Black Money

কালো টাকা যাঁদের বাঁচিয়ে রাখে

দুর্নীতির কালো টাকার একটা বড় অংশ যে আমাদের দেশের জাতীয় আয়ের এবং জাতীয় ব্যয়ের অন্তত পঞ্চাশ শতাংশ জুড়ে রয়েছে, সে কথাটা আমাদের বিব্রত করে না।

Advertisement

সুগত মারজিৎ

শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৫:৩৯
Share:

দুর্নীতি সম্বন্ধে আমরা বহু ক্ষেত্রেই উদাসীন।

নেতাদের পুকুরচুরি থেকে শিল্পপতিদের ঋণখেলাপি, ছোট-বড় চুরি-ডাকাতি থেকে কেনাবেচায় কর ফাঁকি, হরেক রকম দুর্নীতি ঘটেই চলেছে চার পাশে। কর ফাঁকি দেওয়া, ব্যবসার আইনি কাগজপত্র না থাকা সত্ত্বেও প্রভূত রোজগার করা, ছোট-বড় বিভিন্ন রকমের তোলাবাজি, দেশ-বিদেশের সীমান্ত পার করা চোরা ব্যবসা, সরকারের চোখে ধুলো দিয়ে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করা— সবই দুর্নীতি। প্রশ্ন হল, এই টাকাকড়ি যায় কোথায়?

Advertisement

দুর্নীতির কালিমাখা টাকার একটা বড় অংশ যে আমাদের দেশের জাতীয় আয়ের এবং জাতীয় ব্যয়ের অন্তত পঞ্চাশ শতাংশ জুড়ে রয়েছে, সে কথাটা আমাদের বিব্রত করে না। যে টাকা বিদেশে চলে গেল, সেটা ছাড়াও এ দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্রের অনেকটা জায়গা জুড়ে নিয়োজিত এই টাকাপয়সা। দুর্নীতি সম্বন্ধে আমরা বহু ক্ষেত্রেই উদাসীন। রেস্তরাঁয় খেয়ে কাঁচা বিলে দাম মিটিয়ে চলে আসি, ফাঁকি পড়ে জিএসটি। দোকান-বাজারেও হাসি মুখে সায় দিই কর ফাঁকি দেওয়ায়। আমরা এ রকম কোটি কোটি টাকার বান্ডিল দেশের সরকার ও মানুষকে ঠকিয়ে অন্যকে চুরি করতে সাহায্য করছি। শুধু অন্যের বাথরুমে কোটি টাকা পাওয়া গেলে আমাদের নৈতিকতার ভিসুভিয়াসে বিস্ফোরণ ঘটে।

এ দেশে কৃষিক্ষেত্রে আয়কর দিতে হয় না। কিন্তু কৃষিক্ষেত্র বাদ দিলে অসংগঠিত ক্ষেত্র থেকে রোজগার করেন দেশের শ্রমশক্তির প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ। দুর্নীতিপ্রসূত টাকাকড়ি আলমারি সিন্দুকে পচে খুবই কম। সে টাকা ব্যবসায় লাগে। অসংগঠিত ক্ষেত্রের ব্যবসায়। সরকারি বা বেসরকারি ব্যাঙ্কে ঋণ পাওয়া শক্ত। তাই ছোট ব্যবসায়ীরা যাঁদের কাছ থেকে চড়া সুদে ধার নেন, এবং দিনের বা সপ্তাহের শেষে টাকা শোধ দেন, সেই ঋণের জোগান কোথা থেকে আসে— প্রশ্ন করেন ক’জন? এ সবের তেমন কোনও পরিসংখ্যান বা তথ্য পাওয়া যায় না। কর ফাঁকি দেওয়া বা অসৎ উপায়ে অর্জিত টাকার কল্যাণে অনেক লোকের বাড়িতে হাঁড়ি চড়ে। কাল সকালে যদি এ দেশ থেকে অসংগঠিত ক্ষেত্র উধাও হয়ে যায়, যাতে সব কিছুই আইনানুগ সাদা হয়ে দাঁড়ায়, তবে বহু মানুষের মৃত্যু ঠেকানো যাবে না।

Advertisement

সাদা-কালোর এই মেলবন্ধনের ‘সুফল’ প্রতি পদে আমরা পাই। কোটি কোটি পরিবারের রুজিরোজগার কোন বিনিয়োগের ফল, তার মধ্যে কতটা সাদা কতটা কালো, আমরা জানি কি? কেউ বলতে পারেন যে, দেশের যা অর্থনৈতিক বা সামাজিক অবস্থা, তাতে সংগঠিত ক্ষেত্রে দশ শতাংশ শ্রমিকও চাকরি পান না। কাজেই, বুদ্ধিমান সরকার চাইতেই পারে যে, ফাঁক গলে বেশ কিছু টাকা অসংগঠিত ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হোক— যেখানে আইনের কড়াকড়ি নেই, কর দিতে হয় না, অনেক অদক্ষ স্বল্পশিক্ষিত গরিব মানুষ কাজ পেতে পারেন। তা হলে দেশে খানিক দুর্নীতি বাড়লেই বা ক্ষতি কী? দেশে সে টাকা খরচ হলেই হল।

কেউ কেউ প্রশ্ন করেন যে, সব কালো টাকা একত্র করে সরকার কেন বাজেয়াপ্ত করে না! যাঁরা কালো টাকা রোজগার করেন, তাঁরা সবাই বলিউডি ফিল্মের মতো স্মাগলার নন। তাঁরা সেটা বিনিয়োগ করেন। ভারতে সরকারি বিনিয়োগ জাতীয় আয়ের ৭-৮ শতাংশের বেশি নয়, বেসরকারি বিনিয়োগ ২১ শতাংশের ধারে কাছে, চিনের মতো দেশের তুলনায় যা খুবই কম— সেখানে সরকার সব কালো টাকা পুড়িয়ে ফেললে মারা পড়বেন বহু গরিব মানুষ।

পরিশেষে আমাদের দেশের করব্যবস্থার খামতি সম্পর্কে দু’-এক কথা বলা প্রয়োজন। এখন সবাই প্রায় অ্যাপ ব্যবহার করে লেনদেন করেন, কিন্তু তাতে দেশে আয়করদাতার সংখ্যা তেমন বাড়েনি। আয়করের রিটার্ন ফাইল করা মানে যে বেশি লোক কর দিয়েছেন, তা নয়। নোট বাতিলের পর কারচুপি করে অনেকেই ব্যাঙ্কে কালো টাকা জমা দিয়েছিলেন। তাঁদের ক’জন এখন বেশি কর দিচ্ছেন? তাঁদের শাস্তি হল কি? জানা নেই। আমার চেয়ে দশগুণ রোজগার করা অনেকেই আমার চেয়ে কম আয়কর দেন। তাঁরা রোজগার লুকোতে পারেন। আর স্বাধীন উদ্যোগের পেশাদার কিংবা নামীদামি রেস্তরাঁ, বড় ব্যবসা, অসম্ভব চালু মল, রাস্তার এক পয়সা কর না দেওয়া এবং ‘ওরা গরিব’ তকমা দেওয়া ব্যবসা, সবাইকে সঠিক ভাবে যাচাই করতে হলে এ দেশে মিনিমাম অল্টারনেটিভ ট্যাক্স (এমএটি) নীতি চালু করা উচিত। কোথায় আমি ঠিক কত টাকার ব্যবসা করছি, সেটা সরকার কখনও যথাযথ আন্দাজ করতে পারে না, কিন্তু একটা মোটামুটি ধারণা থাকতেই পারে। তাই বাড়ির জন্য কর্পোরেশন যেমন কর ধার্য করে, যেটা আমাদের দিতেই হয়, সর্বস্তরে এমএটি ধার্য করা উচিত। ওই টাকাটা সরকারকে কর বাবদ দিতেই হবে।

যদি সরকারের হাতে টাকাকড়ি থাকাটা সমাজ শ্রেয় বলে মেনে নেয়, তা হলে এ দেশে অনেক বেশি লোকের কর দেওয়া উচিত। যদি ১৪০ কোটির মধ্যে ৩০ শতাংশ দরিদ্র মানুষকে এবং যাঁরা এখন আয়কর দিচ্ছেন, শুধু রিটার্ন ফাইল করছেন না, তাঁদের বাদ দিই, তা হলে বাকি ৯০ কোটির মধ্যে ৩ জনের পরিবার পিছু এক জন রোজগেরে মানুষ দিনে এক টাকা করে সরকারকে দেন, তা হলে বছরে ১১০০০ কোটি টাকার মতো সরকারের অতিরিক্ত আয় বাড়ে।

কিন্তু সরকারের হাতে টাকা দেওয়াটা কি সমীচীন? সে টাকা বেসরকারি ব্যবসায় চলাচল করা কি বাঞ্ছনীয়? সরকার এবং খানিকটা নিয়ন্ত্রণবিহীন অ্যানার্কি কি ভারতীয় অর্থনীতির বেঁচে থাকার উপায়? এই প্রশ্নগুলো সুচেতন মানুষদের ভাবতে বাধ্য করবে, আর দুর্নীতি সম্পর্কিত উচ্ছল সমালোচনাকে খানিকটা সংযত করবে বলে আশা করি। আয়নাতে নিজেদের মুখ তো আমাদের দেখতেই হয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement