—প্রতীকী ছবি।
আর্ট কলেজের এক দল ছেলেমেয়ে হাওড়া স্টেশনে বসে ছবি আঁকছে। ফিগার ড্রয়িং শেখার প্রাথমিক ধাপ: অপেক্ষমাণ যাত্রী, খবরকাগজ নিয়ে বসে থাকা বৃদ্ধ, ভিক্ষাজীবী নরনারী, ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ, স্টেশনই যাদের থাকার জায়গা সেই শিশুদলের ছবি। বছর আটেকের একটি ছেলে মন দিয়ে ওদের ছবি আঁকা দেখছিল। তার মা দু’বার ডেকে গেল তাকে, তবু ভ্রুক্ষেপ নেই। মা রেগে বললেন, “এই জন্যই বলি মন দিয়ে লেখাপড়া করতে, তা না হলে এদের মতো রাস্তায় বসে ছবি আঁকতে হবে!”
এই দৃষ্টিভঙ্গির আজও খুব বদল হয়েছে বলে মনে হয় না। শিল্পকলা নিয়ে নতুন পেশার রাস্তা খুলে গেছে, কিন্তু আমরা কি পেরেছি চার পাশের মানুষকে শিল্পিত করে তুলতে? এখনও বহু মানুষ শিল্পীদের জিজ্ঞেস করেন, “ছবি আঁকেন তা ভাল, আর কী করেন?” ছবি আঁকাই যে একটা পেশা হতে পারে, এখনও তা প্রশ্নের মুখে।
জনসাধারণের সঙ্গে শিল্পকলার সম্পর্ক মানুষের স্বাভাবিক সৌন্দর্যবোধের বিকাশ ঘটায়, সমাজকে আরও মজবুত করে। এই ভাবনা থেকেই ‘বিশ্ব শিল্পকলা দিবস’ উদ্যাপনের শুরু, ২০১২ থেকে। লিয়োনার্দো দা ভিঞ্চির জন্মদিনের সম্মানে বেছে নেওয়া হয় ১৫ এপ্রিল তারিখটি। ২০১৯-এ প্যারিসে ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক ভাবে দিবসটির ঘোষণা হয়, ইউনেস্কো-ঘোষিত অন্যান্য আন্তর্জাতিক দিবসের মতো আজ তা বিশ্বব্যাপী পালিত। কলকাতাতেও বেশ কিছু সংস্থা দিনটি উদ্যাপন করে; চারু-কারুকলা ঘিরে একত্র হন শিল্পী ও শিল্পানুরাগীরা। জনসাধারণ অবাক হয়ে দেখেন। তার পর বাড়ি ফেরেন, ভুলে যান।
যে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে দিনটি পালনের ভাবনা, তা কতটা ফলপ্রসূ হচ্ছে? আমরা কি সত্যিই রোজকার জীবনে শিল্পের সারমর্ম বুঝতে পারি? অথচ সকাল থেকে রাত অবধি অজানতেই আমরা জড়িয়ে আছি শিল্পের সঙ্গে। দৃশ্যকলা আমাদের নিয়ত চালনা করে: আনাজ-বিক্রেতা রোজ ঝুড়ি সাজান, ফুলবিক্রেতার ফুল সাজানো দেখে মুগ্ধ হতে হয়। অফিসে কোন রঙের পোশাক ভাল মানাবে, ঘরের রং অনুযায়ী কী রঙের পর্দা লাগবে, বহু উদাহরণ ছড়িয়ে। দুর্গাপুজোয় শিল্পীদের তৈরি মণ্ডপ ও প্রতিমা দেখতে বিরাট ভিড় হয়, পুজোর চার দিন সাধারণ মানুষ শিল্পে মোহিত হয়ে থাকেন। এর অর্থ, ঠিক দিশা পেলে সমাজে শিল্পভাবনার প্রসার সম্ভব।
শিল্পভাবনার প্রসার শুধু আর্ট গ্যালারি, শিল্পী, শিল্প সমালোচকের মধ্যে আটকে রাখলে চলবে না। স্কুলের প্রাথমিক স্তর থেকেই তাকে ছড়িয়ে দিতে হবে। সরকারি ভাবে প্রাথমিক স্কুল স্তরে শিল্পের কোনও পাঠক্রম এখনও নেই। এই পাঠক্রম শিল্পী তৈরির প্রক্রিয়া নয়, তা এমন হওয়া উচিত যা একটি শিশুর সহজ শিল্পভাবনাকে ক্রমশ শিল্পবোধে উন্নীত করতে পারে। সেই শিশুটি পরিণত বয়সে সমাজগঠনের ক্ষেত্রে আর পাঁচ জনের থেকে উন্নত ভূমিকা পালন করবে। অপ্রিয় সত্যটি হল, এখনও আমাদের সমাজ সিলেবাসে না থাকলে তাকে শিক্ষার প্রকৃত বিষয় বলে মনে করে না। অথচ শিল্প এমন এক বিষয় যার চর্চা অন্যান্য বিষয়ের মতোই অতি যত্নে করতে হয়। স্কুল স্তর থেকে শিল্পচর্চা আমাদের সংবেদনশীল মনকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে, সমাজে হিংস্রতা অসহিষ্ণুতা কমিয়ে নান্দনিক বাতাবরণ তৈরি করে।
বেসরকারি স্কুলে বোর্ডের সিলেবাস অনুযায়ী প্রাথমিক স্তর থেকেই ভিস্যুয়াল আর্ট আছে। এ রাজ্যে বেসরকারি স্কুল আনুমানিক আটশো হলে, সরকারি ও সরকার-পোষিত ও সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল প্রাথমিক-মাধ্যমিক মিলিয়ে প্রায় সত্তর হাজার; শুধু প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা প্রায় ঊনপঞ্চাশ হাজার। কেবল প্রাইমারি স্কুলে ভিস্যুয়াল আর্টের অন্তর্ভুক্তি হলে, স্কুলপ্রতি এক জন ধরলেও ৪৯ হাজার শিক্ষক চাই, যা কার্যত অসম্ভব। সমস্ত আর্ট কলেজ ধরলে, বছরে খুব বেশি হলেও প্রায় ছ’শো জন পাশ করে বেরোন। তবে উপায় যে একেবারে নেই তা নয়। প্রায় সব প্রাথমিক স্কুলেই কোনও না কোনও শিক্ষক থাকেন যাঁরা অন্য বিষয়ের হলেও একটু-আধটু ছবি আঁকতে পারেন। তাঁদের একটু প্রশিক্ষণ দিলে প্রাথমিক স্তরে তাঁরাই এ কাজ অনায়াসে করতে পারেন। এই প্রশিক্ষণে আর্ট কলেজ থেকে পাশ-করা শিল্পী বা শিল্পকলা-শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত মানুষকে নিয়োগ করা যেতে পারে। তাতে বহু শিল্পীর কর্মসংস্থান হবে, স্কুল স্তরে ছবি আঁকার মাধ্যমে শিল্পভাবনা বিকাশের তালিমও শুরু হবে।
শহর-গ্রাম, আর্থ-সামাজিক কাঠামো মাথায় রেখেই তা হওয়া উচিত। শিল্পের ভার না চাপিয়ে, তার নির্যাসটুকু সহজে বোঝাতে পারলে তবেই ছোটরা আনন্দ পাবে। এ বিষয়ে দিশারি রবীন্দ্রনাথ, নন্দলাল বসু। সহজ পাঠ শুরু “ছোটো খোকা বলে অ আ, শেখেনি সে কথা কওয়া” এই বাক্যবন্ধ দিয়ে, সঙ্গে পাতায় পাতায় লিনোকাট: শিল্পভাবনার দরজা ওঁরা খুলে দিয়ে গেছেন সেই কবে। ভাষাশিক্ষার পাশাপাশি একে শিল্পভাবনার সহজ পাঠ বলাও অত্যুক্তি নয়। সমাজের সব স্তরে একটু একটু করে শিল্পচেতনা প্রসারে সচেষ্ট হলে এক দিন আমরা সমাজের সুন্দর শিল্পিত রূপ দেখতে পাব। হয়তো সময় লাগবে, তবু শুরুটা তো হোক!