আবার: মুর্শিদাবাদের রাস্তায় ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা, উপস্থিত রাহুল গান্ধী। ১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: পিটিআই।
নববিগ্রহে প্রাণপ্রতিষ্ঠার পর পুণ্যতোয়া সরযূ দিয়ে ইতিমধ্যেই অনেক জল প্রবাহিত। রামভক্তি ও রাজশক্তির অভূতপূর্ব সম্মেলনে নির্মিত অতুল ঐশ্বর্যময় অর্ধ-সমাপ্ত মন্দিরে ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা’র পরম মুহূর্তটি যখন শত শত ক্যামেরা-বাহিত হয়ে বাড়ির টিভি বা পাড়ার দৈত্যাকার পর্দায় ভেসে উঠল, তখন অনেকেই বেশ কিছু সময় যুগপৎ বিহ্বলতা ও বিস্ময়ে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। দিবারাত্র মিডিয়ায় সচিত্র প্রচারে মনে হচ্ছিল যেন এই মন্দিরটিই শাশ্বত সত্যের মতো ‘ঐতিহাসিক’ ভাবে ওখানেই চিরকাল এ ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। এই ভাবে বত্রিশ বছর আগে উন্মত্ত আবেগে পরিত্যক্ত মসজিদের ধ্বংসপ্রাপ্ত কাঠামোটি কেবল ভৌগোলিক ভাবেই নয়, জনস্মৃতি থেকেও মুছে গেল।
এই বিহ্বলতায় কেবল জনসাধারণ নয়, কেন্দ্রের শাসক দলের বিরোধীরাও অনেকখানি আচ্ছন্ন হয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। এর পাল্টা কেউ কেউ ‘সংহতি’ মিছিল করলেন, কেউ ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধী’ সম্মেলন, কেউ বা সেমিনার। তবে একটা বিষয়ে বোধ হয় প্রত্যেকেই কমবেশি সচেতন ছিলেন, তা হল, ‘রঘুপতি রাঘব’-কে নিয়ে নানান কূট প্রশ্ন তুলে এই মুহূর্তে তাঁরা শাসকের পাতা ফাঁদে পা দেননি, যাতে সহজেই দেখানো যেত, বিজেপি-বিরোধীরা প্রকৃতপক্ষে রাম-বিরোধী। ‘রামচন্দ্র’ নন, বিরোধীরা যে আসলে তাঁকে নিয়ে ‘রাজনীতি’ করার বিরোধী, সেটা তাঁরা যত স্পষ্ট ভাবে আমজনতার কাছে নিয়ে যেতে সক্ষম হবেন ও তার পাশাপাশি বেকারত্ব ও মূল্যবৃদ্ধির মতো প্রাত্যহিক জীবনের সমস্যাগুলির কথা তুলে ধরতে পারবেন, তত বেশি, এই পরিস্থিতিতেও মন্দির-কেন্দ্রিক আখ্যানের পাল্টা আখ্যান নির্মাণে সফল হবেন। এতে যত কালক্ষেপ হবে, ততই শাসক দলের সুবিধা। অসমাপ্ত মন্দিরে তড়িঘড়ি বিগ্রহে প্রাণপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য যে আদতে রাজনৈতিক তা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের এপ্রিলের মাঝামাঝি লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ তৎপরতা শুরু করা, আর মন্দির তথা ‘নতুন ভারত’-এর উদ্বোধক হিসাবে প্রধানমন্ত্রী শ্রীনরেন্দ্র মোদীকে একক ভাবে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে।
এই নতুন যুগের হিন্দুত্ব এখন ‘মোদীত্ব’ বলে সমধিক জনপ্রিয়, যা এরই মধ্যে উত্তর, মধ্য ও পশ্চিম ভারতকে যে উদ্বেল আবেগে মথিত করেছে, তার সুফল আগামী লোকসভা ভোটে উপচে পড়বে, ইত্যাকার আলোচনা বাণিজ্যিক ও সমাজমাধ্যমে ছেয়ে গেছে। এখানেই প্রয়োজন তা নির্বাচনী বাস্তবতার আলোকে খতিয়ে দেখা। রামমন্দির নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় বেরিয়েছিল ২০১৯-এর নভেম্বর মাসে, লোকসভা ভোটের ছ’মাস পরে। অস্যার্থ, সেই ভোটের প্রচারে ‘মন্দির নির্মাণ’ মূল বিষয় ছিল না, ছিল বহিরাক্রমণ ও তার বদলার (বালাকোট-পুলওয়ামা) আখ্যান। সে বারে মন্দির-প্রসঙ্গ ছাড়াই উত্তর, মধ্য ও পশ্চিমের অধিকাংশ রাজ্যে বিজেপি আসন সংখ্যায় তার সর্বোত্তম জায়গাটি দখল করেছিল। বিহারে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট (তখন নীতীশ কুমারের জেডিইউ-ও তার শরিক) পেয়েছিল ৪০টি আসনের মধ্যে ৩৯টিই, একমাত্র কিসানগঞ্জ গিয়েছিল কংগ্রেসের ঝুলিতে। ঝাড়খণ্ডের ১২টির মধ্যে ১০টিই পেয়েছিল এনডিএ, কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ মাত্র দু’টি। মন্দির-রাজনীতির অকুস্থল উত্তরপ্রদেশে ৮০টির মধ্যে বিজেপি+ ৬৪, বাকি ১৬টির মধ্যে সেই সময় জোটবদ্ধ মায়াবতীর বিএসপি (১০) ও অখিলেশ যাদবের এসপি (৫), কংগ্রেস পেয়েছে মাত্র ১টি। উত্তরাখণ্ডে বিজেপি ৫-এ-৫, আর এক পাহাড়ি রাজ্য হিমাচলপ্রদেশেও বিজেপির ঝুলি ‘পঞ্চম’-এ পূর্ণই ছিল। বিজেপি-শাসিত হরিয়ানাতেও দশে-দশ। এই যেখানে অবস্থা, সেখানে নব-বিজেপি-শাসনের প্রাণভোমরা গুজরাতে কি ২৬-এ ২৬ না হয়ে যায়! শুধু, বিজেপি-শাসিত নয়, কংগ্রেসের হাতে থাকা রাজস্থান ও ছত্তীসগঢ়ের হালও তথৈবচ। রাজস্থানে ২৬-এর মধ্যে ২৫টিই বিজেপির, কংগ্রেসের ‘শূন্য’ থালি, তুলনায় ছত্তীসগঢ় মন্দের ভাল— ৯ বিজেপি, ২ কংগ্রেস। মধ্যপ্রদেশেও করুণ অবস্থা, বিজেপির ২৪ বনাম কংগ্রেসের ১, দিল্লিতেও শাসক দল সাতে সাত। সব মিলিয়ে এই অঞ্চলের আড়াইশো আসনের মধ্যে জোটসঙ্গী-সহ বিজেপি ২২৪। যার মধ্যে পাঁচটি রাজ্যে আর বাড়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই। ভোটবিজ্ঞানের নিয়ম ও অন্যান্য কিছু বাস্তব উপাদান (যেমন, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা অঞ্চলে কৃষক অসন্তোষ) ধরলে বরং কিছুটা কম হওয়ারই সম্ভাবনা। একই সঙ্গে বলতে হবে অসম-সহ উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে শাসক দলের চমকপ্রদ উত্থানের কথা। এখানকার মোট ২৪টি আসনের মধ্যে বিজেপি একাই ১৪টি, কংগ্রেস ৪টি আর স্থানীয় দলগুলির দখলে গেছে ৬টি।
উত্তর, মধ্য ও পশ্চিম অঞ্চলের বহু আসনেই (মুখ্যত উত্তরপ্রদেশ বাদে) বিজেপির মূল প্রতিপক্ষ ছিল কংগ্রেস। অন্য দিকে, কর্নাটককে বাদ দিলে (যেখানে বিজেপি ২৮টির মধ্যে ২৫টি আসন পেয়েছিল, কংগ্রেস মাত্র ১টি) দক্ষিণ ভারতের তিনটি রাজ্য তামিলনাড়ু, কেরল ও অন্ধ্রপ্রদেশে বিজেপিকে শূন্য হাতে ফিরতে হয়েছিল, এমনকি ওই অঞ্চলে দ্বিতীয় স্থানও দখল করতে ব্যর্থ হয়েছিল। এই সব রাজ্য ও অন্য কিছু বড়/ছোট রাজ্য তথা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ধরলে দেশে ১০০টির কিছু বেশি আসনে বিজেপি হয় লড়েনি, অথবা দ্বিতীয় স্থানও পায়নি। বাকি প্রায় ২০০-র কাছাকাছি আসনে কংগ্রেস ও বিজেপির সম্মুখ সমর, যেখানে বিজেপির সাফল্যের হার ঈর্ষণীয়, ৯০ শতাংশের বেশি! বাদবাকি প্রায় ২৪০টি আসনে বিজেপির লড়াই আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গেই। এই হল গত বারের রিপোর্ট কার্ডের সারাৎসার।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই গত বছরের জুনে কংগ্রেস-সহ বিজেপি-বিরোধী নানা দলের সম্মেলনে গড়া (ওড়িশা, অন্ধ্র ও তেলঙ্গানার প্রধান অবিজেপি দলগুলি বাদে) ‘ইন্ডিয়া’ জোট নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। বিশেষত, রাহুল গান্ধীর সুদীর্ঘ ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রার পর কর্নাটক বিধানসভায় কংগ্রেসের আশাতীত জয়ের পর তা বেড়েছিল। কিন্তু গত ডিসেম্বরে বিধানসভার ভোটে, হাতে থাকা ছত্তীসগঢ় ও রাজস্থান তো বিজেপির দখলে গেলই, যে মধ্যপ্রদেশ নিয়ে অনেক আশা ছিল, সেখানেও বিজেপির কাছে শোচনীয় পরাজয়, কংগ্রেস তথা ইন্ডিয়া জোটের ভবিষ্যৎকে চরম চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে, তেলঙ্গানায় কংগ্রেসের বিপুল জয় সত্ত্বেও। যদিও তেলঙ্গানায় কংগ্রেস বিজেপিকে নয়, হারিয়েছে কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের বিআরএস-কে। এ ছাড়া রয়েছে নানা রাজ্যে পরস্পরের প্রতিযোগী দলগুলিকে নিয়ে গড়া জোটের বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন। যেমন, কেরলে আছে কংগ্রেস ও বামেদের পৃথক জোট; পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির পাশাপাশি ইন্ডিয়া জোটের বাম এবং কংগ্রেসও তৃণমূলের তীব্র বিরোধী; কেজরীওয়ালের ‘আপ’-ও কংগ্রেসের ব্যাপারে ছুতমার্গী। বড় রাজ্যের মধ্যে সরাসরি বিজেপির বিরুদ্ধে কেবল মহারাষ্ট্র ও বিহারে এই জোট অনেকখানি কার্যকর হবে বলে আশা তৈরি হয়েছিল— বিহারে নীতীশ কুমার তাতে জল ঢেলেছেন; মহারাষ্ট্রে কী হয়, দেখা বাকি।
মহারাষ্ট্রে বিজেপি-শিবসেনা জোট ক্ষমতায় এলেও, মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রশ্নে শিবসেনার উদ্ধব ঠাকরে কংগ্রেস-এনসিপির সঙ্গে জোট বাঁধলেও বছরখানেক আগে শিবসেনার একনাথ শিন্দে ও এনসিপির (শরদ পওয়ারের ভাইপো) অজিতদাদা নিজ নিজ দল ভেঙে বিজেপির হাত ধরলে, এক নতুন সমীকরণ তৈরি হয়েছে, যার ফলে উদ্ধবদের শিবসেনা ‘ইন্ডিয়া’ জোটে থাকলেও, অন্য অংশ থাকবে বিজেপির দিকে। বিহারে নীতীশ কুমার নিজেরই রেকর্ড ভেঙে যদি ভোটের আগে আরও এক দফা জোট পাল্টান, তবে অন্য কথা— নচেৎ সে রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে আরজেডি ও নানা বর্ণের বামেরাই ইন্ডিয়া জোটে থাকবে মনে হচ্ছে।
অতএব, আগামী লোকসভা ভোটে বিজেপি-বিরোধী লড়াইয়ের তিনটি রূপ দেখা যাচ্ছে: এক, স্বল্পসংখ্যক রাজ্যে ইন্ডিয়া জোট ঐক্যবদ্ধ লড়াই করবে; দুই, বেশ কিছু রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলির যে যেখানে শক্তিশালী সেখানে সে লড়বে; তিন, বাকি আসনগুলির (প্রায় ২০০) লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে হবে একক ভাবে কংগ্রেসকেই। সঙ্গে থাকবেন অজস্র মাঝারি-ছোট নাগরিক সমাজের মানুষ ও নিতান্ত সাধারণ জন, যাঁরা শেষ মুহূর্তে, চূড়ান্ত একমাত্রিক কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠার আশঙ্কায় ও নানা আর্থসামাজিক কারণে নিজেরা অদৃশ্য থেকেও অনেক পাশা উল্টে দিতে পারেন। তবে রামমন্দির-প্রতিষ্ঠা-উত্তর নব-ভারতে বিরোধীদের এমন সাড়ে-বত্রিশ-ভাজা হাল দেখে মোদী-শাহ জুটি গুনগুন করতেই পারেন, ‘এমন বন্ধু আর কে আছে, তোমার মতো, মিস্টার’! ‘ন্যায় যাত্রা’য় ফের পথে-নামা রাহুল গান্ধী কি শুনতে পাচ্ছেন!