বিষাইছে বায়ু...
Suvendu Adhikari

বাংলার ঘরে যত ভাই-বোন এক হউক, এক হউক

ল প্রকাশের পরেই দিল্লির ক্ষমতার বলে রাজ্যের সদ্য-নির্বাচিত সরকারকে কী ভাবে ঘিরে ফেলার চেষ্টা চলছে, সেটা স্পষ্ট।

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০২১ ০৫:০২
Share:

বিষ: রাজ্য নির্বাচন-পরবর্তী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অবস্থান বিক্ষোভে বক্তা শুভেন্দু অধিকারী। কলকাতা, ৫ মে। দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

কখনও কখনও ‘ছি’ শব্দটাও দুর্বল, নিরীহ মনে হয়। ক্রোধ, ধিক্কার ইত্যাদি প্রকাশের পক্ষে এর চেয়েও কোনও তীক্ষ্ণ, তীব্র শব্দ বলতে চাই। নজরুল বলেছিলেন, “দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি। তাই যাহা আসে কই মুখে।” হ্যাঁ, আজ হয়তো সত্যিই সেই ভাবে কথা বলার দিন।

Advertisement

বাংলার মানুষ বড় ‘পাপ’ করেছে। তারা উগ্র হিন্দুত্ববাদকে রাজ্যে মাথা তুলতে দেয়নি। বিজেপি কি তাই এ বার তারই মাসুল আদায় করতে নেমে পড়ল? ফল প্রকাশের পরেই দিল্লির ক্ষমতার বলে রাজ্যের সদ্য-নির্বাচিত সরকারকে কী ভাবে ঘিরে ফেলার চেষ্টা চলছে, সেটা স্পষ্ট। তার চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে প্রকাশ্যে সাম্প্রদায়িক উসকানি।

‘হিন্দুরা আক্রান্ত’ জিগির তুলে বিজেপি-র যাঁরা এটা করছেন, তাঁদের উদ্দেশ্য যে কত ‘মহৎ’, আজ তা জানা, বোঝা এবং ভাবা অত্যন্ত জরুরি। কোনও ব্যক্তি বা দলের রাজনৈতিক স্বার্থে নয়, দলমতনির্বিশেষে বাংলার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে সতর্ক করতে বিষয়টি তাই এড়িয়ে যাওয়া যায় না। কারণ ঘোষিত ভাবেই বাংলায় পুরনো দাঙ্গার স্মৃতি উসকে দেওয়ার এই অপকৌশল দুঃসময় ডেকে আনার উপাদানে ভরপুর।

Advertisement

রাজ্যে ভোট-পরবর্তী হিংসা নিয়ে রাজনীতি উত্তপ্ত। ভোটের ফলপ্রকাশের পরে প্রথম দু’-তিন দিনেই নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১২। বিভিন্ন জেলায় বেশ কিছু ঘরবাড়িতে ভাঙচুর চলে। মহিলাদের উপর হামলার অভিযোগও আসতে থাকে। ঘটনা সবই মিথ্যে, তা তো নয়। অবশ্যই ভোটের ফলের প্রতিক্রিয়ায় এগুলি ঘটেছে।

প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, নিহতরা কোনও একটি দলের নন। জয়ী তৃণমূল এবং পরাজিত বিজেপি-র অংশ সেখানে প্রায় সমান সমান। বস্তুত ওই ১২ জন নিহতের তালিকাতেও তৃণমূল একটু এগিয়ে। বিজেপির পাঁচ জন, তৃণমূলের ছ’জন এবং সংযুক্ত মোর্চার শরিক আইএসএফের এক জন সংঘর্ষে প্রাণ হারান বলে খবর। অর্থাৎ, কোনও পক্ষ একতরফা মেরেছে এবং অন্য পক্ষ মুখ বুঁজে অসহায় ভাবে তার শিকার হয়েছে, বললে তাতে সত্যের ঘাটতি থেকে যাবে।

তথাপি কিছু ঘটনা অবশ্যই উদ্বেগের যেমন, রাজ্যে এসে এক জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কনভয়ে হামলা হলে, তাতে লোকজন আহত হলে সেটা আইনশৃঙ্খলার পক্ষে শুভলক্ষণ হতে পারে না। যদিও ঘটনায় তৃণমূলেরই আট জনকে গ্রেফতার করে প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা দেখিয়েছে সরকার।

তবে যা-ই হোক, এ সব খুবই নিন্দনীয়, অনভিপ্রেত। যেখানে যে দলের লোকজনই এ সব মারামারি, খুনোখুনি করে থাকুক, তাদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ না করলে সেটা অন্যায়। ভুললে চলবে না যে, প্রশাসন তার ভূমিকা পালনে সর্বদাই দায়বদ্ধ। সেখানে দল নেই। বিভিন্ন ঘটনায় তৃণমূলের লোকজনকে গ্রেফতার করারও খবর আসছে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বাস্তব হল, ভোটের ফল বেরনোর পরে মারামারি, হামলা কোনও নতুন ঘটনা নয়। রাজ্যে অতীতেও এমন হয়েছে। উপরতলার নেতাদের এতে কোনও ইন্ধন বা নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তা সম্ভবও নয়। আসলে প্রবল উত্তেজনাপূর্ণ ভোটযুদ্ধের পর্বে নীচের তলায় যে সব উত্তাপ জমে থাকে, ফলের পরে তার উদ্‌গিরণ হয় এই ভাবে। ঠিক সেই কারণেই গণনা কেন্দ্রের মধ্যে হাতাহাতি, মারামারিও পরিচিত দৃশ্য। প্রসঙ্গত, ত্রিপুরায় বামেদের হটিয়ে বিজেপি ক্ষমতা দখলের পরে কী হয়েছিল? অভিযোগ, ফল প্রকাশের পরের দু’দিনে সিপিএমের ৫১৪ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন। আগুন লেগেছিল ১৯৬টি বাড়িতে। লুটপাট, ভাঙচুরে ক্ষতিগ্রস্ত আরও হাজার দেড়েক ঘরবাড়ি।

মানি, এ সবই বিতর্কের বিষয়। কেউ কোনও দিন নিজেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সহসা স্বীকার করে না। শাসক হলে তো কথাই নেই। সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেন্দ্র মোদী বা ত্রিপুরার বিপ্লব দেবের মধ্যে ফারাক নেই। তবে এটা ঘটনা যে, বিজেপি গদিতে বসলেই ‘রাম রাজ্য’ প্রতিষ্ঠিত হয় না। ক্ষমতার ‘লঙ্কাপুরী’তে সবাই ‘রাবণ’!

বাংলায় এ বারের ভোটে যে রকম টানটান উত্তেজনা ছিল, সবার মতেই তা অভূতপূর্ব। হিংসার প্ররোচনা, ব্যক্তিগত কুৎসা, কুৎসিত ভাষা প্রয়োগ তো ছিলই। অশালীনতাও মাত্রা ছাড়িয়েছিল এ বার।

সবার উপরে ছিল ন্যক্কারজনক সাম্প্রদায়িক উসকানি। বিজেপি খুব খোলাখুলি এই তাসটি খেলেছিল সত্তর শতাংশ হিন্দু ভোট এককাট্টা করতে। ভোটের ফলে প্রমাণিত, বাংলা সেই খেলায় প্ররোচিত হয়নি। তাতেই গরুর লেজে টান পড়েছে!

মমতার সম্পর্কে ‘সংখ্যালঘু পোষণ’ করার প্রচার খানিকটা মানা গেলেও তাঁকে ‘হিন্দু-বিরোধী’ সাজানো একেবারেই বিজেপি-র মস্তিষ্কপ্রসূত অভিসন্ধি। মমতা দুর্গাপুজোর বিরোধী, মমতা সরস্বতী পুজো বন্ধ করেছেন জাতীয় নির্জলা মিথ্যাগুলি ছড়িয়ে দিতে বিজেপি নেতাদের বক্তৃতা থেকে শুরু করে ওই দলের ‘অনুগত’ সামাজিক মাধ্যম সবই কাজ করেছে।

যেটা আরও নজিরবিহীন, তা হল সময় বিচার। মুখ্যমন্ত্রী শপথ নেওয়ার আগেই রাজ্যে রাষ্ট্রপতির শাসন জারির দাবি শুরু হয়ে গেল। শপথের পর দিন ধেয়ে এলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অফিসাররা। রাজ্যপাল পর্যন্ত মমতাকে দোষারোপ করতে শুরু করলেন। শপথ অনুষ্ঠানে সেটা বে-আব্রু হয়ে গেল।

বিজেপি-র নেতাগণ এবং দেশের শাসকবর্গ কেন এত ধৈর্যচ্যুতি ঘটাচ্ছেন, তার কারণ অনুমান করা কঠিন নয়। ভোটে বিপর্যস্ত হয়ে তাঁরা প্রত্যাঘাতের পথ খুঁজছেন। কথায় বলে, গরু হারালে মাথার ঠিক থাকে না! আর এ তো পুরো রাজ্য দখলের স্বপ্নভঙ্গ!

২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন মাথায় রাখলে বলা যেতে পারে যে, হয়তো মমতাকে চাপে রেখে তার সলতে পাকানো এ ভাবেই শুরু করতে চাইছে বিজেপি। এখন এই রাজনৈতিক লড়াইয়ের মোকাবিলা মমতা কী ভাবে করবেন, মানুষ হেরে যাওয়া বিজেপি-র এই রকম পদক্ষেপকে কী ভাবে নেবে, সে সব ধাপে ধাপে বোঝা যাবে।

এই মুহূর্তে সবচেয়ে উদ্বেগের হল সাম্প্রদায়িক প্ররোচনা। দাঙ্গার মর্মান্তিক, কলঙ্কিত ইতিহাস বুকে ধরে রাখা বাংলায় বিজেপি এ বার সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসা ছড়াতে আগুন নিয়ে খেলায় মত্ত হল!

মমতা যে দিন মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন, ভোট-পরবর্তী সন্ত্রাসের প্রতিবাদে সে দিন ওই অনুষ্ঠান বয়কট করেছিল বিজেপি। ওই সময় হেস্টিংসে তাঁদের দলের দফতরে অবস্থান আন্দোলনে বসেছিলেন বিজেপি নেতারা। গণতান্ত্রিক ভাবে এটা তাঁরা করতেই পারেন। কিন্তু সেখানেই বক্তৃতায় ছড়ানো হল সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষ।

ওই সভায় শুভেন্দু অধিকারী বললেন, “পশ্চিমবাংলায় হিন্দুরা আক্রান্ত। বেছে বেছে হিন্দুদের উপর আক্রমণ হচ্ছে।” নরেন্দ্র মোদীর কাছে তাঁর আহ্বান, “আপনি হিন্দুদের বাঁচান।” বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষকে মঞ্চে সাক্ষী রেখে শুভেন্দু তুলে ধরলেন ১৯৪৬-এর ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’-এর কথাও।

নন্দীগ্রামে মমতাকে ভোটে ‘হারিয়ে’ শুভেন্দু ডগমগ। তিনি তাই সভায় দাঁড়িয়ে মোদীর উদ্দেশে বলতে পারেন, “কাশ্মীরে যদি দমন করা যায়, তা হলে এখানেও করা যাবে। এক দিনের কাজ!”

বিজেপি-র নব্য নায়ক আরও জানিয়েছেন, কলকাতার ওই দাঙ্গা সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান আছে। সত্যিই জানেন? তা হলে তিনি নিশ্চয় জানবেন, ১৯৪৬-এর অগস্টে ওই দাঙ্গার পরে নভেম্বরে হাউস অব কমন্‌স-এ তথ্য পরিসংখ্যান দিয়ে বলা হয়েছিল, কলকাতার দাঙ্গায় মৃত ৫০১৮। আহত ১৩,৩২০। প্রবীণ যাঁরা সেই দাঙ্গার স্মৃতি বুকে আজও জীবিত, তাঁরা এক জনও কি সেই দিন ফিরিয়ে আনতে চান? যাঁরা সেই ইতিহাস পড়েছেন, তাঁরা দিনগুলির কথা ভেবে দুঃস্বপ্ন দেখেন।

শুধু বিজেপি-র ‘বীর যোদ্ধারা’ চান সেই সব দিন ফিরে আসুক। কারণ বিজেপি-কে পরাস্ত করে বাংলা মমতাকে ফের ক্ষমতায় এনেছে।

ইতিহাস তার নিজের ভাষায় কথা বলে। সেখানে বাংলায় সম্প্রীতির ঐতিহ্য স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। কোন দল ক্ষমতা পেল, তা দিয়ে সেই ঐতিহ্যকে ধ্বংস করা সহজ কাজ নয়। মোদীর ‘সোনার বাংলা’র সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার বাংলা’-র এটাই সবচেয়ে বড় তফাত। এই বাংলা সাম্প্রদায়িক হিংসা উদ্রেককারীদের চিহ্নিত করতে পারে। বলতে পারে, বাংলার ভাই-বোন ‘এক’ আছে এবং থাকবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement