—প্রতীকী ছবি।
নবম শ্রেণির প্রোজেক্টের জন্য ‘ওপেন বুক ইভ্যালুয়েশন’-এর খাতা দেখতে গিয়ে দিদিমণি হতভম্ব। খোলা বই সামনে। কতিপয় শিক্ষার্থী লিখেছেও ভাল। কিন্তু বাকিদের অবস্থা করুণ। দিদিমণির ধারণা ছিল, বই দেখেই যখন লিখবে, দু’-একটা প্রশ্ন সামান্য ঘুরিয়ে দিলে ক্ষতি কী? দেখা গেল, ক্ষতি মারাত্মক। দিদিমণির মনে পড়ে গেল এরিখ মারিয়া রেমার্কের উপন্যাসের নায়ক আর্নস্ট আর তার বন্ধুদের কথা। ক্লাসরুম থেকে যুদ্ধে চলে গিয়েছিল সেই কিশোর ছাত্ররা। যুদ্ধ থেকে বাড়ি ফিরে আর কিছুতেই তারা স্থির হতে পারছে না। পশ্চিম রণাঙ্গন তখন শান্ত, কিন্তু যুদ্ধ-ফেরত এই অকালবৃদ্ধরা ছটফটিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের স্কুলে ফিরিয়ে বলা হল পরীক্ষায় বসতে। কিন্তু কিছুতেই তারা পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হতে পারছে না। প্রশ্ন বলে দিলেও না। দিদিমণির ছাত্রীরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-ফেরত নয়। অথচ প্রশ্ন একেবারে সরল না হলে অনেকেই কেন বই দেখেও উত্তর লিখতে পারছে না? তারাও কি বইয়ের শব্দগুলো কেবল দেখছে, আওড়াচ্ছে, কিন্তু বুঝছে না?
সেন্ট্রাল বোর্ড অব সেকেন্ডারি এডুকেশন (সিবিএসই) সম্প্রতি ‘ওপেন বুক ইভ্যালুয়েশন’-এর প্রস্তাব দিয়েছে। ‘ন্যাশনাল কারিকুলাম ফ্রেমওয়ার্ক’-এর সঙ্গে সাযুজ্য রেখে পরীক্ষামূলক ভাবে তারা নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের এই পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিতে চায়। নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর এই ‘পাইলট রান’ চলবে। এই পরীক্ষায় শিক্ষার্থী বই, নোটস এবং অন্য সব পাঠ সহায়ক উপকরণ নিয়ে পরীক্ষা দিতে পারবে। প্রশ্নপত্র এমন ভাবে তৈরি হবে যে, সরাসরি বই দেখে উত্তর দেওয়া যাবে না। না বুঝে মুখস্থ নয়, পাঠ্যের অন্তর্নিহিত অর্থ হৃদয়ঙ্গম করায় উৎসাহ জোগাবে এই পদ্ধতি। পরীক্ষার্থীর দক্ষতা, বিশ্লেষণ ক্ষমতা, সমালোচনার ক্ষমতা, উদ্ভাবনী চিন্তা, সমাধানের ক্ষমতা— এই সবের পরিচয় পাওয়া যাবে। প্রশ্নকেও হতে হবে অভিজ্ঞতা-নির্ভর। ফলদায়ক শিক্ষণ, প্রশ্নপত্র নির্মাণ, মূল্যায়ন— সর্বক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও হতে হবে উদ্ভাবনী ক্ষমতার অধিকারী।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এটি স্বীকৃত পদ্ধতি। অনেক দেশেই এর সফল প্রয়োগ হয়েছে। কিন্তু দেশ যখন লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্-মুহূর্তে দাঁড়িয়ে, তখন ‘ওপেন বুক ইভ্যালুয়েশন’-এর কথা ঘোষণার পিছনে কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে? তাও আবার স্কুল-শিক্ষায়। সিবিএসই এর আগে ‘ওপেন টেক্সট বেসড অ্যাসেসমেন্ট’ চালু করেছিল। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়েও এই নিয়ে সমীক্ষা হয়েছে। ফল ইতিবাচক নয়।
তা ছাড়া শিক্ষার্থীদের কাছে নতুন এই পরীক্ষা-পদ্ধতি পৌঁছে দিতে হলে যে ধরনের শ্রেণিশিক্ষণ প্রয়োজন, তার জন্য উপযুক্ত এবং প্রশিক্ষিত শিক্ষকই বা কোথায়? তেমন প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য কী পরিকল্পনা করা হয়েছে? যে দেশের প্রায় তেইশ শতাংশ মানুষ এখনও সাক্ষরই হননি, দশম শ্রেণিতেই স্কুলছুট হয়ে যায় কুড়ি শতাংশের বেশি ছাত্রছাত্রী, তাদের ‘ওপেন বুক ইভ্যালুয়েশন’-এ বসানোর আয়োজন তো অবাক করে দেবেই।
এই ধরনের পরীক্ষা-পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় কি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পরিকাঠামো এবং দর্শনগত ভাবে আসতে পেরেছে? শিক্ষাখাতে বাজেটে ব্যয়বরাদ্দ বাড়িয়ে উন্নতির পরিকল্পনা করা হয়েছে? শিক্ষক-শিক্ষিকার প্রশিক্ষণ ব্যবস্থায় পরীক্ষার উপযোগী শিক্ষণ, অভীক্ষা ও মূল্যায়নের উপর জোর দেওয়া হয়েছে? এ সব না করে অপ্রস্তুত শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ঘাড়ে সম্পূর্ণ নতুন এক ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া কেন?
সম্প্রতি জানা গিয়েছে, উত্তরপ্রদেশের বোর্ড পরীক্ষায় (ইন্টারমিডিয়েট) ৮২৬৫টি সেন্টারে প্রায় তিন লক্ষ পরীক্ষার্থী উপস্থিতই হয়নি। শোনা যাচ্ছে, কড়া পাহারা থাকার সম্ভাবনায় ভীত হয়ে তারা এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। আমাদের উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়েও এক পরীক্ষায় নব্বই শতাংশ ছাত্রছাত্রী অকৃতকার্য হয়েছে বলে খবর। গুঞ্জন উঠছে, সেখানেও সঠিক পাহারা ছিল। আমরা এক বারো ক্লাসে অকৃতকার্য হওয়া নাগরিকের আইপিএস হওয়া নিয়ে মাতামাতি করি, কিন্তু পরীক্ষার ঘরে পাহারা বসলে যে ক্লাসসুদ্ধ ছাত্রছাত্রী অকৃতকার্য হয়, সেই বাস্তবতা ঢেকে ফেলা যায় না। এখনও বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরীক্ষার সময় ছাত্রছাত্রীদের যথেচ্ছ অসৎ হওয়ার সুযোগ মেলে। এ-হেন পরিস্থিতিতে পরীক্ষার্থীর সামনে বই খুলে দেওয়ায় তারা যান্ত্রিক ভাবে মুখস্থ করার অভ্যাস ছেড়ে পাঠ্যবিষয়কে উপলব্ধি করতে উদ্যোগী হয়ে উঠবে, এমনটা নিতান্তই দুরাশা। বিশেষত স্কুল স্তরে। বদলে অনেকেই উত্তেজিত হয়ে উঠবে যে, টুকলি করার জন্য তাদের যে কায়িক শ্রম করতে হত, এ বার আর তার দরকার পড়বে না। ফলে পরীক্ষার আগেও বই ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছা তাদের চলে যাবে।
দুর্বল শরীরে ভারী বোঝা চাপিয়ে দিলে শরীর ও বোঝা কেউই লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে পারে না। নির্দিষ্ট পরিকল্পনামাফিক চললে কয়েক বছর পরে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা কিছুটা সাফল্য পেতে পারে। তা ছাড়া এ দেশের প্রত্যেক রাজ্যে শিক্ষাক্ষেত্রের কিছু নিজস্ব বাস্তবতা আছে। তাদেরও সময় এবং ভাবনার অবকাশ দিতে হবে। এত সব ভেবে কি হঠাৎ ‘ওপেন বুক ইভ্যালুয়েশন’-এর কথা বলা হয়েছে? না কি তারুণ্য উজ্জ্বল ভারতের মনোরঞ্জনই এই প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য? আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস সব কিছুকে গুলিয়ে দেওয়ার একটা গোপন যুদ্ধ চলছে। আজকের আর্নস্টরাও তাই বড্ড অশান্ত। ‘খোলা বই’ গোলমালের পথ খুলে দিতে পারে।