দিশারি: বঙ্গদর্শন মাসিকপত্রের প্রথম সংখ্যা।
দেড়শো বছর আগে বঙ্গদর্শন পত্রিকার ‘পত্রসূচনা’য় বঙ্কিমচন্দ্র যে উদ্দেশ্য সাধনের কথা ঘোষণা করেছিলেন সেই উদ্দেশ্য আমরা আজও সাধন করতে পারিনি, বরং তা থেকে বহু দূরে চলে গিয়ে নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতি-রাজনীতিকে ক্রমশই বেহাল করে তুলেছি। আমাদের ‘বঙ্গদর্শন’ নেই, ‘রঙ্গদর্শন’ই যেন তা-ই হালে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। সেই রঙ্গের নানা রূপ, তার এক রূপ হল এক দিকে সাধারণ নানা বিপদ-আপদ-বেনিয়ম-প্রবঞ্চনায় হাবুডুবু খাচ্ছেন, আর উল্টো দিকে বিশিষ্ট এক শ্রেণির মানুষ কিছুতেই-কিছু আসে যায় না ভঙ্গিতে নিরাপদে উচ্চ-আয়ে দিন কাটাচ্ছেন।
বঙ্কিম বঙ্গদর্শন-এর মাধ্যমে কোন উদ্দেশ্য সাধন করতে চেয়েছিলেন? ‘পত্রসূচনা’য় লিখেছিলেন, “আমাদিগের ভিতর উচ্চ শ্রেণী এবং নিম্ন শ্রেণীর লোকের মধ্যে পরস্পর সহৃদয়তা কিছুমাত্র নাই। উচ্চশ্রেণীর কৃতবিদ্য লোকেরা মূর্খ দরিদ্র লোকদিগের কোন দুঃখে দুঃখী নহেন। মূর্খ দরিদ্রেরা ধন্বান এবং কৃতবিদ্যদিগের কোন সুখে সুখী নহে। এই সহৃদয়তার অভাবই দেশোন্নতির পক্ষে সম্প্রতি প্রধান প্রতিবন্ধক।” সোজাসাপ্টা কথা। বাক্যের জটিলতা নেই, অলঙ্কারের মারপ্যাঁচ নেই। বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণির মধ্যে যোগাযোগহীনতাই যে দেশোন্নতির প্রধান প্রতিবন্ধক, গণপরিসরে এই জরুরি কথাটি বঙ্গদর্শন-এর আগে এ ভাবে সোজাসুজি বলা হয়নি। বঙ্কিমচন্দ্র বলতে পেরেছিলেন। ১৮৭০-এ ‘আ পপুলার লিটারেচার ফর বেঙ্গল’ বক্তৃতা-নিবন্ধে ইংরেজিতে যাঁদের ‘ওয়েল-এডুকেটেড ক্লাস’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন তিনি, বঙ্গদর্শন-এ সেই ইংরেজি-শিক্ষিত, অর্থনৈতিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত শ্রেণিটিকেই ‘কৃতবিদ্য’ বলে নির্দেশ করলেন। এঁরা সংখ্যালঘু কিন্তু এঁদের মতামত, ভাবনা-চিন্তার গুরুত্ব সামাজিক বিন্যাসে উপরে থাকার ফলেই অনেক বেশি। সেই ভাবনা-চিন্তা দেশের সংখ্যাগুরু মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত হয় না। দুই পক্ষের মধ্যে তাই বিচ্ছেদের দূরত্ব ক্রমশই যোজন ছাড়ায়। টেলিগ্রাফ বসে, রেললাইন বসে, বঙ্গদর্শন-এর বঙ্কিম-সম্পাদিত প্রথম চার বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পর ইংরেজি-জানা ভদ্রলোকদের জন্য ‘কংগ্রেস’ তৈরি হয়, কিন্তু হাসিম শেখ-রামা কৈবর্ত সেই তিমিরেই থেকে যান।
কৃতবিদ্যের সঙ্গে সাধারণের সংযোগ স্থাপনের জন্য বঙ্কিমচন্দ্র যে বিষয়টির উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন তা হল ভাষা। বঙ্গদর্শন বাংলা ভাষার সামর্থ্যকে বহুগুণিত করে দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “যখন ‘বঙ্গদর্শন’ প্রথম বাহির হয়েছিল, তখন আমি যুবা বা তার চাইতেও কম বয়সে; আমি প্রাণের সেই স্বাদ পেয়েছিলুম। বাংলা ভাষা এখন অনেক পরিপূর্ণ; তখন নিতান্ত অল্পপরিসর ছিল। একলাই তিনি একশো ছিলেন। দর্শন, বিজ্ঞান, নভেল, সমালোচনা, কথা প্রভৃতি সকল দিকেই তিনি অগ্রসর হয়েছিলেন... বাংলা ভাষা পূর্বে বড়ো নিস্তেজ ছিল; তিনি একাই একে সতেজ করে গড়ে তুলেছিলেন।” বাংলা ভাষাকে দর্শন-বিজ্ঞান-নভেল-সমালোচনার উপযুক্ত করে তুলতে বঙ্কিম ভাষার ক্ষেত্রে কতকগুলি শর্ত মেনে চলতেন। তিনি বিষয়ানুসারী ভাষার পক্ষপাতী; যেমন বিষয়, তেমনই ভাষা। বিজ্ঞান লিখতে গিয়ে নভেলের ভাষা প্রয়োগ চলবে না, নভেল লিখতে বসে দর্শন রচনা নিষ্প্রয়োজন। ভাষার কাজ নানা রকম, প্রতিটি ক্ষেত্রেই সংযোগের উপযুক্ত ভাষা গড়ে তোলা চাই। ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে তিনি অহেতুক জটিলতা এড়িয়ে চলেন। পরবর্তী কালে বাংলা ভাষা ব্যবহারকারীদের ম্যানুয়াল সহজ রচনা শিক্ষা-য় লিখেছিলেন, “তোমার যাহা বলিবার প্রয়োজন, রচনায় তাহা যদি প্রকাশ করিতে না পারিলে, তবে রচনা বৃথা হইল।” এই মনের কথা বলার জন্য তাঁর মতে, “যে কথাটিতে তোমার কাজ হইবে, সেই কথাটি ব্যবহার করিবে। তাহা শুনিতে ভাল নয়, কি বিদেশী কথা, এরূপ আপত্তি গ্রাহ্য করিও না।”
কৃতবিদ্য ও সাধারণের মধ্যে সহৃদয়তা স্থাপনের জন্য এই ভাষারীতি বঙ্কিম এর আগেই বঙ্গদর্শন পর্ব থেকে সাধারণ পাঠকদের জন্য মেনে চলতেন। ‘পত্রসূচনা’ অংশে ইংরেজ উপনিবেশের শিক্ষাব্যবস্থায় অনুসৃত মেকলের নীতির বিরোধিতা করে লিখেছিলেন, “একটা কথা উঠিয়াছে এডুকেশন ফিল্টর ডৌন করিবে।... বিদ্যা, জল বা দুগ্ধ নহে, যে উপরে ঢালিলে নীচে শোষিবে।” লক্ষ করার, ইংরেজি ‘ফিল্টর ডৌন’ শব্দবন্ধকে কঠিন সংস্কৃত শব্দ দিয়ে প্রকাশের চেষ্টা তিনি করলেন না, বরং বিষয়টি বোঝানোর জন্য একটি সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কার অনায়াসে ব্যবহার করলেন। ‘ফিল্টর ডৌন’ কৃতবিদ্যদের চেনা, এ শব্দের অর্থ তাঁদের ভেঙে বলার, বা কঠিন সংস্কৃত পরিভাষা ব্যবহার করে বোঝানোর দরকার নেই। সাধারণ মানুষ শব্দটি শুনলেও পুরো মানে হয়তো জানেন না। তাঁদের কাছে পৌঁছনোর পদ্ধতি আলাদা। দেবতার মাথায় জল বা দুধ ঢালা জনসাধারণের পক্ষে ছবিটি সহজ ও বোধগম্য। বিদ্যা জল বা দুধ নয়, উপরে ঢাললে নীচের মাটি ভিজবে না। কাজেই মেকলে বাদামি সাহেবদের তৈরি করলে তাঁদের নীচের তলার সাধারণের বিদ্যা বিষয়ে কোনও উপকার হবে না। উপকার তখনই সম্ভব, যখন উপর-নীচের মধ্যে বোঝার মতো ভাষায় কথাবার্তা চলবে। সেই বোঝার মতো ভাষা তৈরি করাই ছিল বঙ্গদর্শন-এর উদ্দেশ্য। সেই ভাষায় শুধু নভেল নয়, দর্শন-বিজ্ঞান-ইতিহাস-সমালোচনা লেখার দায়িত্ব বঙ্গদর্শন গ্রহণ করল।
কারা পড়তেন বঙ্গদর্শন? প্রথম বর্ষের গ্রাহক তালিকা অনেক কথা বলে। বঙ্গদর্শন-এর গ্রাহক ভারতের নানা প্রদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। ‘আলাহাবাদ’-এর শ্যামাচরণ মিত্র, পাবনার হেমচন্দ্র সরকার, লখনউয়ের এজেন্ট, বারাণসীর হরিশ্চন্দ্র, মুরাদপুরের ইন্দ্রনারায়ণ তেয়ারি এমন কত জন বঙ্গদর্শন-এর পাঠক। সে সময় সাময়িকপত্রের লাখ-লাখ পাঠক ছিল না, তাই ভারতের নানা প্রদেশে বঙ্গদর্শন-পাঠকের উপস্থিতির বিষয়টি কৌতূহলোদ্দীপক। বঙ্কিম ভারতের নানা প্রদেশে তাঁর পত্রিকার মূল উদ্দেশ্য পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন। উনিশ ও বিশ শতকে বিভিন্ন প্রাদেশিক ভারতীয় ভাষা গদ্যরচনার মাধ্যমে কৃতবিদ্য ও সাধারণের যোগসাধনে সচেষ্ট হয়। এই সচেষ্টতার সূত্রপাত বঙ্গদর্শন-এ হয়েছিল, সে মডেল অনেকেই অনুসরণ করেন। সাধারণের সঙ্গে কৃতবিদ্যের যোগসাধনের জন্য শুধু ভারতীয় ভাষায় আধুনিক পাশ্চাত্য বিদ্যাচর্চার খবর দিলেই চলবে না; প্রাগাধুনিক পর্বে সাধারণের সঙ্গে কথকতার যে যোগ ছিল, মুদ্রিত মাধ্যমেও তার প্রতিষ্ঠা দরকার। বঙ্কিমের বঙ্গদর্শন-এ তাই প্রাগাধুনিক বঙ্গভাষা-সাহিত্য বিষয়ক নানা রচনা। ১৯১০-এ লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া বাঁহী পত্রিকার মাধ্যমে অহমিয়া ভাষায় কৃতবিদ্য ও সাধারণের যোগসাধন করতে চেয়েছিলেন। অহমিয়া সংস্কৃতির আত্মপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রকাশিত এ পত্রিকা এক দিক থেকে বঙ্গদর্শন মডেলের অনুসারী: ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে জামাতা-সম্বন্ধে সম্পর্কিত লক্ষ্মীনাথের কাছে বঙ্কিম ও বঙ্কিম-পরবর্তী সম্পাদকদের বঙ্গদর্শন অপরিচিত ছিল না। অহমিয়া ভাষার আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য যেমন সহজ গদ্যে সাধারণের জন্য সুযুক্তির অবতারণা করেন, তেমনই প্রাগাধুনিক অহমিয়া ভক্তি সাহিত্যের কথাও জানাতে ভোলেন না তিনি।
বঙ্কিম বঙ্গদর্শন প্রকাশের সময় জানতেন, উনিশ শতকে গড়ে ওঠা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে সাধারণের প্রবেশাধিকার সীমিত। সংস্কৃত কলেজ, হিন্দু কলেজ সকলের জন্য নয়। সিপাহি বিদ্রোহের বছর তৈরি হওয়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তখন মোটের উপর পরীক্ষা নিয়ামক সংস্থা, টিচিং ইউনিভার্সিটি নয়। সুতরাং, পত্রিকার পরিসরই ভরসা, গণ চাইলে তা পড়তে পারেন। বঙ্কিমের এই ভাবনা রবীন্দ্রনাথকেও প্রভাবিত করেছিল। ১৮৯২ সালে ‘শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধে মাতৃভাষায় বিদ্যাচর্চায় গুরুত্ব দিয়েছিলেন তিনি, বঙ্কিমের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছিলেন। কংগ্রেসের প্রাদেশিক সভায় রবীন্দ্রনাথ ইংরেজির পরিবর্তে প্রাদেশিক ভাষা ব্যবহারের পক্ষপাতী। বঙ্গভঙ্গের সময় বাউল সুরে দেশের গান লেখার উদ্দেশ্যও তাই, সাধারণের সঙ্গে কৃতবিদ্যের সহৃদয়তা স্থাপন। রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহ ও লোকশিক্ষা গ্রন্থমালা বঙ্গদর্শন-এর উদ্দেশ্যকেই সম্প্রসারিত করেছিল। ভারতীয় রাজনীতিতে গান্ধী এই ভাষা বিষয়টিকে গভীরতর মাত্রা দিয়েছিলেন। নোয়াখালি পর্বে স্লেটে তাঁর বাংলা হরফ অভ্যাস নিতান্ত খেয়াল নয়, আহত ও নিহতদের কাছে তাঁদের ভাষায় অহিংসার ভাবনা পৌঁছে দিতে তিনি তৎপর।
দুঃখের, এ প্রকল্প আর আমরা কার্যকর করতে চাই না, চাই না বলেই পারি না। বহু কৃতবিদ্য আজকাল বাংলা ভাষায় লেখার কথা ভাবেন, লেখেনও, কিন্তু সে লেখা বহু ক্ষেত্রেই তাঁদের ভাবনার ‘অসহজ’ প্রকাশ— ভাষা নিয়ে না ভাবলে যা হওয়ার তা-ই হয়। বঙ্গদর্শন-হারা বাঙালির রঙ্গদর্শন আমাদের ক্রমে কূপবর্তী করে তুলছে।
বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী