—প্রতীকী চিত্র।
পাঁচটি আঙুল খুইয়ে হরিয়ানার রেখা দেবী এখন ঘরে বসে আছেন; বিহারের ইন্দু দেবীর হাতের দু’আঙুল কাটা পড়েছে; উত্তরপ্রদেশের সায়রা বানু তিনটি আঙুল খোয়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কাজও হারিয়েছেন। রেখা দেবীর কন্যা জ্যোতি দেবী একটি অসরকারি সংস্থার সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, তাঁর মা তাঁদেরকে পড়াশোনা শেখানোর স্বপ্ন নিয়ে ফরিদাবাদের গাড়ি কারখানায় অদক্ষ শ্রমিক হিসাবে কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু রেখাকে কিছু দিনের মধ্যেই দক্ষ শ্রমিকের কাজে পাঠান, এবং উৎপাদন বাড়ানোর জন্য চাপ দেন কর্তৃপক্ষ। কিছু দিন পরেই ঘটে দুর্ঘটনা, এবং কাজ হারান রেখা।
ফরিদাবাদে অবস্থিত একটি অসরকারি সংস্থার বার্ষিক রিপোর্টে রেখার মতো শ্রমিকদের কথা ধরা পড়েছে। হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র ও উত্তরাখণ্ডের দেশি-বিদেশি গাড়ি কারখানায় কাজের নিরাপত্তার পরিস্থিতি নিয়ে সংস্থাটি প্রতি বছর কর্মরত এক হাজার আহত শ্রমিকের নাম, ছবি-সহ রিপোর্ট প্রকাশ করে। ২০২৩ সালের পঞ্চম বার্ষিক প্রতিবেদনে (সেফ ইন ইন্ডিয়া রিপোর্ট) মোট ছ’হাজার আহত শ্রমিকের তথ্য, দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ডের গাড়ি কারখানাগুলির অবস্থা তুলে ধরেছে তারা। দেখা যাচ্ছে, আঙুল যাঁদের বাদ গিয়েছে, তাঁদের মধ্যে অদক্ষ মহিলা-শ্রমিকই সিংহ ভাগ। এঁদের সহায়ক বা শিক্ষানবিশ হিসাবে কাজে নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু প্রশিক্ষণ ছাড়াই পাওয়ার প্রেস, পেডাল প্রেস মেশিনের মতো যন্ত্রের সামনে বসানো হয়েছিল, যেখানে কাজ করা ঝুঁকিপূর্ণ। মজুরি অবশ্য দেওয়া হয়েছে অদক্ষ মজুরেরই, দৈনিক ২৭০-৪০০ টাকা। যেখানে দেশের জিডিপি-তে ৭.১% উৎপাদন গাড়ি শিল্প থেকেই আসছে, সেখানে গাড়ি কারখানাগুলির শ্রমিকদের অবস্থা এমনই বিপন্ন।
কেন্দ্রীয় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রকের ‘ডিরেক্টরেট জেনারেল ফ্যাক্টরি অ্যাডভাইস সার্ভিস অ্যান্ড লেবার ইনস্টিটিউটস’ জানিয়েছে, ২০১৭-২০ সালের মধ্যে দেশের নথিভুক্ত কারখানাগুলিতে দু’কোটি শ্রমিক নিযুক্ত রয়েছেন। দুর্ঘটনায় গড়ে প্রতি দিন তিন জন শ্রমিক মারা গিয়েছেন, এগারো জন আহত হয়েছেন। ২০১৮-২০’র মধ্যে অন্তত ৩৩৩১ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।
রাজ্যের ছবিটিও উজ্জ্বল নয়। সরকারি তথ্য অনুসারে ২০১৭-২০২০, এই সময়কালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের কারখানায় গুরুতর দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৯টি, সাধারণ দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৩টি। যদিও অনেকে মনে করেন, প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি। শ্রম আইন (১৯৪৮) লঙ্ঘন করে রাজ্যের খোলা, অর্ধেক খোলা কারখানাগুলিতে দৈনিক বারো ঘণ্টা করে কাজ চলছে। কাজ করতে গিয়ে আঙুল হারানোর ট্র্যাজেডি এ রাজ্যেও ঘটছে অনেক, তবে তা প্রধানত চটকলে। অদক্ষ ‘ভাউচার’ শ্রমিকদের ‘তাঁত’ বিভাগে কাজে লাগানো হচ্ছে। ইএসআই হাসপাতালের ‘জিডিএ’ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আঙুল থেঁতলে গিয়েছে, বুকে মাকুর আঘাত লেগেছে, শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে, এমন শ্রমিকদের ভর্তি করার পর প্রায়ই দেখা যায়, তাঁদের ইএসআই কার্ডে নাম নেই। ফলে তাঁরা উচ্চমানের চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন।
চটকলের স্পিনিং ও লুম (তাঁত) বিভাগের কত শ্রমিকের আঙুলের মাথা থেকে কাটা, কোনও অসরকারি সংস্থা সমীক্ষা করেনি। আঙুল অক্ষত আছে, এমন লোক কম, দাবি অনেক শ্রমিকের। অনেক সময়ে কারও হাতও বাদ গিয়েছে। এ সবের চিকিৎসা শ্রমিকদের ইএসআই হাসপাতালে পাওয়ার কথা। সমস্যা দেখা দেয় সেই কারখানা আগে বন্ধ থাকলে, কিংবা ইএসআই কার্ডে টাকা না ঢুকলে, অথবা ভাউচার শ্রমিক হলে। এর জন্যে শ্রমিকদের প্রতি সরকারের উদাসীনতাকেই দায়ী করলেন এক ট্রেড ইউনিয়ন নেতা। পিএফ, গ্র্যাচুইটি, ইএসআই নম্বর যুক্ত কার্ড যথাসময়ে পাওয়ার দাবি করেছেন হরিয়ানা, উত্তরাখণ্ড, মহারাষ্ট্রের গাড়ি-শ্রমিকরাও।
চটকলে কর্মরত মহিলার সংখ্যা পুরুষদের তুলনায় কম, ফলে আহতদের মধ্যে মহিলার সংখ্যা খুব বেশি নয়। ইএসআই হাসপাতালে কর্মরত নার্সরা জানালেন, চটকল থেকে হাসপাতালে আসা শ্রমিকদের কুড়ি জনের মধ্যে এক জন হয়তো মহিলা। তবে মেয়েরা সাধারণত মেশিনের দুর্ঘটনায় আহত হয়ে আসেন না। বরং কাজ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, প্রেসার কমে যাওয়া, নার্ভের সমস্যা দেখা দেওয়ার কারণে আসছেন মেয়েরা। ‘নয়া ভারত’-এ শ্রমিকের জীবনে দুর্ঘটনা-মৃত্যু এড়ানো যাচ্ছে না কেন, কেনই বা শ্রমিকরা যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থা থেকে, চিকিৎসা-সহ ন্যায্য পাওনাগুলি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, সে বিষয়টি যথেষ্ট আলোচিত হচ্ছে না। দুর্ঘটনা কমানোর উদ্দেশ্যে কারখানার মেশিনগুলি সারানোর দাবিকে শ্রমিক সংগঠনগুলিও যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে না।
‘সেফটি নীতি ২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ফরিদাবাদের অসরকারি সংস্থাটি। সেখানে গাড়ি শিল্পের কর্তাদের প্রতি একটি চিঠি লিখেছেন বারো জন শ্রমিক। বলেছেন, সুপরিচিত ব্র্যান্ডের গাড়ি তৈরির কারখানাতেও মেশিনগুলির রক্ষণাবেক্ষণ হয় না। সুরক্ষার জন্যে যে মেশিনগুলিকে কিছু কিছু সময় বিশ্রাম দেওয়া প্রয়োজন, সেই মেশিনগুলিকেও একটানা চালানো হয়, যাতে উৎপাদনের লক্ষ্য পূরণ করা যায়। ‘সেফটি অডিট’ করার সময়ে পরিদর্শকরা কেবল কারখানার সুপারভাইজ়রদের সঙ্গে কথা বলেন, শ্রমিকদের কথা শোনেন না। সেফটি অডিট কর্মীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার দাবি জানিয়েছেন এই বারো জন শ্রমিক, যাঁরা সকলেই একাধিক আঙুল, বা হাতের পাতা হারিয়েছেন, বা মাথায় চোট পেয়েছেন গাড়ি কারখানার কাজে। এ ভাবে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা থেকে শ্রমিকের সুরক্ষার বিষয়টিকে শিল্প-বাণিজ্য সংক্রান্ত আলোচনায় আনার চেষ্টা চলছে।