এ বারের বিধানসভা ভোটে বাংলার মানুষ বিজেপিকে রুখে দিয়েছেন। অথচ তৃণমূলের বিরুদ্ধে হাওয়া ছিল তীব্র। ২০১৮ সালে ‘বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত’ করতে গিয়ে বাম-কংগ্রেস কর্মী সমর্থকদের উপর তীব্র নির্যাতন হয়। বাংলার মানুষ তা ভাল ভাবে নেননি, প্রমাণ ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন। কেন্দ্রে ক্ষমতার সুযোগে ও মোদীর ভাবমূর্তি কাজে লাগিয়ে তৃণমূলবিরোধী ভোটকে নিজেদের দিকে টেনে আনে বিজেপি। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল ৪৪.৯১%, বামফ্রন্ট ২৫%, কংগ্রেস ১২.২৫%, বিজেপি মাত্র ১০.১৬% ভোট পেয়েছিল। তিন বছরের মধ্যে বিজেপি ত্রিশ শতাংশ ভোট বাড়িয়ে নিতে সক্ষম হয়।
বাঙালি মুসলমানের প্রতি হিন্দুদের একাংশের মধ্যে ঘৃণা তৈরির ক্ষেত্রে বিজেপি দেশভাগের ইতিহাসের বিকৃতির সঙ্গে তথাকথিত মুসলিম তোষণের অভিযোগকে মিলিয়েছে। শরণার্থী, অনুপ্রবেশকারী শব্দে ধর্মের ভিত্তিতে উদ্বাস্তু মানুষের মধ্যে বিভাজন ঘটিয়েছে। তথাকথিত বাম ভোটাররাও এই বাস্তবতার বাইরে নন। তাঁদের একটা বড় অংশ ২০১৯-এ বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন। এ বার এঁরা বিজেপির থেকে মুখ ফিরিয়েছেন, কারণ রুটিরুজির প্রশ্নে কেন্দ্রের বিভিন্ন নীতি সরাসরি তাঁদের ভাতের থালায় টান মেরেছে। দেশব্যাপী কৃষক আন্দোলন, কেন্দ্রের অমানবিক ও নিস্পৃহ নীতি বিজেপিকে চিনিয়েছে তাঁদের।
একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে রাষ্ট্রের নগ্ন উদ্যোগ, স্বয়ংশাসিত প্রতিষ্ঠানের উপর খবরদারি, গণতান্ত্রিক অধিকার সঙ্কোচন, জাতপাত, ধর্মের নামে উগ্রতা, শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-যুব আন্দোলন দমন, সংখ্যালঘু নির্যাতন, এই সবই ফ্যাসিবাদের লক্ষণ। বিজেপির শাসনকালে এই সবই দেখা গিয়েছে— নোটবন্দি করে দেশের অর্থনীতি ভেঙে দেওয়া, তিন তালাকের ক্ষেত্রে ফৌজদারি দণ্ডবিধি প্রয়োগ, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা অবলোপ, লাভ জেহাদ আইন, সমস্ত সমালোচনার কণ্ঠরোধ ও সর্বোপরি সিএএ। কোভিডের সুযোগে কেন্দ্রে বিজেপি সরকার সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতি লঙ্ঘন করে একের পর এক জনবিরোধী আইন পাশ করিয়েছে। কৃষক-স্বার্থ বিরোধী আইন, নয়া শ্রম কোড, ব্যাঙ্ক, বিমা, রেল, কয়লার বেসরকারিকরণ, পেট্রল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি, নয়া শিক্ষানীতি তার প্রমাণ। সমাজেও মাৎস্যন্যায়, স্রেফ মুসলমান বলে পিটিয়ে খুন করা হয়েছে মানুষকে। হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর মিছিল দেখিয়েছে ধর্ষণের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ও সমর্থন।
এই অবস্থায় ভারতের মুসলমান সমাজ ভুগেছে আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্বে। সেই অসহায়তার সুযোগে রমরমা হয়েছে আইডেন্টিটি পলিটিক্সের। এই পরিস্থিতিতে এক দিকে মুসলমানদের মধ্যে তৈরি নিরাপত্তাহীনতার ফয়দা তোলা শুরু করে তৃণমূল; অন্য দিকে মতুয়া বা রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষের চাষ শুরু করে আরএসএস-বিজেপি। প্রসঙ্গত, ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পর থেকেই রাজ্যে আরএসএস-এর প্রভাব বাড়তে শুরু করে। একই সঙ্গে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে বাড়ে অসরকারি খারিজি মাদ্রাসা, যেগুলির কাজ মূলত ইসলামের বিকৃত ব্যাখ্যা ছড়ানো। রাজ্যে সাম্প্রদায়িক বারুদ কম ছিল না, যার ফল প্রকট হয়েছে বিভিন্ন সুযোগে। খেটে খাওয়া হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি করা হল গোটা রাজ্যে। তাতে অর্থনৈতিক দুর্দশা, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ব্যর্থতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চাপা পড়ে যায়, রুটিরুজি-অধিকারের প্রশ্নে বামপন্থীদের তোলা জরুরি প্রশ্নগুলো মানুষের কাছে পৌঁছয় না। অন্য দিকে, জনগণের মৌলিক সমস্যার সুরাহা করতে না পারলেও রাজ্য সরকার বিনামূল্যে রেশন, দুয়ারে সরকার, কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী ইত্যাদির মাধ্যমে প্রান্তিক, গরিব ও শ্রমজীবী মানুষকে কিছু তাৎক্ষণিক সুরাহা পৌঁছে দিয়েছে। ফলে শাসক দলের হৃত জনসমর্থন শুধু ফেরতই আসেনি, খানিকটা বেড়েছে।
স্বপ্নভঙ্গ হওয়ায় বিজেপি এখন মরিয়া হয়ে ঝাঁপিয়েছে। পুরনো নারদ মামলায় তৃণমূল নেতাদের সিবিআই দিয়ে গ্রেফতার আসলে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির ষড়যন্ত্রের প্রথম ধাপ। কোভিডের মোকাবিলা সদ্য নির্বাচিত রাজ্য সরকারের এক অতি জরুরি ও কঠিন কাজ, লকডাউনে কলকাতা পুরসভা এলাকায় তা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অতিমারির মধ্যেও বিজেপির এই প্রতিহিংসার রাজনীতি বুঝিয়ে দিল, মানুষের প্রাণের মূল্য তাদের কাছে কানাকড়িও নয়।
আজ যাঁরা গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত বলে হাহুতাশ করছেন, ২ মে-র পরের রাজনৈতিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তাঁরা মুখ খোলেননি— মৃত, আহতেরা তথাকথিত অশিক্ষিত, সভায় ভিড় বাড়ানো সাধারণ মানুষ বলেই কি? ভোটের ফল বেরোনোর পর বিশেষত বিরোধী দলগুলোর সাধারণ কর্মীরা যখন অত্যাচারিত হচ্ছিলেন, তখনও গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল। তা নিয়ে মাতামাতি হয়নি কারণ শ্রেণিচরিত্রগত ভাবে ওঁরা ‘অপর’। গণতন্ত্রের চর্চা তৃণমূল স্তর থেকে না হলে ফ্যাসিবাদের দমকা হাওয়ায় উপরের কাঠামোটাও ভেঙে পড়তে বাধ্য।