ালা লুঙ্গিপরা ‘ওদের’ থেকে; ‘আন্দোলনজীবী’দের থেকে। ‘গণশত্রু’ চিহ্নিত হয়ে যায়। পাশাপাশি, এই চিনিয়ে দেওয়ার, চিনে নেওয়ার কাজে মানুষকে ব্যস্ত রাখতে পারলে সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে সাঙাতদের বাজার দখল করতে দেওয়ারও বেশ সুবিধা হয়।

প্রশ্ন হল, ভোট দিয়ে কি এদের হারানো যায়? হয়তো যায়— আমেরিকায় সম্ভব হয়েছে, কারণ নির্বাচনের আগেই এমি কোনি ব্যারেটের মতো রক্ষণশীল বিচারক নিযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও ওই দেশের সুপ্রিম কোর্ট নিরপেক্ষ থাকতে পেরেছে। রিপাবলিকান পার্টি-শাসিত রাজ্যগুলিও ট্রাম্পের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে নির্বাচনের ফলাফল পাল্টায়নি। ভারতে গণতন্ত্রের যতটুকু অবশিষ্ট আছে, তাকে বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র উপায় হল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোটাকে বাঁচিয়ে রাখা। এই লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছে তিনটি রাজ্য: পঞ্জাব, কেরল আর বাংলা। এই দুর্গগুলোর পতন হলে, কিছু দিন পরে যদি জানতে চান, দুই আর দুইয়ে কত হয়— তখন সত্যি করেই উত্তর পাবেন পাঁচ। ‘ডাবলথিঙ্ক’ সেই উত্তরটাই দিতে শেখায়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement