মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ফাইল চিত্র।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের মাতৃপ্রীতি বিশেষ সাড়ম্বরে বর্ণিত হলেও, তাঁর স্বভাবের মধ্যে পিতা রাজনারায়ণের প্রভাব সম্ভবত বেশি ছিল। রাজনারায়ণ যেমন যশোরের সদর দেওয়ানি আদালতে বেশ ক’বছর দাপটে ওকালতি করে, সহসা সেখানকার পাট চুকিয়ে নিজের গোটা পরিবার নিয়ে কলকাতার খিদিরপুরে এসে উঠলেন (বালক মধুর বয়স তখন ৬-৭), পিতার সেই শিকড় উপড়ানোর বিষয়টি শিশু বয়স থেকে মধুসূদনের মধ্যে আজীবন বেশ ভাল পরিমাণে বিদ্যমান ছিল।
রাজনারায়ণ অত্যন্ত ভোগী, খরচাপ্রবণ এবং অসংযমী প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। সেই সঙ্গে সংগীতপ্রেমী। পুজোয় খেউড়ের আসর বসাতেন এবং যশোরে থাকতে সখীসম্বাদের গায়কদের অকাতরে অর্থ প্রদান করতেন। কোনও কোনও জীবনীকারের মতে, তিনি রক্ষিতা রাখতেন। গোলাম মুরশিদ রাজনারায়ণের জীবনের পরবর্তী কালে বিশেষ রোগের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। মধুসূদনের প্রথম জীবনীকার যোগীন্দ্রনাথ বসু রাজনারায়ণের একাধিক বিবাহের উল্লেখ করেছেন।
উকিল হিসেবে রাজনারায়ণ কতটা সফল ছিলেন, প্রশ্নের বিষয়। অনেকে বলেন, রাজনারায়ণের কলকাতা অভিগমনের সময় খিদিরপুর তো নেহাতই শহরতলি, যদি তাঁর পয়সার এত জমক থাকত, তা হলে কলকাতার মূলকেন্দ্র থেকে অত দূরে কেন বাড়ি কিনলেন? তবে সকলেই বলেছেন অপরিমিত খয়রাতির কারণে রাজনারায়ণও তাঁর পুত্রের মতো শেষজীবনে বেশি কাঁচা টাকা হাতে রাখতে পারেননি। কিন্তু রাজনারায়ণ দূরদর্শী ছিলেন। যশোরের সদর দেওয়ানি কোর্টে তিনি যখন ওকালতি করতেন, তখন আদালতের সওয়াল-জবাবের মূল ভাষা ছিল ফারসি। রাজনারায়ণ ইংরেজি জানতেন না, কিন্তু তিনি এত ভাল ফারসি জানতেন যে, তাঁকে যশোরে বলা হত মুনশি রাজনারায়ণ। মধুও তাঁর ছেলেবেলায় গ্রামের পাঠশালায় মৌলবির কাছে খুব ভাল করে ফারসি শিখেছিলেন। কিন্তু বাংলার শিক্ষিত সমাজে তখন ইংরেজি ভাষা শেখার চাহিদা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। রাজনারায়ণ যে তাঁর জীবিত একমাত্র ছেলেটিকে নিয়ে অত দূরে কলকাতা শহরে পাড়ি দিলেন, তার কারণ তিনি বুঝেছিলেন, ছেলেকে যদি পাকা উকিল বানাতে হয়, তা হলে শুধু ফারসি ভাষা দিয়ে চলবে না। সমাজে আসা নতুন ভাষা ইংরেজি ছেলেকে শেখাতেই হবে।
মধুসূদন অবশ্য বাবা-জেঠার মতোই পিতৃদ্রোহ ঘটালেন। প্রথম দ্রোহই হল ইংরেজি ভাল করে শিখেও, নামী উকিল হওয়ার চেষ্টা না-করে বরং বিখ্যাত কবি হওয়ার চেষ্টা করে। এক দিকে তাঁর এপিকিউরান বাবার হিন্দুধর্মীয় কৌলিক আচার-আচরণ মধু নিঃশব্দে অগ্রাহ্য করলেন। আবার, হিন্দু কলেজে পড়ার সময়, সে কলেজের প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক ডিরোজ়িয়োর স্মৃতি ও আদর্শ তখনও কলেজের প্রতিটি কড়িবরগায় বিদ্যমান হলেও মুখচোরা অন্তর্মুখী মধু বিখ্যাত ডিরোজ়িয়ো-শিষ্য অর্থাৎ দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, রামতনু লাহিড়ী, রাধানাথ শিকদার, প্যারীচাঁদ মিত্রের মতো হিন্দু ধর্মের সেকেলে গোঁড়া সংস্কারাচ্ছন্ন দিক নিয়ে কখনওই খুব বেশি সামাজিক হইচই করলেন না, কিন্তু মনে মনে নিশ্চয় হিন্দু ধর্মের আচার-বিচারের গোঁড়ামি থেকে নিজেকে বিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
ক্লাসের পড়াশোনাতেও নাকি মধুর তেমন মন ছিল না। কেউ কেউ বলছেন, পরীক্ষাতে কৃতিত্ব দেখানোর ক্ষেত্রেও তিনি নিতান্ত মাঝারি ছিলেন। সাহিত্যের প্রিয় অধ্যাপক ডেভিড রিচার্ডসনের ছাড়া অন্য ক্লাসে তাঁর তেমন মন ছিল না। অথচ, মধুসূদনের প্রায় সমস্ত সহপাঠী বলছেন, মধুসূদন ছাত্রবয়স থেকেই প্রায় জিনিয়াস। যেমন, কলেজে নাকি প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা হচ্ছে, মধু নাম দিতে চাইলেন না। বন্ধুবান্ধবদের ধরাকরাতে শেষে নাম দিলেন এবং প্রথম হলেন। তার পর এক দিন বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে ক্লাসঘরে তর্ক হল, কে বড়? শেক্সপিয়র না কি নিউটন? হিন্দু কলেজে তখন সবচেয়ে বিখ্যাত এবং কড়া অঙ্কের ইংরেজ অধ্যাপক ছিলেন রিজসাহেব। মধুসূদন তাঁর ক্লাসের ধারেকাছে ঘেঁষতেন না। এ-হেন রিজসাহেবের ক্লাসে এক দিন সহসা উপস্থিত হয়ে অধ্যাপক-প্রদত্ত একটা কঠিন আঁক বোর্ডে গিয়ে সবার সামনে কষলেন মধু। নির্ভুল সেই আঁক কষা দেখে স্বয়ং রিজসাহেব চমৎকৃত। তখন ভাবী কবি তাঁর মুখব্যাদানকারী সহপাঠী গণিতবীরদের উদ্দেশে মুচকি হেসে বললেন, “তা হলে দেখা যাচ্ছে যে, শেক্সপিয়র চাইলে নিউটন হতে পারেন, কিন্তু নিউটন চাইলেই শেক্সপিয়র হতে পারেন না।”
ছেলের উপরে বাবার আরও একটা দূরাগত প্রভাব লক্ষিত হয়। তা হল বাংলা ভাষা পড়া ও শেখার ব্যাপারে অপরিসীম তুচ্ছতাচ্ছিল্য। রাজনারায়ণের আপত্তিটি অবশ্য নেহাতই জাগতিক। যে ভাষা শিখলে লক্ষ্মীর পেঁচা উড়ে এসে বাড়ির কার্নিসে বসে না, সে ভাষা যতই মাতৃভাষা হোক, তা শিখে লাভ কী? অন্য দিকে, ছেলের আপত্তিটি ছিল পারমার্থিক। যে ভাষা শিখলে সরস্বতীর রাজহাঁস ঘরে এসে প্যাঁকপেঁকিয়ে সাঁতার কেটে কবিখ্যাতি এনে দিতে পারে না, সে ভাষা পড়ে কী হবে আর লিখেই বা কী হবে? অবশ্য এ ব্যাপারে মধুকে একা দুষে লাভ নেই। হিন্দু কলেজের সিলেবাসে তখন বাংলা অনুবাদে পড়ানো হত একাদশ শতাব্দীর সংস্কৃত আধ্যাত্মিক নাটক কৃষ্ণ মিশ্রের লেখা প্রবোধচন্দ্রোদয়। মাতৃভাষায় ওই জটিল অনুবাদ পড়লে যে কারও আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার কথা! বিশেষ করে ছাত্ররা যেখানে মূলে বেকন, হিউম বা বায়রনের সুললিত গদ্য ও পদ্য পড়ছে। মধুর কলেজের সিনিয়ররা, যেমন রামগোপাল, কৃষ্ণমোহন, প্যারীচাঁদ কেউই কৈশোরে বা যৌবনে বাংলা ভাষার প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাভক্তি দেখাননি। মধুর সমসাময়িকদের অনেকেই কম বয়সে তো বটেই, পরেও কেউ আর জীবনে এক বর্ণও বাংলা লেখেননি। প্যারীচাঁদ-ভূদেব-মধুসূদনরা তাও তো পরে বাংলা ভাষাকে ভালবেসে বড় সাহিত্যিক হয়েছিলেন।
কলেজে পড়তেই মধুসূদন নিজের পিতার অনুসরণে মদ্যপান করতে শিখলেন এবং প্রিয় অধ্যাপক রিচার্ডসনের থেকে শিখলেন যে সাহিত্য যদি ঠিক করে বুঝতে হয় তা হলে শুধু কাব্য পড়লে হবে না, নাটক পড়তে হবে এবং নিয়মিত ইংরেজি থিয়েটার দেখতে যেতে হবে। অতঃপর ধুতি-আচকান পরা মুখচোরা মধু রীতিমতো কোটপ্যান্ট পরে কলেজে আসতে শুরু করলেন। এবং দেখা গেল তাঁর হবু মানসপ্রিয়া শুধু শিক্ষিত হলে চলবে না, বরং সে মেয়েকে যেন হতে হবে আরও বেশ কিছু দিন পরে লেখা এক বাংলা গল্পের নায়কের গলায় বলার মতো: “আমি চাই বাস্তবের একটা সিনথেসিস। এমন নারী যে বল্লরী বাঁড়ুজ্যের মতন রূপসী, মিসেস চৌবের মতন সাহসী, জিগীষা দেবীর মতন লেখিকা, মেজদির ননদের মতন রসিকা, লোটি রায়ের মতন গাইয়ে, ফাখতা খাঁ-এর মতন নাচিয়ে।”
বলা বাহুল্য এই প্রথম মধু-পিতা রাজনারায়ণ পরশুরামের লেখা উপরোক্ত ‘রাতারাতি’ গল্পের নায়ক কার্তিকের বাবা চরণ ঘোষের মতনই খেপে চর্তুভুজ হলেন। ইতিমধ্যে নিজের একমাত্র ছেলের চালচলন রাজনারায়ণের যথেষ্ট গোলমেলে ঠেকেছে এবং তিনি ছেলেকে চেতাবনি দিয়েছেন, আর বেশি বেগড়বাই দেখলে কলকাতার কলেজ ছাড়িয়ে পত্রপাঠ তাকে সাগরদাঁড়িতে ফেরত পাঠাবেন। শেষ পর্যন্ত রাজনারায়ণ একমাত্র ছেলের বিয়ের জন্য সম্বন্ধ স্থির করলেন কুলীন ও ধনী এক অনূঢ়া জমিদার কন্যার সঙ্গে। এ দিকে মধু অপরিচিত মহিলাকে বিয়ে করতে রাজি নন। উনিশ শতকে এই প্রথম সম্বন্ধ করে বিয়ে করার দীর্ঘ কাল ধরে চলে আসা বাঙালি হিন্দু কুলীন রেওয়াজ কেউ অস্বীকার করল। কেউ কেউ বলেছেন, মধু তাঁর আরাধ্য ইংরেজ কবি লর্ড বায়রনের মতোই উভকামী ছিলেন (বন্ধু গৌরদাস বসাককে লেখা বেশ কিছু চিঠিতে তার সন্দেহজনক সাবুদ রয়েছে), কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিবাহোত্তর হৃদয়হীন সহবাসের চিন্তাই সংবেদনশীল মধুর পক্ষে অন্তরায় হয়ে উঠল। স্বীয় পিতা কর্তৃক তরুণ পুত্রকে বলপূর্বক বিবাহ সম্পাদন প্রক্রিয়ার কথা দিনরাত ভেবে-ভেবে কবির জীবন প্রায় বিষবৎ হয়ে উঠল। মধু ঠিক করলেন যে, অবশেষে সময় এসেছে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করার। তিনি ধর্মান্তরিত হয়ে হবেন খ্রিস্টান। এতে এক দিকে ওই বেয়াড়া বিয়ের হাত থেকে যেমন বাঁচা যাবে, তেমনই দুনো লাভ এই যে, কালাচামড়া হয়েও সভ্যতার নিরিখে এগিয়ে থাকা অ্যাংলো-স্যাক্সনদের সঙ্গে এ ক্ষেত্রে সমগোত্রীয় হওয়া যাবে। পাশাপাশি মিশনারিদের সঙ্গে দর কষাকষিও করা যাবে যে, খ্রিস্টান হওয়ার বাঁটোয়ারায় তাঁকে এ বার বিলেত পাঠানো হোক। সেখানে যে ভাবে হোক এক বার গিয়ে পড়তে পারলে, মধুর খ্যাতিমান কবি হওয়া রোখে কে?
কাউকে কিছু ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দিলেন না দত্তবাড়ির ছেলে। তার পর যে ভাবে বাবার চোখ এড়িয়ে এবং বাবার নানান পাইক বরকন্দাজদের সড়কি-লাঠির পাশ কাটিয়ে তিনি খ্রিস্টান হলেন, সে কাহিনি প্রায় রোমহর্ষক এক থ্রিলারের মতন। অগত্যা ছেলের কেরেস্তান হওয়া রুখতে মরিয়া হিঁদু বাবা রাজনারায়ণ প্রায় হাতজোড় করে ছেলের কাছে খবর পাঠালেন, তার বিয়ে তো বন্ধ করা হবেই, মধুর বিলেত যাওয়ার খাইখরচও তিনিই জোগাবেন। কিন্তু মধুসূদন তত দিনে মিশনারিদের ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের ভিতরে নিরাপদ আশ্রয়ে ঢুকে গিয়েছেন। তাঁর ফেরত আসার রাস্তা বন্ধ। শিল্প-সাহিত্যিক যশের জন্য সব ত্যাগ করা যায়, ধর্ম তো কোন ছার! অতঃপর ১৮৪২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, আঠারো বছর বয়সে মধুসূদন দত্ত মাইকেল নাম নিয়ে খ্রিস্টধর্মে ব্যাপটাইজ়ড হলেন।
সঙ্গে সঙ্গে দত্ত পরিবার থেকে গোটা কলকাত্তাইয়া হিন্দু সমাজে প্রবল প্রতিক্রিয়া শুরু হল। মধুর মা জাহ্নবীদেবী শয্যা নিলেন। হিন্দু কলেজের বেশ কিছু সহপাঠীও প্রবল বিরুদ্ধতা করলেন। উদ্বাস্তুর মতো মাইকেল তখন কলকাতা শহরে এ চার্চে বা ও পাদরির বাড়িতে ঘুরে বেড়ালেন। কোথাও বাড়িভাড়া পেলেন না। নাচার মধু গিয়ে ভর্তি হলেন গঙ্গা পেরিয়ে গোঁড়া খ্রিস্টান কলেজ— হাওড়ার বিশপ’স কলেজে। কবিতা লেখাও তাঁর সাময়িক ভাবে বন্ধ, যদিও বন্ধু গৌরদাসকে লেখা তাঁর চিঠিতে কবির প্রকৃত স্বপ্ন জাজ্বল্যমান, “দীক্ষা নেবার পর থেকে কবিতা তেমন লেখা হয়নি। তবে তার চেষ্টা করছি। আর এ বারে কোথা থেকে আমার কবিতা প্রকাশিত হবে জানো? একেবারে খাস লন্ডন থেকে।” (চিঠিতে আত্মবিশ্বাস জাহির করা এবংজাঁক দেখানোটি বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়)। রাজনারায়ণের গোসা যদিও অব্যাহত, কিন্তু গোপনে ছেলের খবর রাখছিলেন, লুকিয়ে পড়াশোনা আর জীবিকার খরচাপাতি তিনি তখনও মাসান্তে হিসেব কষে গুনে যাচ্ছেন।
মরিয়া পিতা এ-বার ঠিক করলেন, বেয়াড়া ধর্মত্যাগী একমাত্র পুত্রকে শিক্ষা দিতে তার খরচাপাতি দেওয়া বন্ধ করবেন। যাতে সে সময়কার আরও দু’-একটি হিন্দু বঙ্গসন্তানের মতো তাঁর ছেলেও দু’দিনের খ্রিস্টান হওয়ার শখ ছেড়ে স্বধর্মে প্রত্যাবর্তন করে। কিন্তু লাভ হল না। গোঁয়ার ছেলেকে ভুল চিনেছিলেন রাজনারায়ণ। সে তখন এমনকি লেখালিখিও ছেড়ে খ্রিস্টান মিশনারি হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। অগত্যা রাজনারায়ণ দ্বিতীয় পন্থা নিলেন। আবার বিয়ে করলেন এই কুলীন কায়স্থ, যাতে নতুন স্ত্রীর গর্ভে পুত্রসন্তান আসে। কিন্তু না, এই বিয়েতে কোনও সন্তান হল না। স্ত্রী জাহ্নবীদেবীর কাছে অনুমতি ও ক্ষমা চেয়ে আবারও দু’টি বিয়ে করলেন রাজনারায়ণ। কিন্তু যা তিনি চাইছিলেন, সেই দ্বিতীয় পুত্র এল না আর তাঁর জীবনে।
ও-দিকে নিজের ২৪ বছর বয়সে হিঁদু পিতার সেই কেরেস্তান ছেলে কুড়ি দিন ধরে সস্তার জাহাজে চেপে মাদ্রাজে গিয়ে থিতু হলেন। কারণ, কলকাতা শহর আর্থিক অভাবের কারণে তখন তাঁর কাছে দুর্বিষহ। মাদ্রাজে পৌঁছে মাইকেল একটি স্কুলে পড়ানোর চাকরি পেলেন। তার পর এই স্কুলেরই ছাত্রী রেবেকা ম্যাকটাভিসের সঙ্গে মাইকেলের আলাপ, বিবাহ, চার সন্তানের জন্ম এবং নিশ্চিন্তে সংসার যাপন করতে করতেই এক সহকর্মীর কন্যা হেনরিয়েটার সঙ্গে কবির জড়িয়ে পড়া। রেবেকার সঙ্গে অশান্তি এবং হেনরিয়েটাকে নিয়ে মাইকেলের প্রায় কপর্দকশূন্য হয়ে আবার কলকাতায় ফেরা। তখন তাঁর বয়স ৩২। মাইকেল আর কোনও দিন মাদ্রাজে ফেরেননি।
তবে এর আগে এক বার কলকাতায় ফিরেছিলেন মধুসূদন। মা জাহ্নবীদেবীর প্রয়াণের সংবাদে। প্রবাসী পুত্রকে খবর দিয়েছিলেন পিতাই। মাইকেলের বয়স তখন সাতাশও হয়নি। সে সময়কার ছোট শহর মাদ্রাজে থাকা মধুসূদন ইতিমধ্যেই মানসিক ভাবে অনেক দূরে, তদুপরি বিবাহিত এবং দ্বিতীয় সন্তান প্রত্যাশী। মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে এই বারে তাঁর মায়ের সাগরদাঁড়ির সেই বাল্যকালীন অপরিসীম, অগাধ স্নেহের কথা মনে পড়ল। চড়া দামে, প্রায় তিন মাসের বেতনের সমান অর্থ দিয়ে কলকাতাগামী জাহাজের টিকিট কাটলেন মাইকেল।
কলকাতায় ঢুকে সে বার দীর্ঘ দিন পরে অভিমানী ছেলের দেখা হল পিতার সঙ্গে। পিতা শীতল, গম্ভীর। মনে মনে স্ত্রীর মৃত্যুর জন্য তিনি তাঁর একমাত্র পুত্রকেই দুষতেন। অন্য দিকে, পুত্রের অভিমানের কারণ, পিতা তাঁর পড়াশোনার রাহাখরচ বন্ধ করেছিলেন তো বটেই, তার উপরে পিতার পর পর তিনটি বিয়ে নিশ্চয় মাতৃদেবীর জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল! শেষে ক’দিন মাত্র থেকে, এমনকি বাবাকেও কিছু না জানিয়ে মাদ্রাজের ফিরতি টিকিট কেটে জাহাজে চেপে বসলেন মাইকেল। জাহাজে যখন উঠছেন, তখনও অবশ্য তিনি জানেন না যে, তাঁর রাগী হিঁদু পিতার সঙ্গে এটাই শেষ দেখা।
এর চার বছর পরে রাজনারায়ণ দত্ত মারা যান। মাইকেলকে খবর দিলেন, সেই পুরনো সহপাঠী বন্ধু গৌরদাস। ওই চিঠিতে এ-ও জানালেন, মৃত পিতার সম্পত্তি নিয়ে জ্ঞাতিভাইয়েরা বিস্তর মারামারি কাটাকাটি করছে। আর সেই বিবাদের জের এতটাই যে, তাঁর কম বয়সি বিমাতারা পর্যন্ত সেই সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হতে বসেছেন। গৃধ্নু জ্ঞাতিভাইয়েরা এ কথাও রটিয়ে দিয়েছে, প্রবাসে দৈবের বশে মাইকেলের জীবনতারাটি ইতিমধ্যেই খসে গিয়েছে। গৌরদাসের চিঠিতে মাইকেল এ-ও জানলেন, যে পরিমাণ সম্পত্তি তাঁর পিতা রেখে গিয়েছেন, তার পরিমাণও নেহাত কম নয়। অন্য দিকে, হেনরিয়েটার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক এবং রেবেকার সঙ্গে দাম্পত্য বিবাদ মাদ্রাজের মতো ছোট শহরে আর চাপা ছিল না। রেবেকাও জানিয়ে দিয়েছেন আর একত্রে থাকা সম্ভব নয়। তা হলে পুরনো শহরে ফিরেই ভাগ্যান্বেষণ করা যাক। অতএব আবার পালানো। এ বার সেই শহরে পিতা-মাতা কেউ নেই আর, নেই কোনও আত্মীয়স্বজন।
আরও বেশ ক’বছর পরে। এই বোহেমিয়ান অভাবী ও চরম কর্জ-আক্রান্ত, কোর্টকাছারিতে ক্লান্ত, অভিশপ্ত, নিয়তিতাড়িত, যশোপ্রার্থী ছত্রিশ বছরের কবি কলকাতার লোয়ার চিৎপুর রোডের বাড়িতে লিখতে শুরু করলেন, তাঁর দীর্ঘ দিনের স্বপ্নকল্পনায় লালিত এক শিল্প-উড়ান; মেঘনাদবধ কাব্য। তত দিনে কবি বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর এত দিনকার অনাদরের জন্য অনুতাপ প্রকাশ করে ফেলেছেন। নাটককার ও কবি হিসেবে তিনি কলকাতার বিদ্বৎসমাজে পরিচিত নাম। নতুন কাব্যের প্রথম সর্গের মাঝামাঝি এসে ট্র্যাজিক-পিতা রাবণের মুখে, স্ব-উদ্ভাবিত বাংলাছন্দ অমিত্রাক্ষরে এই সংলাপ লিখলেন কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত: “...এ বজ্র আঘাতে/ কত যে কাতর সে, তা জানেন সে জন/ অন্তর্যামী যিনি; আমি কহিতে অক্ষম।/ হে বিবিধ, এ ভবভূমি তব লীলাস্থলী;/ পরের যাতনা কিন্তু দেখি কি হে তুমি/ হও সুখী? পিতা সদা পুত্রদুঃখে দুঃখী/ তুমি হে জগত পিতা, এ কি রীতি তব?/ হা পুত্র! হা বীরবাহু! বীরেন্দ্র-কেশরী!/ কেমনে ধরিব প্রাণ তোমার বিহনে?”
তখন কি ধর্মত্যাগী মুরতাদ এক কেরেস্তান ছেলের আঙুলে এসে নিঃশ্বাস ফেলেছিল সেই অভিমানী ছেলেকে নিবিড় ভাবে ভালবাসা ও একই সঙ্গে আজীবন চটে থাকা কোনও রাগী হিঁদু পিতা? জানি না। কল্পনা করা আমাদের কাজ নয়, করতেও চাইনে। বরং এখানেই ইতি টানা ভাল।