বিক্ষুব্ধ: মৃত ছাত্রের ন্যায়বিচারের দাবিতে যাদবপুর থানার সামনে শিক্ষার্থীদের অবস্থান বিক্ষোভ, ১১ অগস্ট। দেশকল্যাণ চৌধুরী।
রাষ্ট্রীয় স্তরে স্বৈরাচারী আধিপত্যবাদের নখদাঁত যখন চার দিকে ত্রাসের সঞ্চার করছে, ঠিক তখনই ঘরের কাছে আর এক স্বৈরাচারী আধিপত্যবাদের উৎকট প্রকাশ সজোরে ধাক্কা দিল আমাদের। যাদবপুরের হস্টেলে নাকি মুক্তমনা, প্রগতিপন্থী সব ছাত্রের বাস, তাদেরই হাতে এক নবাগত ছাত্রের হত্যা! দ্বিতীয়োক্ত আধিপত্যবাদীরা আবার নাকি প্রথমোক্ত আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে খুবই সরব।
ঘটনার পর যথারীতি দোষারোপের পালা। ছাত্র সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলির পারস্পরিক দোষারোপ। বিশ্ববিদ্যালয়টিকে দোষারোপ বাদবাকি সমাজের— যেন যাদবপুর একটি পিশাচসদৃশ ও সমাজবহির্ভূত ‘প্রাণী’; এবং র্যাগিং যেন যাদবপুর ছাড়া আর কোথাও হয় না। রাজনৈতিক তাগিদে সমাজমাধ্যমে সত্য ও মিথ্যার স্রোত মিলেমিশে সবেগে ধাবমান। প্রতিবাদ মিছিলও অনেক হচ্ছে, ঠিক কার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সেটা যদিও স্পষ্ট নয়। মিছিলের কেউ কোনও দিন র্যাগিং করেননি, বা অন্য কোনও রকম আধিপত্যবাদে মদত দেননি, এমনটাও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। আসলে অন্যের উপর দোষ চাপাতে পারলে নিজে দায়দায়িত্ব কিছু নিতে হয় না। সমস্যার মূলে যেতে গেলে হয়তো নিজের বা বন্ধুপরিজনদের দিকেও আঙুল তুলতে হয়! কেউ কেউ বলছেন বটে, র্যাগিং সামাজিক ব্যাধি; তবে ওই পর্যন্তই। আসলে সমাজটা যেমন চলছে, মোটের উপর তেমনই চলতে থাকুক, এটাই অধিকাংশ মানুষ চান। তাই মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও দেখছি বিচ্ছিন্ন বিকৃত ব্যক্তিমানসিকতার ব্যাখ্যান, সামাজিক স্তরে আলোচনা নয়।
অথচ ব্যক্তিমনে স্বৈরাচারী আধিপত্যের শিকড় কী ভাবে সমাজে প্রসারিত হয়, সে আলোচনা আগে হয়েছে। আমাদের মস্তিষ্ক আর শারীর-রসায়নে কী ভাবে বিবর্তনের উত্তরাধিকার হিসাবে ক্ষমতাস্পৃহা প্রোথিত, রবার্ট স্যাপলস্কির মতো স্নায়ুবিজ্ঞানীরা তা বুঝিয়েছেন। খুব উল্লেখযোগ্য মনস্তত্ত্ববিদ এরিক ফ্রমের কাজ, মূলত হিটলারের জার্মানিকে বোঝার চেষ্টা, কিন্তু সাধারণ ভাবেই আধিপত্যবাদের আলোচনা। মনে পড়ে মিশেল ফুকোর ‘লিটল এভরিডে ফ্যাসিজ়ম’: ‘‘দ্য ফ্যাসিজ়ম ইন অল অব আস, ইন আওয়ার হেডস অ্যান্ড ইন আওয়ার এভরিডে বিহেভিয়র, দ্য ফ্যাসিজ়ম দ্যাট কজ়েস আস টু লাভ পাওয়ার, টু ডিজ়ায়ার দ্য ভেরি থিং দ্যাট ডমিনেটস অ্যান্ড এক্সপ্লয়েটস আস’। ফ্যাসিবাদ বলি আর না বলি, ব্যাপারটা তাই বহুব্যাপ্ত, বহুস্তরীয়। সত্যি তো, আমরা কি আধিপত্যবাদ দেখিনি বাড়িতে বৌমার প্রতি শাশুড়ির আচরণে? দেখিনি অফিসে বসের মধ্যে? দেখিনি কোনও কেরানির মধ্যেও, যিনি আমার প্রাপ্য একটা নথি দিতে গিয়ে দশ বার ঘোরান? যে যেখানে যেটুকু ক্ষমতা পেয়েছে, সেটুকু অন্যকে ‘সমঝিয়ে’ দেওয়ার প্রবণতা তো খুবই চেনা। আসলে এ হল একটা ব্যক্তিচরিত্রের ধাঁচা, যা অনেকের ক্ষেত্রেই অল্পবিস্তর প্রযোজ্য; যা হয়তো কিছুটা জন্মগত, কিন্তু যা তৈরিতে অনেকটাই সাহায্য করে পারিবারিক পটভূমি, বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়া। নিরাপত্তাবোধের অভাব, নিজের দুর্বলতা, হীনম্মন্যতা, শ্রেষ্ঠদের প্রতি ঈর্ষা, দুর্বলদের প্রতি ঘৃণা, জীবন সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে তৈরি হয় এমন চরিত্র। তা আবার শক্তি ও ব্যাপ্তি পায় বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে, বিশেষ রকম সাংস্কৃতিক পরিবেশে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানি থেকে আজকের উদারীকরণ-উত্তর দুনিয়া, যাদবপুরের মেন হস্টেলের সাংস্কৃতিক আবহ ইত্যাদি অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। কিন্তু এ শুধু দু’এক জন প্রতাপমত্ত ব্যক্তির গল্প নয়, সেই ব্যক্তি কী ভাবে চার পাশে আরও অনেকের নীরব বা সক্রিয় সমর্থন পায়, দাপটের পাশাপাশি কিছুটা দয়াদাক্ষিণ্য দেখিয়ে অনেককে মুগ্ধ করে, নিপীড়িত ব্যক্তিটিকেই দুমড়েমুচড়ে দাসানুদাস বানিয়ে তোলে, সেও আমরা জানি। আধিপত্য আর অধীনতার মধ্যে পারস্পরিক অধিক্রমণও মনস্তাত্ত্বিক সত্য। দু’টি প্রবণতা আসলে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। যে অন্যের উপর দাপট দেখায়, সে-ই বেশি করে অন্যতর কারও বশংবদ হয়ে থাকে। যে নির্যাতিত হয়, সে-ই সুযোগ বুঝে ভয়াবহ নির্যাতনকারী হয়ে ওঠে। র্যাগিং প্রসঙ্গে এ কথা যেমন প্রযোজ্য, তেমনই আমরা জানি ‘কিঁউ কি সাস ভি কভি বহু থি’। আর এ ভাবেই আধিপত্যবাদ বিস্তৃতি লাভ করে। তাই গণতন্ত্রের পথেই ফ্যাসিবাদ আসে। প্রক্রিয়াটা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে প্রতিষ্ঠা পেলে, ঐতিহ্য হিসাবে মর্যাদা পেলে, আরও মারাত্মক হয়ে ওঠে। ক্ষমতার জবরদস্ত কাঠামো তৈরি হয়ে যায়। মানুষ আর মানুষ থাকে না, মনহীন ‘অটোমেটন’ হয়ে ওঠে, সে খুব শিক্ষিত ব্যক্তি হলেও।
এরিক ফ্রম বলেছিলেন, ফ্যাসিস্ট চরিত্র-কাঠামো মোটামুটি ১০ শতাংশ মানুষের মধ্যে থাকে। সংখ্যাটা তুচ্ছ করার মতো নয়। আর ওই যে বললাম, বিশেষ পরিস্থিতিতে ১০ শতাংশই ফুলেফেঁপে গোটা সমাজ ছেয়ে ফেলতে পারে। সচরাচর যারা অন-আধিপত্যবাদী, তারাও তখন আধিপত্যবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে; কিংবা অন্ধ হয়ে থাকে, নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। এ ভাবেই মানুষের মনের গহন অন্ধকার— ক্ষমতাস্পৃহা, নজরদারি, নিষ্ঠুরতা, হিংস্রতা— ইতিহাসকে অনেকাংশে চালনা করে এসেছে। সচরাচর ন্যায্যতা প্রতিপাদনের নামেই তা করা হয়— মতাদর্শের দোহাই দিয়ে, পরহিতচিকীর্ষার প্রলেপ লাগিয়ে। রাষ্ট্রীয় স্তরে জাতীয়তার নামে করা হয়— এক শক্তিশালী গরিমাময় রাষ্ট্রের আরাধনার নামে, কোনও শত্রুগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে, তাদের ইতরায়ন ঘটিয়ে, তাদের উপর যথেচ্ছ অত্যাচার চালিয়ে। রাজ্যস্তরে রাজনৈতিক দল-ভিত্তিক সমাজ গঠন করে, দলীয় আগ্রাসনের সংস্কৃতি তৈরি করে। আমাদের সমাজে তো সেই কবে থেকে জাতপাতের প্রথা তৈরি করে কিছু মানুষ কিছু মানুষের উপর আগ্রাসন চালিয়ে এসেছে। এই ভাবে তলে তলে চলাচল করে ক্ষমতা, সব মিলিয়ে তৈরি হয় ক্ষমতার বিরাট ইমারত। আমরা সবাই সেখানে বাস করি, ইচ্ছা-অনিচ্ছায়।
র্যাগিং-ও এই ইমারতেরই একটি তলে প্রক্রিয়াটির এক বিশিষ্ট রূপ। বলা হয়, নবাগত ছাত্রদের সামাজিক জড়তা ভাঙা, সিনিয়রদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করায় নাকি তা সহায়ক। এমনটা নাকি সত্যি কখনও কখনও হয়। এই প্রসঙ্গে ‘স্টকহোম সিন্ড্রোম’-এর কথা শুনি। ১৯৭৩ সালে স্টকহোমে ব্যাঙ্ক ডাকাতি করতে গিয়ে কয়েক জন মহিলাকে অপহরণ করা হয়। অপহৃতারা ডাকাতদের খুবই অনুগত হয়ে পড়ে, এক জন নাকি এক ডাকাতকে বিয়েও করে। সিনেমাতে তো এ রকম হরদম দেখি— হেনস্থাকারী ছেলেটির সঙ্গেই শেষ পর্যন্ত হেনস্থা-হওয়া মেয়েটির প্রেম। বোঝাই যাচ্ছে, অক্সিটোসিনের আরামদায়ক ক্ষরণ নয়, টেস্টোস্টেরনের আগ্রাসন, অ্যাড্রিনালিনের উত্তেজনা দিয়ে তৈরি বন্ধুত্বেই বিশ্বাসী সমাজের একাংশ। তাই র্যাগিং-কে প্রশ্রয় দিয়ে বলা হয়— হলই বা অল্পস্বল্প, মন্দ কি সেটা! মন্দও যদি হয়, একটু মানিয়ে নাও না বাপু (যেমন শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতিত মেয়ের বাপ-মাও বলে থাকেন, মেয়ের মৃত্যুসংবাদ পাওয়া পর্যন্ত)। মুশকিল হল, অল্পস্বল্পটা কখন যে বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়ে এমনকি কাউকে মৃত্যুর মুখেও ঠেলে দিতে পারে, তার কোনও নির্দিষ্ট হিসাব নেই। তা ছাড়া সবার সহ্যের সীমাও তো এক হয় না। কিন্তু ক্ষমতা আর তার দাপটের স্বাভাবিকীকরণে ব্যস্ত সমাজ তা বোঝে কই!
যাদবপুর এই সমাজের বাইরে নয়। অবশ্যই এটা বলে বিশ্ববিদ্যালয় ঘটনার দায় এড়াতে পারে না। কর্তৃপক্ষ তো নয়ই। সমস্যাটাকে নির্মূল করতে না পারলেও তাকে প্রতিহত করার প্রত্যক্ষ দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের ছিল। তবে কিনা ক্ষমতার চূড়ার কাছাকাছি থেকে, ইমারতটাকে রক্ষার বিরাট দায় নিয়ে, ‘ছোটখাটো’ দায় পালনের ব্যাপারে তাঁরা একটু সমঝোতা করেই থাকেন। কিন্তু যাদবপুরের প্রতিবাদী ছাত্ররা, ন্যায়ের পক্ষাবলম্বী শিক্ষকরা, তাঁরা কেন র্যাগিং নিয়ে হইচই করেননি? আমার মতো কেউ কেউ হয়তো জানতেনই না কতটা কী ঘটে চলেছে। কিন্তু এক প্রাক্তন শিক্ষক হিসাবে আজ নিজের এই অজ্ঞতা আমার সমাজবিদ্যা চর্চার প্রতি একটা মস্ত বিদ্রুপ বলে মনে হচ্ছে।
তবু কিন্তু যাদবপুরকে নিন্দা করে সমস্যার সমাধান হবে না। চাই সচেতনতা। বরং বলি স্বচেতনতা, আত্মসমীক্ষা দিয়েই যার সূচনা কাম্য। যাদবপুরের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং জ্ঞানমার্গেই সেই সূচনা হতে পারে। মানবপ্রকৃতিতে আধিপত্যবাদের তত্ত্বতালাশ করতে গিয়ে পাশাপাশি কিন্তু আমরা ভালবাসা আর পারস্পরিকতার সন্ধানও পাব। আর পশুদের মতো আমাদের ক্ষেত্রে সেটা নিছক স্বজ্ঞাতাড়িত নয়। নিজের মধ্যে ও আশেপাশে মনের অন্ধকারকে পরাভূত করে আলোটাকে জ্বালিয়ে রাখার সচেতন ও স্বচেতন দায়িত্ব মানুষ হিসাবে আমাদের নেওয়া দরকার। বদলে শুধুই কাদা-ছোড়াছুড়ি করলে এক আধিপত্যবাদকে রুখতে গিয়ে আর এক আধিপত্যবাদকে উৎসাহিত করব আমরা। এই মুহূর্তে সেটাই তো দেখছি! যাদবপুরের ছাত্ররা র্যাগিং-এর অপরাধে অপরাধী, সুতরাং কী ভুল হয়েছিল যখন কয়েক বছর আগে তাদের আন্দোলন ভাঙতে পুলিশ ডাকা হয়েছিল? অবশ্যই ছাত্রদের কঠোর অনুশাসনে রাখতে হবে। অবশ্যই চাই প্রবল নজরদারি! সিসি ক্যামেরা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় তথা মানবসভ্যতাকে মুড়ে দাও। সিসি টিভির প্রতিফলনই যখন যথেষ্ট, নিজেদের সামনে আয়না ধরার দরকার কী?
ভয় হচ্ছে, এক স্বৈরাচারী আধিপত্যবাদের নগ্ন প্রকাশ আরও উঁচুতলায় আর এক স্বৈরাচারী আধিপত্যবাদের পথ প্রশস্ত করছে না তো?