— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
অতিমারির কল্যাণে দু’তিন বছর আগে ‘বিচ্ছিন্নতা’ নামক শব্দের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটেছে। অতিমারির পরে সেই একই শব্দের অন্য একটি অসুখ প্রকট হয়েছে অন্য ভাবে। নতুন অসুখ নয়, কিন্তু এখন তা অনেক বড় আকারে ছড়িয়ে পড়ছে, অতিমারির মতোই। সামাজিক অনীহা বা বিচ্ছিন্নতা— বিভিন্ন নামেই ডাকা যায় তাকে।
ডাকা যায় হিকিকোমোরি নামেও। জাপানি ভাষায় হিকু-র অর্থ পিছিয়ে আসা, কোমোরুর অর্থ নিজেকে সরিয়ে নেওয়া। দুইয়ে মিলে সমাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া। গত নভেম্বরে হওয়া এক সমীক্ষায় প্রকাশ, জাপানে প্রায় ১৫ লক্ষ কর্মক্ষম মানুষ সামাজিক অনীহায় আক্রান্ত। যার বীজ বপন হয়েছে বহু আগে। এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের শিরায় শিরায়। কিয়ুশু বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্বের অধ্যাপক তাকাহিরো কাতো-র মতে, হিকিকোমোরির সূচনা জাপানি সংস্কৃতির কারণে। তাঁর কথায়, কঠোর সামাজিক রীতি এবং প্রচ্ছন্ন একটি ‘শেমিং’ তথা ‘লোকে কী বলবে’ সংস্কৃতির জন্য জাপানে হিকিকোমোরির এত তীব্র প্রকাশ।
জাপান ধনী দেশ, বেকারত্বও সে ভাবে নেই। তা হলে সমস্যা কোথায়? একটা বড় সমস্যা হল সফল হওয়ার চাপ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিধ্বস্ত জাপান রাজতন্ত্র থেকে বেরিয়ে গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদী দেশ হিসাবে তৈরি হয়েছে। যার মূল কাঠামো উৎপাদন ও উপার্জন। আনুগত্যের সামাজিক প্রবণতা, প্রবল কাজের চাপ এবং শ্রমের যথাযথ মূল্য না পাওয়া মিশে গিয়ে মানুষের মধ্যে ক্রমে বীজবপন হয় অসন্তোষের। যার ফল কারোশি (অতিরিক্ত কাজের ফলে মৃত্যু), কারো-জিসাৎসু (কাজের চাপ নিতে না পেরে আত্মহত্যা) এবং হিকিকোমোরি। এর সঙ্গে যোগ হয় পারিবারিক অশান্তি, অসন্তোষ ও চাপ সহ্য করতে না পারায় নিজেকে অপদার্থ ভাবার প্রবণতা। এই সামাজিক উদ্বেগ ও অসহায়তার দোলাচলই জন্ম দেয় এক গভীর অনীহার। অনীহা সমাজ সম্পর্কে, চার পাশের মানুষজন সম্পর্কে, আসলে জীবন সম্পর্কেই। জাপানের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের মতে, কোনও প্রকট মানসিক সমস্যা না থাকা সত্ত্বেও ৬ মাসের বেশি ঘর থেকে না বেরোনো, কাজে বা শিক্ষাক্ষেত্রে না যাওয়া ও বন্ধুহীনতা এই অনীহার পরিচায়ক।
গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকেই জাপানে স্থায়ী চাকরির সুযোগ কমেছে। বেড়েছে স্বল্প বেতনের অস্থায়ী চাকরির চল। তার ফলে মধ্যবিত্তের সংসারে টানাটানি, তার ফলে ক্রমবর্ধমান তিক্ততা। সন্তানহীনতা থেকে বৈবাহিক সম্পর্কে ভাঙন। অনেক মানুষ আস্তে আস্তে আশ্রয় খুঁজে নিচ্ছেন চার দেওয়ালের মধ্যে। সমাজমাধ্যম, টেলিভিশন দিয়ে দুনিয়া দেখছেন। তার পর একা একা স্রেফ মরে যাচ্ছেন। আকিতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষায় হিকিকোমোরিতে আক্রান্ত এক তরুণ জানিয়েছিলেন, ২৫ বছর বয়সে তিনি চাকরিতে ঢোকেন। ক্রমাগত সফল হওয়ার চাপ তিনি সইতে পারেননি। কোথাও আর টিকতে পারেননি। এখন তিনি এক জন উদ্দেশ্যহীন মানুষ। বিশ্ব জুড়েই এই উদ্দেশ্যহীন একাকিত্বের প্রকোপ বাড়ছে। বাড়ছে এ দেশেও। স্মার্ট ফোন, সমাজমাধ্যমে মুখ গুঁজে বাঁচছে মানুষ। স্থায়ী চাকরির অন্বেষণে আসছে হতাশা। অস্থায়ী চাকরিতে হাড়ভাঙা পরিশ্রম। সেখান থেকে মুক্তি খুঁজছে মানুষ। ‘নিজস্ব সময়’ খুঁজছে, যে অন্বেষণ শেষ হচ্ছে চার দেওয়ালের মধ্যে, ইন্টারনেটের দুনিয়ায়।
এ অবসাদের শিকড় আছে বিচ্ছিন্নতার বোধে। আর সেই বিচ্ছিন্নতার উৎসে আছে অর্থনীতি। প্রায় ১৮০ বছর আগে তার সূত্রটি উন্মোচন করেছিলেন কার্ল মার্ক্স, তাঁর বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বে। ১৮৪৪ সালে ইকনমিক অ্যান্ড ফিলসফিক ম্যানুস্ক্রিপ্টস-এ দেখিয়েছিলেন তিনি, যে মুহূর্তে উৎপাদনক্ষেত্র হয়ে ওঠে কারখানা, উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে শ্রমিক তাঁর সংযোগ হারান। উৎপাদিত দ্রব্যটি শ্রমিকের কাছে হয়ে পড়ে অচেনা। অথচ নিজের সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে নিজের প্রয়োজনের জিনিস উৎপাদন করার যে শ্রম, তার দ্বারাই মানুষের নিজস্ব উন্নতি হয়; এবং শুধু তা-ই নয়, প্রকৃতি ও পারিপার্শ্বিক সমাজের সঙ্গে তার যোগসূত্রও স্থাপিত হয়। কিন্তু পুঁজির শাসনে শ্রমজীবী মানুষ সেই যোগসূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তার ফলে হারিয়ে যায় তার প্রকৃত মানবসত্তা।
আমরা কাজের মাধ্যমেই সমাজের সঙ্গে, পরস্পরের সঙ্গে, নিজের সামাজিকসত্তার সঙ্গে সংযোগ খুঁজে পাই। কিন্তু পুঁজির শাসনে চালিত অর্থনীতির জাঁতাকলে সেই সংযোগের মুঠো ক্রমশ আলগা হয়ে আসে। আমাদের সব প্রয়োজন মেটানোর জন্য ক্রমশই বাজারের হাতে নিজেদের ছেড়ে দিতে হয়, এমনকি প্রয়োজনগুলোও তৈরি করে দেয় বাজার। তার ফলে জীবনের মানেটাই পাল্টে যেতে থাকে। চুইয়ে চুইয়ে প্রবেশ করে বিচ্ছিন্নতা।
মানুষের সঙ্গে মানুষের নতুন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টাই এই অবসাদ থেকে মুক্তির পথ। পাল্টে যাওয়া সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে থেকেও ছুঁতে হবে মানুষের অন্তর। তবে যদি খুঁজে পাওয়া যায় হারানো সুতোর শেষ প্রান্তটি।