শব্দ ও সত্যের ক্ষতবিক্ষত সন্ধান যে কবির স্বতঃস্ফূর্ততার মধ্যেই
Shakti Chattopadhyay

কবিতায় খোঁজা সময়ের মুখ

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নামের সঙ্গে লোকপুরাণের যে-সব গুঁড়ো এখনও ইতস্তত উড়ে বেড়ায়, সে-সব মিথ স্পর্ধার, যৌবনের, তছনছ এক জীবনযাত্রার।

Advertisement

সুমন্ত মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০২২ ০৫:২৬
Share:

বাঁচাকাহিনি: কফিহাউসের আড্ডায় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা।

গত নভেম্বর মাসে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নব্বই বছর পূর্ণ হওয়ার দিনটি স্মারক বক্তৃতা আর কয়েক জন কবির কবিতাপাঠের মধ্য দিয়ে উদ্্যাপিত হল। সোশ্যাল মিডিয়ায় শ্রদ্ধা নিবেদিত হল কিছু। হেমন্তের শুকনো পাতা খড়খড় করে উড়ে গেল রাস্তায়। পোস্টম্যান-এর দেখা পাওয়া গেল না। আর বছর দশ কাটলেই বলা যাবে, ‘তুমি তাকে ভালোবেসেছ নিরুদ্বেগে/ শতবর্ষের কবি’। নিবিষ্ঠ পাঠক জানেন তাঁকে অমন ভাবে নিরুদ্বেগে শিকেয় তুলে ফুল মালা দিয়ে ভালবাসা অসম্ভব। একটি কবিতায় তিনি লিখেছিলেন, ‘বহুবার হারিয়েছে বলে আজ কেউ/ লোকটিকে খোঁজে না আর’। অথচ বাংলা-ভাষাভাষীর সাংস্কৃতিক আমানত যখন শূন্যের কোঠায় নামছে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো কবি-কে নিয়ে বার বার কথা বলা দরকার।

Advertisement

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নামের সঙ্গে লোকপুরাণের যে-সব গুঁড়ো এখনও ইতস্তত উড়ে বেড়ায়, সে-সব মিথ স্পর্ধার, যৌবনের, তছনছ এক জীবনযাত্রার। সাধারণ মানুষ সে জীবন কোনও দিন যাপন করতে চাইবে না, তবু ওই পুড়তে দেখা মানুষটিকে মাথায় তুলে নেবে। শক্তি এক দিন এই জন-ইচ্ছের সমর্থনে মধ্যরাতে পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল হেঁটে এসেছিলেন আমাদের অবদমিত স্পর্ধার স্বেচ্ছাচারী যুবরাজ হয়ে। আজ থেকে বছর ষাট আগে ফিরে গেলে, এ পার বাংলার সদর-মফস্সলে দেখতে পাব, তাঁকে কেন্দ্র করে আমাদের মনে গড়ে উঠেছে ‘কবি’র এক নতুন চেহারা। কবিত্বের সংজ্ঞায় তাঁর অনিবার্য সংযোজন ছিল এক নিয়মভাঙা উন্মাদনা। একই সঙ্গে কলকাতা শহর আর দূর মফস্সলে ‘কবি’-কে তিনি করে তুলেছিলেন বেপরোয়া আর বেলাগাম প্রেমিক পুরুষ। স্বাধীনতার বছর পনেরো কাটিয়ে যে পুরুষ একই সঙ্গে প্রশ্ন তুলতে পারে প্রতি দিনের গয়ংগচ্ছ জীবনকাহিনিতে। জানাতে পারে অক্লেশে ‘মেয়ে দেখিয়াছি খুব। মেয়েদের বাবাদেরও দেখিয়াছি;/পার্থক্য যথেষ্ট’। অনর্গল ফোয়ারার মতো স্বতঃস্ফূর্ত বেরিয়ে আসছে কবিতার আশ্চর্য সব লাইন যেন ওই বাঁচাকাহিনির ভিতর থেকেই। যে জীবনের আঁচ আমরা আড়েঠারে সবাই পাই, কিন্তু যার ধারেকাছে যাই না।

উড়নচণ্ডী জীবনযাপন নয়, তাঁর আকস্মিক প্রয়াণের প্রায় তিরিশ বছরের কাছাকাছি এসে, ওই কিংবদন্তি সরিয়ে দেখা দিচ্ছে সময়ের মুখ— ‘সে বড় সুখের সময় নয়’। মানুষ কিংবা কবি না, বিখ্যাত সে কবিতায়— স্বেচ্ছাচারী ছিল রাতের কল্লোল। সে কি সময়-স্রোত নয়? অন্ধকার এক খরস্রোতা নদীর উল্লেখ উপমায়-প্রতিমায় বার বার দেখা দিয়ে যায় তাঁর কবিতায়। সেই প্রবল টান কাকে কখন কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যায় কে জানে। শক্তি চট্টোপাধ্যায় এই অজানা ভয়ানক জলস্রোতের ভিতর তলিয়ে সময়ের আঁতের খবর আমাদের জন্য তুলে এনেছিলেন।

Advertisement

কবে কোথায় কী ঘটেছিল, কেন ঘটেছিল সেই সব জেনে নিয়ে কবিতার দিকে যাওয়া যায়, সেই ভাবে জানতে চায় অনেকে। কিন্তু যেখানে মনে হয় মানুষের ইতিহাসে কিছুই প্রায় ঘটেনি, এমনকি সেইখানকারও কবিতা দিয়ে সময়কে পড়া যায়। এই অর্থেই খাঁটি ইতিহাস অন্তর্দৃষ্টির আকারে লেখা থাকে কবিতার মর্মে। সত্যিকারের কবি, দার্শনিক নন, তবু তাঁর কলমে দর্শনের হাজার কূটতর্কের কাটাকুটি আর জিজ্ঞাসা মুহূর্তে সমাধান খুঁজে পেতে পারে। তাই, দর্শনের লিখন নিয়ে সংশয়ী হ্বিটগেনস্টাইন, এক দিন দর্শন লিখতে চাইছিলেন যে ভাবে কবিতা লেখা হয়।

কবি ইতিহাস লেখেন না, কিন্তু নিজের সময়ের সঙ্গে দূর-সময়ের একটা সংলাপ রচিত হয় কবিতায়- যা ইতিহাসের ভিতরের সত্যিকে শত-জল-ঝর্নার ধ্বনিতে জাগিয়ে রাখে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জীবন কাহিনির মিথ ভুলে গিয়ে যদি কেউ পড়েন, ‘সকল সৌন্দর্য ছারখার হলে অধঃপতনের/ ক্রমাগত শব্দ এসে আমাদের কান ধরে টানে’, আর সেখানে সহসা শুনতে পাওয়া যায় ‘মনুমেন্টের নিচে, অন্ধকারে ক্রুদ্ধ বাংলাভাষা…’, তখন বোঝা যায় কেন তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘একা, বিংশ শতাব্দীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছি’। কাজটা সবার নয়, কাজটা সহজও নয়। কবিতা লেখা, লিখতে পারা এক অমানুষিক পরিশ্রমের কাজ। জিনিসটা ঠিক দু’চার মিনিটের ব্যাপার নয়। ছন্দ-মিল দিয়ে বা একটু বাঁকিয়ে সামাজিক বা রাজনৈতিক নীতিজ্ঞান দিলেই লেখাটা কবিতা হয় না। এই শ্রমের প্রস্তুতির কোনও ধারণাই অনেক সময় থাকে না আমাদের।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার ভিতর, তাঁর সারা জীবনের সাহিত্যকৃতির পাতায় পাতায় এই অপরিসীম পরিশ্রমের ইতিহাস লুকানো আছে। বাইরে যার অনর্গল চেহারায় ভুলে থাকছেন পাঠক। তাঁর শতবার্ষিকীর দিকে যেতে যেতে আমাদের কাজ, সেই শ্রম আর মেধার চেহারাটা খুঁজে আনা। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদ কবিতার দিকে যদি তাকানো যায়, দেখা যাবে নিজের মনঃস্বভাবী কবিদের তিনি খুঁজে দেখছেন না, অনুবাদ করছেন গীতা কিংবা রিলকের দুইনো এলেজি। যেখানে অতীন্দ্রিয়ের প্রকাশ-ভাষা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। প্রকাশ, ভাষা বা শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে যাঁর সিদ্ধি আমাদের মনে হয়েছে কল্পনাতীত, অক্লেশে যিনি চূড়ান্ত অপশব্দের সঙ্গে বিবাহ দিতে পারেন সাধোত্তমের, সেই শক্তি চট্টোপাধ্যায়ই ভাষার অর্থবহ একক ‘শব্দ’ আর কবিতা লেখার রহস্য নিয়ে অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। কবিতার শব্দ খুঁজে আনা তাঁর কবিতায় নানান অনিশ্চয় চেহারায় ধরা আছে। স্বতঃস্ফূর্ত কবি-স্বভাবের যে গল্প পাঠকসমাজে গড়ে উঠেছিল এক দিন, সে-কাহিনির বদলে এক শব্দসন্ধানী কবির ক্ষতবিক্ষত চেহারা ফুটে ওঠে, ‘বুকের রক্ত মুখে তুললেও কবি বলে মানায় না হে’।

এই রক্ত তোলা শ্রম শুধু শব্দ ব্যবহারেই নয়, কবিতার নতুন নতুন পথের হাতছানিতেও। ওঁর কবিতা নিয়ে মুগ্ধ অনেকেই শেষ কুড়ি-পঁচিশ বছরের লেখায় নতুন কোনও প্রকাশভঙ্গি খুঁজে পাননি। কিন্তু কবিতায় নতুন প্রকাশভঙ্গিই একমাত্র মনঃস্থাপন করার জায়গা নয়। পুরনো পথে চলার সময় পায়ের শব্দ নতুন স্বর নিয়ে দেখা দিতে পারে। শক্তির কবিতায় শেষ জীবনের এই স্তবের দিকে পাঠককে টেনে নিয়ে গেছেন তাঁর উত্তরসাধক কবি জয় গোস্বামী। অবাক হয়ে আজ যদি পথ-সন্ধানের কথাই ভাবি তা হলে প্রথম পনেরো বছরের কবিতায় আমরা এত অজস্র রাস্তা দেখতে পাব, যার তুলনা পৃথিবীর কবিতায় মেলা শক্ত হবে। শুধু উনিশশো বাষট্টি-তেষট্টি সালে তাঁর কবিতার উদাহরণ যদি দেখেন কেউ, তাজ্জব হয়ে খুঁজে পাবেন কখনও একই দিনে দশ বারোটি বিপরীতধর্মী কবিতা তিনি লিখতে পেরেছেন। তাঁর চেতনায় এই কালস্রোত নানা ভঙ্গিতে ছাপ রেখে গেছে।

নব্বই বছর বয়স পর্যন্ত সকলে পৌঁছতে পারে না। উদ্‌যাপন তবুও জরুরি। এই কবিই এক দিন লিখেছিলেন ‘সবার বয়েস বাড়ে আমার বালক বয়েস বাড়েনা কেন’, আর এও তাঁর জানা ‘এখন সবাই আগ বাড়িয়ে বৃদ্ধ বলে’, ‘আসলে আমি পুরনো এক বকের মতো সাদা’। বস্তুত, কবির বয়স সংখ্যা নয়— কবিতার সঙ্গে তার সম্পর্কের টানাপড়েন-এ তাঁর কবিতা, তরুণের হাতে তরুণ, বৃদ্ধের হাতে জরাভারাতুর। তাঁর বার্ধক্যের প্রান্তসীমায় যেমন যুবকের আর্তি লিখতে পেরেছেন শক্তি, তেমনই তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতায় লেগে আছে হিম মৃত্যুকথা। ফুটপাতের বাচ্চাদের মতো, এত রকমের অভিজ্ঞতা আঘাত করতে থাকে কবির চেতনায় যে সময় নিজেই হয়ে দাঁড়ায় তাদের আসল বয়স।

একা, বিংশ শতাব্দীর মুখোমুখি দাঁড়ানোর কথা বলেছিলেন শক্তি, ধ্বনিসাযুজ্যে সে উচ্চারণ একবিংশ শতাব্দীর কানে পৌঁছলে আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এই অন্যতম নায়ককে নতুন করে পড়া শুরু হবে। ‘অস্তিত্বের বড় কাছে হে প্রিয় তোমার আক্রমণ’— বিজন ভট্টাচার্যের এলিজিতে লিখেছিলেন তিনি। নিজেদের অস্তিত্বের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে পারলে এক বার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে হয়তো খুঁজে পাব আমরা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement