—প্রতীকী ছবি।
গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে নেটফ্লিক্স-এ কল্পবিজ্ঞান-ভিত্তিক সিরিজ় ব্ল্যাক মিরর-এর একটা পর্ব ছিল ‘জোয়ান ইজ় অফুল’। এর মধ্যে ছিল একটি টিভি শো-এর কথা, যার গল্পটা লিখেছে কম্পিউটার, আর তাতে অভিনয় করেছে কম্পিউটারে তৈরি সালমা হায়েকের প্রতিমূর্তি। অর্থাৎ, বিনোদনের মতো ক্ষেত্রেও মানুষকে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক করে দিচ্ছে প্রযুক্তি। আজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নিয়ে ভয়ের যে ঠান্ডা স্রোত প্রবাহিত হয় মানব-সভ্যতার শিরদাঁড়ায়, তার অন্তঃস্থলে কিন্তু কাজ করে এই ভয়টাই— সার্বিক ভাবে মানুষের কর্মচ্যুতির ভয়, প্রতিস্থাপিত হওয়ার ভয়, জীবনের প্রতিটি ইঞ্চি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দখলে চলে যাওয়ার ভয়। এই ‘জোয়ান ইজ় অফুল’ পর্বটা কিন্তু তৈরি হয়ে গিয়েছিল চ্যাটজিপিটি বাজারে আসার আগেই। চ্যাটজিপিটি তো সভ্যতার ইতিহাসের এক পরিবর্তন-বিন্দু, এর আবির্ভাবের পরে মানুষের কাছে যেন কল্পকাহিনি আর বাস্তব একাকার।
গত বছর হলিউডে দু’টি বড় মাপের ধর্মঘট হল, চিত্রনাট্যকার এবং শিল্পীদের। এই যুগল-ধর্মঘটের পিছনেও কিন্তু সেই ভয়েরই শিরশিরানি। ঐতিহাসিক এই ধর্মঘটকে মানুষের সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এক প্রত্যক্ষ সংঘাত-পর্ব বলা চলে। সেই সংঘাত মোটেই কল্পবিজ্ঞানের গণ্ডিতে নয়— বাস্তবের মাটিতে। ১৪৮ দিন ধরে চলা প্রথম ধর্মঘটের পরিণতিতে রাইটার্স গিল্ড অব আমেরিকার আপাত-জয়, এবং ১১৮ দিন ধরে চলা দ্বিতীয় আন্দোলনের সমাপ্তিতে প্রধান স্টুডিয়োগুলির সঙ্গে অভিনেতাদের সংগঠনের সমঝোতা মানব-সভ্যতার ইতিহাসের এক মাইলফলক। সমঝোতা হল, আপাতত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ‘লেখক’ হিসাবে ব্যবহার করা যাবে না হলিউডে; কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অননুমোদিত ব্যবহারের বিরুদ্ধে অভিনেতাদের থাকবে ‘সুরক্ষা’।
হ্যাঁ, ‘আপাতত’-ই। কারণটা সহজবোধ্য— এ লড়াই তো চলতেই থাকবে। এবং আজ হোক বা কাল, লেখক-অভিনেতাদের পরাজয়ও সুনিশ্চিত। আসলে এ এক অসম লড়াই। এক কালে আমাদের জীবনশৈলীতে কম্পিউটারের অনুপ্রবেশ রুখতে আন্দোলন হয়েছিল দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে— আমাদের পশ্চিমবঙ্গেও— বিপুল কর্মচ্যুতির আশঙ্কায়। সে লড়াই যে কবে অর্থহীন হয়ে গিয়েছিল, সংশ্লিষ্ট সমাজগুলি হয়তো ভুলেছে তা-ও। কম্পিউটার এসে অনেক পুরনো কাজকে মুছে দিয়েছে যেমন, বহু নতুন চাকরিও তৈরি হয়েছে। এটাই সভ্যতার নিয়ম। বছর বিশেক পরে মানুষ হয়তো বিস্মিতই হবে আজকের ‘ঐতিহাসিক’ হলিউডি ধর্মঘটের ছেলেমানুষির কথা শুনে, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ‘অনিবার্য’ বিজয় রথ ঠেকাতে মরিয়া হয়েছে মানুষ।
২০২১ সালে এক সাক্ষাৎকারে অর্থনীতির নোবেল-বিজেতা মনস্তত্ত্ববিদ ড্যানিয়েল কানেম্যান বলেছিলেন, প্রযুক্তি এগোচ্ছে ‘এক্সপোনেন্সিয়্যালি’, অর্থাৎ নিরন্তর গুণোত্তর প্রগতিতে, অতি দ্রুত লয়ে; উল্টো দিকে, মানুষের প্রগতি নেহাতই ‘সরলরৈখিক’ ছন্দে। ‘সরলরৈখিক’ মানুষের সঙ্গে দৌড়ে ‘এক্সপোনেন্সিয়্যালি’ সমৃদ্ধ হতে-থাকা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জয় সুনিশ্চিত। বরং মানুষ কী ভাবে এই অনিবার্যতাকে সামলায়, সেটাই চিত্তাকর্ষক নিরীক্ষণ হতে পারে। তবে সেটা তাঁর সন্তান-সন্ততি এবং নাতি-নাতনিদের সমস্যা, তাঁর নয়, বলেছেন কানেম্যান।
এটা ঠিক যে, অপরিসীম তথ্য মন্থন করে প্যাটার্ন ম্যাচিংয়ের মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যে কর্মপদ্ধতি, তার সঙ্গে মানুষের জটিল চিন্তাশৈলীর বিস্তর পার্থক্য। তবু, জীবনযাপনের অনেক ক্ষেত্রেই যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ম্যাজিক দেখাবে তার উৎকর্ষে এবং উৎপাদনশীলতায়, তা-ও অনিবার্য। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুবিধা আরও। তাকে দিতে হবে না বেতন বা কোনও ভাতা; নেই ছুটিরও প্রয়োজন। এক বার কিনলে রক্ষণাবেক্ষণের ন্যূনতম প্রকৌশল ব্যবস্থাই যথেষ্ট। তাই নিয়োগকর্তারা রোবট নিয়োগে উৎসাহীই হবেন বিভিন্ন কাজে। ক্রমেই কঠিনতর হয়ে পড়বে কল্পবিজ্ঞানের লেখকদের কাজও।
হলিউড অভিনেতারা প্রতিস্থাপিত হওয়ার ভয়ে আন্দোলন করেছেন ঠিকই, তবে অভিনয়ের চৌহদ্দিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অনুপ্রবেশ ঘটেছে ইতিমধ্যেই। অভিনেতা পিটার কাশিং মারা যান ১৯৯৪ সালে, কিন্তু ২০১৬ সালের ছবি রোগ ওয়ান: আ স্টার ওয়র্স স্টোরি-র জন্য ডিজিটাল পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়েছে তাঁর প্রতিরূপ। ২০১৯-এর ছবি দি আইরিশম্যান-এ রবার্ট ডি নিরোর বয়স কমিয়ে তাঁকে বিভিন্ন বয়সের দেখানো হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে। পারফর্ম্যান্স ক্লোনিংও হচ্ছে দেদার। চিনা দুগ্ধ-সংস্থা মেংনিউ-এর বিজ্ঞাপনে দৌড়তে দেখা গেল ফরাসি ফুটবলার এমবাপে-কে। আসলে কিন্তু দৌড়িয়েছেন এক মানুষ ‘ডাবল’, এবং ব্যবহৃত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্মিত ডিজিটাল মুখোশ। এমআইটি টেকনোলজি রিভিউ-এর অক্টোবরের এক নিবন্ধে দেখছি, হলিউড যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ে তোলপাড়, কয়েকটি সংস্থা কিছু অভিনেতাকে নিয়োগ করেছে তাঁদের কণ্ঠস্বর, মুখ, অঙ্গভঙ্গি এবং মুখের অভিব্যক্তি-জনিত তথ্য সংগ্রহের জন্য, যা জোগানো হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তথ্যভান্ডারে। এর ব্যবহারে ‘ভার্চুয়াল অবতার’ হয়ে উঠবে আরও ‘মানবিক’। খেয়াল করেছেন নিশ্চয়ই, পাড়ার মুদিখানায় একটি বিশেষ ইউপিআই-এ পেমেন্ট করলেই ‘দেবীয়োঁ অউর সজ্জনো’ সম্বোধনে অমিতাভ বচ্চনের কণ্ঠে টাকা জমা পড়ার ঘোষণা হচ্ছে? সেটাও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তারই প্রয়োগ।
তবু, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি সম্পূর্ণ প্রতিস্থাপিত করতে পারে সেলিম-জাভেদ’এর কলমের জাদুকে, কিংবা শাহরুখের ম্যাজিককে? কোনও ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেই কি অভিনেতাদের সম্পূর্ণ রূপে প্রতিস্থাপিত করা আদৌ সম্ভব? অভিনয়ের ক্ষেত্রে মানুষের আবেগ এবং অভিজ্ঞতার জটিলতাই তো কেন্দ্রীয় বিষয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি মানবিক অনুভূতির সূক্ষ্মতার সঘন চিত্রণে সক্ষম? এক গভীর মানসিক পরিমণ্ডলে দর্শককে আষ্টেপৃষ্ঠে আবিষ্ট করার ক্ষমতা কি আদৌ আছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্বলিত রোবটের?
এই অধরা মায়াটুকু কিন্তু জড়িয়ে আছে জীবনের বিচিত্র সব রূপকথার মধ্যেই । এটাই মানব-সভ্যতার জিয়নকাঠি। ১৯৯৭ সালের ১১ মার্চ সভ্যতার ইতিহাসের এক অমোঘ পরিবর্তন-বিন্দুতে আইবিএম-এর দাবা খেলার কম্পিউটার ‘ডিপ ব্লু’ হারিয়ে দিয়েছিল কিংবদন্তি দাবাড়ু গ্যারি কাসপারভ-কে। মানুষের চেতনাতেও সে এক প্রবল অভিঘাত। যন্ত্রের বুদ্ধিমত্তার কাছে মানুষের বুদ্ধিমত্তার পরাভবে সিলমোহর পড়ল সে দিনই। তার পর কেটেছে সিকি শতাব্দীর বেশি সময়। কাসপারভ সে দিন হেরেছিলেন লড়াই করে। আজকের যন্ত্র এতটাই উন্নত যে, লড়াইয়ের কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্বলিত বিভিন্ন নামীদামি দাবার ইঞ্জিন তুড়ি মেরে হারাবে আজকের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকে। কিন্তু এটাও নিশ্চিত যে, এমন দুটো দাবার ইঞ্জিনের— যেমন ‘আলফাজ়িরো’ আর ‘স্টকফিশ’— খেলা দেখার চেয়ে ঢের বেশি উৎসাহ নিয়ে মানুষ উপভোগ করবে ম্যাগনাস কার্লসেন আর রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দ-র লড়াই। এখানেই মানুষের বুদ্ধিমত্তা এবং মানবিক স্পর্শ যে কোনও দিন হারিয়ে দেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে। কথাটা সম্ভবত জীবনের সর্ব ক্ষেত্রেই সত্যি।
হলিউডের অভিনেতাদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে পরিচালক জো রুসো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে দেখতে চেয়েছেন ডিজিটাল ক্যালকুলেটরের ভূমিকায়, যা সহজ অঙ্ক করতে সাহায্য করে বাড়াতে পারে আমাদের উৎপাদনশীলতা। কাসপারভ আবার প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেননি যে, যন্ত্র হারাতে পারে তাঁকে। ঘটনাচক্রে সভ্যতার ইতিহাসে যন্ত্রের কাছে মানুষের পরাভবের প্রতীক হয়ে গেলেন তিনি। তবু, তিনি কিন্তু শিখেছেন সেই পরাজয় থেকেই। তাঁর ২০১৮-র বই ডিপ থিঙ্কিং: হোয়ার মেশিন ইন্টেলিজেন্স এন্ডস অ্যান্ড হিউম্যান ক্রিয়েটিভিটি বিগিনস-এ কাসপারভ বলছেন, কিছু ক্ষেত্রে যন্ত্র আমাদের থেকে বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন বলে অভিযোগ করার চেয়ে বরং মানুষের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে আমাদের জীবনযাত্রায় সম্পৃক্ত করাটাই লড়াইয়ের ভাল উপায়। জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই। দাবাতেই যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে প্র্যাকটিস করে উপকৃত হচ্ছেন আজকের দাবাড়ুরা।
বোতল-মুক্ত প্রযুক্তির দৈত্যকে আবার সম্পূর্ণ বোতলবন্দি করা ‘সরলরৈখিক’ হারে উন্নতিশীল মানুষের পক্ষে অসম্ভব; তাকে হারানো তো অসম্ভব বটেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গুণোত্তর প্রগতিতে ফুলে-ফেঁপে ওঠাও অনিবার্য। তাই সুচিন্তিত এবং সুনিয়ন্ত্রিত উপায়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে আমাদের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে জীবন এবং জীবনযাত্রার উৎকর্ষ সাধনের প্রচেষ্টাই বোধ হয় মানবিক প্রজ্ঞার বিজয়কেতনের ইঙ্গিতবাহী। এক জটিল সময়কালে, সভ্যতার এক ভয়ঙ্কর আবর্তে দাঁড়িয়ে, এই কৌতূহলজনক দ্বিধার মোকাবিলা করতে হবে আমাদেরই।