—ফাইল চিত্র।
সাতটারি গ্রামের ঝাল্লু সরকার আবাস যোজনার টাকা না পেয়ে, মহাজনের কাছে ধার করে কংক্রিটের ঢালাই ছাদ, ইটের দেওয়াল তুলেছিলেন। গতরে খেটে টাকা তুলে দেবেন, এই আশায় পরিবারের ক’জনকে নিয়ে মিজ়োরাম রওনা দিয়েছিলেন তিওর তফসিলি জাতির ভূমিহীন কৃষক ঝাল্লু। ব্রিজ ভেঙে বাপ-ছেলে-নাতি-জামাই সকলের মৃত্যুতে পলেস্তারাহীন বাড়ির ভিত কেঁপে গেল। ঝাল্লুর ছেলে জয়ন্তের বিয়ে হয়েছিল চার বছর আগে। পুত্রবধূ নীতু মাঝি বলছিলেন, পরিযায়ী শ্রমিক জয়ন্ত কখনও পনেরো দিন, কখনও এক সপ্তাহের জন্য ফিরতেন। সোহাগের রেশ শুরু না হতে না হতেই ফুরিয়ে যেত। দুর্ঘটনার দিনও সকালে ছ’টায় ফোন করেছিলেন জয়ন্ত। তার পর মৃত্যুর খবর, কফিনে দেহ আসা, নেতাদের দ্রুত আবির্ভাব, ক্যামেরার সামনে ক্ষতিপূরণের চেক বিতরণ ও প্রস্থান, এ সবের আকস্মিকতায় বিহ্বল নীতুর কাছে গোটা ঘটনাটা লম্বা দুঃস্বপ্নের মতো। তাঁর কেবলই মনে হচ্ছে, কাল ঘুম ভাঙবে স্বামীর পরিচিত রিংটোনে।
আমবাগানের ছায়ায় মালদহের দুই গ্রাম, চৌদুয়ার ও সাতটারি। ভৌগোলিক দূরত্ব প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার হলেও আর্থ-সামাজিক স্থানাঙ্কে খুব কাছাকাছি। মিজ়োরামের ব্রিজ ভেঙে মৃত পরিযায়ী শ্রমিকদের সিংহভাগ এই দুই গ্রামের মানুষ। গ্রাম ঘিরে পচা পাটের গন্ধ, জলাভূমিতে পাটতন্তু ছাড়ানোর কাজ করছিলেন মধ্যবয়স্ক নারী-পুরুষ। আম ও পাট বছরের কয়েক মাস কর্মসংস্থান জোগায় কিছু বাসিন্দাকে, বাকি সময়ের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতে পুরুষরা ছোটেন মুম্বই, কেরল, তামিলনাড়ু, কাশ্মীর, অরুণাচল, লাদাখ। তাঁরা করেন সাটিনের কাজ, ড্রেন নির্মাণ ও সাফাই, টাওয়ার নির্মাণ, কারখানায় মজদুরি, রাস্তা ও ব্রিজের কাজ। স্বীকৃতিহীন, নিম্ন মজুরির জোয়ালভাঙা শ্রম, যা ভারত গড়ছে, সাফ করছে, সচল রাখছে।
সাতটারি ও চৌদুয়ার গ্রামে একটিও এমন ঘর নেই, যেখান থেকে পুরুষরা অন্য প্রদেশে কাজে যান না। মিজ়োরামে মৃতদের প্রত্যেকেই ভূমিহীন কৃষক পরিবারের। দুই দশক আগেও অন্যের জমি লিজ় নিয়ে চাষ করত পরিবারগুলি। এখন ধার শোধ করে তিন মাসের খোরাকিও ওঠে না। এই দুর্ঘটনার পর কি বাইরে কাজে যাওয়া কমবে? প্রশ্ন করতেই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন সাতটারির পরিযায়ী শ্রমিক কুরবান শেখ, “চালের টাকা কি আপনি দেবেন?” আল্লার রোষে দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা বলে কি কাজে যাওয়া বন্ধ করা যায়? মৃত সামিরুল হকের (১৯) পিতা এসারউদ্দিন বলছিলেন, ওই অভিশপ্ত ব্রিজেই কয়েক মাস আগে দুর্ঘটনায় পাশের গ্রামের দু’জনের মৃত্যু হয়েছিল, এক জনের পা কাটা গিয়েছিল। তবু কনিষ্ঠ পুত্রকে পাঠিয়েছিলেন তিনি। মালদহের বাইরে সেই প্রথম পা রেখেছিল ক্লাস নাইন-পাশ সামিরুল। এসারউদ্দিন বললেন, ক্ষতিপূরণের টাকায় সারা জীবন খাওয়া যায় না, দরকার হলে অন্য ছেলেকেও বাইরে কাজে পাঠাবেন।
মিজ়োরামের দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফেরা উজির আলি অবশ্য ওই কাজে আর ফিরতে নারাজ। চোখের সামনে সহকর্মী, এক তাঁবুতে রাত-কাটানো বন্ধুদের মরতে দেখে বছর ত্রিশের উজিরের ‘ডর’ ঢুকেছে মনে। উজির ছিলেন ‘অ্যাড মাস্টার’, ‘রিগার’-দের প্রধান সহায়ক। রিগার অনেকটা উচ্চতায় উঠে ব্রিজের কাঠামো নির্মাণ করেন, মজুরি মাসিক প্রায় চব্বিশ হাজার টাকা, অ্যাড মাস্টারদের বাইশ হাজার, ব্রিজের নীচে কাজ করা হেল্পার, খালাসির মজুরি ১৮-১৯ হাজার টাকা। ‘রিগার’ বা ‘অ্যাড মাস্টার’রা প্রযুক্তি জানা দক্ষ শ্রমিকের কাজই করেন, কিন্তু প্রশিক্ষণের সুযোগ পান না। দেখে দেখে কাজ শেখেন। স্কুলছুট ছেলেরা অপ্রচলিত পদ্ধতিতে, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় শিক্ষালাভ করে বৃহৎ, জটিল নির্মাণ কার্যগুলি সম্পন্ন করছেন। ভারতের পরিকাঠামো তাঁদের স্বোপার্জিত জ্ঞান ও দক্ষতার উপরেই টিকে আছে। প্রযুক্তির ডিগ্রি, প্রথাগত ট্রেনিং থাকলে প্রায় দু’-তিনগুণ বেশি মজুরি দিতে হয়, সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হয়। তার চেয়ে এই ভাল।
৮ জুন পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট দিয়ে পরের দিন মালদহ থেকে মিজ়োরামের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন জনা ত্রিশের দলটি। স্থানীয় পঞ্চায়েত, থানা বা বিডিও অফিসে কোনও রেকর্ড রাখা হয়েছিল কি? একশো শতাংশ উত্তর— না। যদিও লকডাউনে পরিযায়ীদের শোচনীয় পরিস্থিতিতে রাজ্য ও কেন্দ্র, দুই সরকারই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল পরিযায়ী শ্রমিকের তথ্য ভান্ডার গড়ে তুলবে।
মিজ়োরামে দুর্ঘটনার পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিযায়ী শ্রমিকদের রাজ্যে ফিরে এসে ব্যবসা করার আহ্বান জানিয়েছেন। পাঁচ লক্ষ টাকা ঋণ পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সরকার যার পনেরো শতাংশের গ্যারান্টর। কথাটা তুলতে সাতটারি গ্রামের শ্রমিকরা মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে উড়িয়ে দিলেন: পনেরো শতাংশ ঋণের গ্যারান্টর সরকার হলেও, বাকি পঁচাশির জন্য ব্যাঙ্ক ও স্থানীয় নেতাদের কাছে ঠোক্কর খেতে হবে, কাটমানি দিতে হবে। প্রত্যন্ত গ্রামে ওই সামান্য পুঁজি নিয়ে ব্যবসা করা সহজ নয়। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য জমিও দরকার, যা তাঁদের নেই।
অসমবিকাশের দেশে উচ্চ মজুরির দিকে চলাচলের টান থাকবেই। ঠিকাদাররা গ্রামেগঞ্জে আধা-কৃষকদের উচ্চ মজুরির টোপ দিয়ে নিয়ে যায় দূরদেশে, সস্তার শ্রমিক বানিয়ে। কোনও শ্রম আইন, নিরাপত্তার আওতায় থাকেন না পরিযায়ী শ্রমিকরা। সাতটারি গ্রামে ঘোরার সময়ই খবর এল, গাজ়িয়াবাদে কাজের সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়েছে মুর্শিদাবাদের তিন শ্রমিকের।