জনমুখী প্রকল্পের শাক দিয়ে দুর্নীতির পচা মাছ ঢাকা যায় না
Karnataka Assembly Election 2023

বার্তা পৌঁছল কি

নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হয়ে বলেছিলেন, ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’! তিনি নিজে ঘুষ খাবেন না, কাউকে খেতেও দেবেন না।’

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০২৩ ০৪:৪২
Share:

গণতন্ত্র: সচিত্র পরিচয়পত্র হাতে নির্বাচনী কেন্দ্রের সামনে বেঙ্গালুরুর ভোটাররা। ১০ মে, ২০২৩। ছবি: পিটিআই।

কর্নাটকের বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি নেতৃত্ব একটা হিসাব কষেছিলেন। তা হল, রাজ্যের প্রায় ৫ কোটি ২৮ লক্ষ মানুষ কেন্দ্র ও রাজ্যের বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধা পেয়েছেন। সংখ্যাটা বিপুল— এ বারের নির্বাচনে কর্নাটকের ভোটারের সংখ্যাই ছিল ৫ কোটি ৩১ লক্ষের সামান্য বেশি। বিজেপি নেতৃত্বের অনুমান ছিল, যে সব পরিবারে কেন্দ্র বা রাজ্যের কোনও না কোনও জনমুখী প্রকল্পের সুবিধা পৌঁছেছে, তাঁদের একটা বড় অংশের ভোট বিজেপির ঝুলিতেই পড়বে।

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গে যেমন লক্ষ্মীর ভান্ডার থেকে কন্যাশ্রী, কৃষকবন্ধু থেকে স্বাস্থ্যসাথীর মতো নানা জনমুখী প্রকল্প, কর্নাটকে তেমনই রাজ্য সরকারের ভাগ্যলক্ষ্মী যোজনা, রায়ত বিদ্যানিধি, রায়ত শক্তি, উদ্যোগিনী, স্ত্রী-শক্তি থেকে আরোগ্য কবচের মতো প্রকল্পের ছড়াছড়ি। তার সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা, পিএম-কিসান, উজ্জ্বলা, আয়ুষ্মান ভারত, পোষণ অভিযান, ফসল বিমা যোজনার মতো প্রকল্পও রয়েছে। কিন্তু কর্নাটকের ভোটের ফলে দেখা গেল, এই সব জনমুখী প্রকল্পও বিজেপিকে বৈতরণি পার করাতে পারল না। তার চেয়ে অনেক বড় হয়ে উঠল বাসবরাজ বোম্মাই সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে সরকারি বরাতে ঠিকাদারদের থেকে ৪০% হারে কমিশন নেওয়ার নালিশ।

নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হয়ে বলেছিলেন, ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’! তিনি নিজে ঘুষ খাবেন না, কাউকে খেতেও দেবেন না। তাঁর জমানাতেই একটি রাজ্যে দুর্নীতির অভিযোগের চাপে বিজেপি ক্ষমতাচ্যুত হল। নিশ্চিত ভাবেই নরেন্দ্র মোদীর দুর্নীতি-বিরোধী ভাবমূর্তিতে জোর ধাক্কা। সেই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কপালেও কর্নাটকে বিজেপির হার চিন্তার ভাঁজ ফেলবে। কারণ কর্নাটকে বিজেপির হার প্রমাণ করছে, জনমুখী প্রকল্পই বলুন বা খয়রাতি, সেই শাক দিয়ে দুর্নীতির পচা মাছ ঢাকা যায় না। বিশেষত যদি সেই দুর্নীতি মানুষের রুটিরুজিতে আঘাত করে থাকে।

Advertisement

কর্নাটকে ঠিক সেটাই হয়েছিল। রাজ্যের ঠিকাদারদের সংগঠন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি লিখে অভিযোগ জানিয়েছিল, সরকারি বরাত পেতে গেলে ৪০ শতাংশ হারে কমিশন দিতে হচ্ছে। অনেক ঠিকাদারই কাজ পাচ্ছিলেন না। ভিনরাজ্যের ব্যবসায়ীরা এসে ঘুষ দিয়ে বরাত আদায় করে নিচ্ছিলেন। ঘুষ না দিলে সরকারের ঘর থেকে বকেয়া পাওনা মিলছিল না। এই অভিযোগ জানিয়েই গত বছর বেলগাভির ঠিকাদার সন্তোষ পাটিল আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন। নিজের মৃত্যুর জন্য দায়ী করেছিলেন রাজ্যের তদানীন্তন গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী কে এস ঈশ্বরাপ্পাকে। কংগ্রেস সেখান থেকেই ‘চল্লিশ শতাংশ সরকার’-এর স্লোগান তুলে প্রচার শুরু করে।

এই তিরের মুখে বিজেপি নেতৃত্ব দুর্নীতির বিরুদ্ধে সক্রিয়তা দেখায়নি। ঈশ্বরাপ্পাকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরানো হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সরকারি কাঠামো থেকে দুর্নীতি দূর করার চেষ্টা হয়নি। বিজেপি কখনও বোঝানোর চেষ্টা করেনি যে, দুর্নীতি হয়নি। দুর্নীতির অভিযোগ মিথ্যে প্রমাণ করার মতো কোনও ব্যাখ্যাও বিজেপি দেয়নি। তার বদলে বিজেপি যাবতীয় অভিযোগকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। ফলে, বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ জনতার মনে গেঁথে গিয়েছিল।

দুর্নীতির অভিযোগের জবাব না দিয়ে বিজেপি নানা জনমুখী প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট টানার চেষ্টা করেছিল। ক্ষমতায় ফিরলে বিনামূল্যে বছরে তিনটি করে রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার, প্রতি দিন আধ লিটার দুধ, গরিবদের জন্য মাসে পাঁচ কেজি করে মিলেট বিলি করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। দাবি করেছিল, জাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছেন ও পাবেন।

পশ্চিমবঙ্গেও সরকার নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে অভিযোগের তিরে জর্জরিত। এর আগেও রাজ্যে সারদা-নারদ কেলেঙ্কারি নিয়ে হইচই হয়েছে। গরু-কয়লা পাচার নিয়ে তদন্ত চলছে। কিন্তু এর কোনওটির সঙ্গেই সরাসরি মানুষের রুটিরুজির প্রশ্ন জড়িয়ে নেই। স্কুলে শিক্ষক-অশিক্ষক পদে নিয়োগে দুর্নীতির সঙ্গে শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতীদের ভবিষ্যতের প্রশ্ন জড়িত। কারণ এখানে অযোগ্যরা ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়ে গিয়েছেন বলে অভিযোগ। আর যোগ্যরা চাকরির দাবিতে মাসের পর মাস রাস্তায় বসে রয়েছেন।

তৃণমূল নেতৃত্ব এই দুর্নীতির অভিযোগের তিরকে দু’ভাবে মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে। প্রথমত, তৃণমূল বোঝানোর চেষ্টা করছে, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতো কেউ ব্যক্তিগত স্তরে দুর্নীতি করে থাকলে তার দায় দলের নয়। দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ হলে প্রয়োজন মাফিক ব্যবস্থা হবে। তৃণমূল নেতৃত্ব কাউকে দল বা সরকারের পদে বসিয়ে থাকতেই পারে। তা বলে তো তাঁকে দুর্নীতি করতে বলা হয়নি! দ্বিতীয়ত, দুর্নীতির নালিশের থেকেও তৃণমূল দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত নিয়ে বেশি সরব হয়েছে। সিবিআই, ইডি-র তদন্তকে বিজেপির রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলে প্রচার করছে। আর এই দুর্নীতি নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব কাটাতে তৃণমূল নতুন করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের জনমুখী প্রকল্প নিয়ে প্রচারে নামছে। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর নবজোয়ার কর্মসূচিতে দুর্নীতির অভিযোগের জবাব দিচ্ছেন না। তার বদলে অভিষেক বলছেন, গ্রামে গ্রামে কন্যাশ্রী থেকে পথশ্রী প্রকল্পের সুবিধা পৌঁছেছে। কে তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন বা দেননি, তার বাছবিচার হচ্ছে না।

আমজনতাকে নানা সুবিধা পাইয়ে দিয়ে কি দুর্নীতির নালিশ ভুলিয়ে দেওয়া সম্ভব? কর্নাটকের ভোটের তিন সপ্তাহ আগে লোকনীতি-সিএসডিএস নামের গবেষণা সংস্থা রাজ্যে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল। সেই সমীক্ষায় কেন্দ্র বা রাজ্যের সরকারি প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি মানুষ জানিয়েছিলেন, তাঁরা বিজেপিকে ভোট দেবেন। উল্টো দিকে, দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্নের মুখে অর্ধেকের বেশি মানুষ জানিয়েছিলেন, বিজেপি জমানায় দুর্নীতি বেড়েছে। যাঁরা বিজেপি জমানায় দুর্নীতি বেড়েছে বলে জানিয়েছিলেন, তাঁদের প্রায় ৪৩ শতাংশ মানুষ বলেছিলেন, তাঁরা বিরোধী দল কংগ্রেসকে ভোট দেবেন। বিজেপি জমানায় দুর্নীতি বেড়েছে বলেও বিজেপিকে ভোট দিতে চাওয়া অন্ধভক্তের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩০ শতাংশ।

দুর্নীতির নালিশের মোকাবিলায় নরেন্দ্র মোদী কর্নাটকে তাঁর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। আস্তিন থেকে বেরিয়েছিল হিন্দুত্বের তাস। হিজাব থেকে লাভ জেহাদ ছিলই। ভোটের আগে অনগ্রসর মুসলিমদের জন্য সংরক্ষণ তুলে দিয়েছিল বিজেপি। মোদী তার সঙ্গে জয় বজরংবলীর স্লোগান জুড়েছিলেন। ‘হিন্দু খতরে মে হ্যায়’-এর পুরনো হাতিয়ারে শাণ দিতে মোদী অভিযোগ তুলেছিলেন, কংগ্রেস রামের পরে হনুমানকে অপমান করছে। অথচ মোদী দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনও বার্তা দেননি। ঈশ্বরাপ্পাকে বিজেপি এ বার প্রার্থী করেনি ঠিকই, কিন্তু টিকিট না পেয়েও দলের হয়ে কাজ করার জন্য মোদী তাঁর প্রশংসা করেছিলেন। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছিল, মোদীও কি দলের নেতাদের দুর্নীতি ও অনৈতিক কাজের পক্ষে!

কর্নাটকের ভোটের ফল দেখিয়েছে, হিন্দুত্বের তাসে সব সময় দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়া যায় না। এই মুদ্রারই উল্টো পিঠ হল, ধর্মনিরপেক্ষতার তাস খেলেও বার বার দুর্নীতির তির ঠেকানো যাবে না। পশ্চিমবঙ্গের গত বিধানসভা নির্বাচনে বহু মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের নানা সুবিধা পেয়ে তৃণমূলকে ভোট দিয়েছিলেন। তেমনই বহু মানুষ ‘সাম্প্রদায়িক শক্তি’ বিজেপিকে ঠেকাতেও তৃণমূলকে ভোট দিয়েছিলেন। কর্নাটকের মানুষ এ বার ‘হিন্দুত্বের বিপদ’-এর জুজু দেখানো সত্ত্বেও বিজেপিকে ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ ঠাহরে পদ্মফুলে ভোট না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গেও তেমনই বহু মানুষ সাম্প্রদায়িকতার জুজুর বদলে ভবিষ্যতে সরকারি স্তরে দুর্নীতিতে বেশি গুরুত্ব দিতে পারেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত স্বচ্ছ ভাবমূর্তিকে তৃণমূল এত দিন পুঁজি করেছে ঠিকই, দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না হলে তিনিও অনৈতিক কাজের পক্ষে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।

কর্নাটকের ভোটের ফলপ্রকাশের পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, “যখন মানুষ বহুত্ববাদ চান, গণতান্ত্রিক শক্তির জয় চান, কোনও পরিকল্পনা সেই স্বতঃস্ফূর্ততাকে দমন করতে পারে না। এটাই আসল কথা। এটাই আগামীর শিক্ষা।” মমতা যেটা বলেননি, তা হল, কর্নাটকের ফল সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের আগামী দিনের জন্যও শিক্ষা রেখে গেল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement