—ফাইল চিত্র।
নির্বাচনের পর নতুন সরকার গঠিত হল, এ বার সেই সরকার বিভিন্ন বিষয়ে নতুন নীতি রূপায়ণ করবে। অর্থ মন্ত্রকের নর্থ ব্লকে কী ভাবে নীতি রূপায়ণের কাজটি হয়, এবং আগামী কয়েক মাসে এই সরকারের থেকে কী কী আশা করা যেতে পারে, সে বিষয়ে অনেক কিছুই পড়ছি গত কয়েক দিন যাবৎ। পড়তে পড়তে মনে পড়ে যাচ্ছে নর্থ ব্লকে আমার শুরুর দিনগুলোর কথা— ভারত সরকারের হয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতার সূচনাপর্ব।
আমার সৌভাগ্য যে, আমি চমৎকার সব মানুষের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। তাঁদের মধ্যে যেমন ছিলেন আমার দুই বস— প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ও অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়— তেমনই ছিলেন আমার অফিসের কর্মীরা, দফতর চালানোর কাজে প্রতিনিয়ত যাঁদের সহযোগিতা পেয়েছি। বলতে দ্বিধা নেই, খুবই ইতিবাচক পরিবেশ ছিল অর্থ মন্ত্রকে— বন্ধুত্বপূর্ণ কাজের পরিবেশ, সবাই সাহায্য করতে প্রস্তুত। কিন্তু আমার কাছে সে এক সম্পূর্ণ নতুন দুনিয়া। তার আগে অবধি আমি আজীবন শুধু অর্থনীতির গবেষণা করেছি, এবং ক্লাসে ছাত্রদের অর্থশাস্ত্র পড়িয়েছি, তা সে ভারতে হোক বা আমেরিকায়। সরকারি দুনিয়ায় এই প্রথম পা রাখলাম আমি।
সে সময়ের কিছু মজার অভিজ্ঞতা পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিতে ইচ্ছা করছে।
আমি যে এক সম্পূর্ণ অন্য দুনিয়ায় পা রেখেছি, খুব তাড়াতাড়িই টের পেলাম। আমার জন্য বরাদ্দ হয়েছিল একটি অ্যাম্বাসাডর গাড়ি। অফিসে যাব বলে গাড়িতে উঠেছি— অভ্যাসবশে সিটবেল্ট লাগাতে গেলাম। আমার গাড়ির চালককে দেখে মনে হল, খুবই অস্বস্তিতে পড়েছেন তিনি। প্রসঙ্গত, পরে টের পেয়েছি যে, মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা নামক গেরামভারী পদের অধিকারীর গাড়ির সারথি বলে তাঁর বেশ গর্ববোধ ছিল। আমায় সিটবেল্ট পরতে দেখে শেষ অবধি নিজের আপত্তি আর চেপে রাখতে পারলেন না তিনি। আমার দিকে ঘুরে বললেন, “স্যর, আমি জানি আপনি আগে শিক্ষক ছিলেন; তবে এখন আপনি দেশের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা। আর সিটবেল্ট পরার কোনও প্রয়োজন নেই!” বলা বাহুল্য, লোকটিকে আমার ভারী মনে ধরল! তবে, এটাও বুঝলাম যে, এক নতুন, অচেনা দুনিয়ায় পা দিয়েছি আমি।
এখন আমি কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে গেম থিয়োরি বা দ্বন্দ্ব তত্ত্বের যে কোর্সটি পড়াই, তার একটি অংশের নাম ‘বারগেনিং থিয়োরি’। এই তত্ত্বটির উদ্ভাবক ছিলেন আশ্চর্য প্রতিভাধর গণিতজ্ঞ জন ন্যাশ। আ বিউটিফুল মাইন্ড নামের ছবিটিতে রাসেল ক্রো অভিনয় করেছিলেন তাঁর ভূমিকায়, এটা বললে হয়তো ন্যাশকে মনে করতে সুবিধা হবে। মাত্র ২২ বছর বয়সে বারগেনিং বিষয়ে দু’টি ছোট পেপার লিখেছিলেন ন্যাশ। তার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তিনি আক্রান্ত হন স্কিৎজ়োফ্রেনিয়া রোগে, গবেষণার জগৎ থেকে হারিয়ে যান। কিন্তু, তাঁর ওই দু’টি ছোট গবেষণাপত্র ‘বারগেনিং থিয়োরি’-র ভিত গড়ে দিয়েছিল। গোটা দুনিয়ায় গেম থিয়োরির ক্লাসরুমে, এবং আমেরিকার আদালতকক্ষে, তার ব্যবহার চলছে।
কিন্তু, বারগেনিং থিয়োরির সেরা বাস্তব উদাহরণটি আমি কোনও ক্লাসঘরে পাইনি, পেয়েছিলাম দিল্লির অর্থ মন্ত্রকে আমার অফিসের কর্মীদের থেকে। সে কথা বলি। মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টার অফিসে আমার চিফ অব স্টাফ ছিলেন সোমনাথন নামে এক জন— খুবই নির্ভরযোগ্য মানুষ। এক দিন তিনি আমার অফিসে এলেন। তিনি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে, এবং তাঁর ঘাড়ের উপর দিয়ে আর কয়েক জন উঁকি মারছে, এমন অবস্থায় সোমনাথন আমায় জানালেন, আমার মতো উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের সরকার ৬০০০ টাকা অবধি দামের ব্রিফকেস কিনে দিয়ে থাকে। সেই মুহূর্তে আমার আদৌ একটা নতুন ব্রিফকেসের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু সোমনাথন ও তাঁর ঘাড়ের উপর থেকে উঁকি মারা সহকর্মীদের হতাশ করতে মন চাইল না। বললাম, আমায় কয়েকটা স্যাম্প্ল দেখানোর ব্যবস্থা করা হোক।
পর দিনই এক সর্দারজি হাজির আমার অফিসে। তাঁর হাতে ছ’টি ব্রিফকেস, তবে বলে না-দিলে সেগুলোর মধ্যে ফারাক খুঁজে পাওয়া কঠিন। আমার টেবিলের উপরে সেগুলো সাজিয়ে রাখা হল। মনে হচ্ছিল, স্বয়ংবর সভা চলছে— সামনে রাজপুত্রের দল, এক জনের গলায় আমি বরমাল্যটি পরিয়ে দিলেই হয়! সোমনাথন এলেন; তাঁর পিছন পিছন এলেন আমার পার্সোনাল সেক্রেটারি ও সহায়করা; তাঁদেরও পিছনে এলেন আমার পিয়নরা। এই শেষের দলটি এমনিতে লাজুক— কিন্তু এই মহাভারত-তুল্য ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করার লোভ তাঁরাও সামলাতে পারেননি বলে দেখা গেল।
আমার উদ্দেশে মৃদুস্বরে উপদেশাবলি ভেসে আসতে আরম্ভ করল; বিভিন্ন ব্রিফকেসের দিকে ইতিউতি আঙুলও উঠল। আমার কোন ব্রিফকেসটা বাছা উচিত, সে বিষয়ে দফতরের বিভিন্ন স্তরের কর্মীরা আমায় সৎ পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু, ব্রিফকেস বাছার চেয়ে ঢের জরুরি কাজ পড়ে রয়েছে তখন। কাজেই, খুব একটা ভাবনাচিন্তা ছাড়াই একটা ব্রিফকেস বেছে নিলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সম্মিলিত দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা গেল— আমায় জানানো হল, আমার জন্য বরাদ্দ যেখানে ৬০০০ টাকা, আমি সেখানে মাত্র ২৫০০ টাকা দামের ব্রিফকেস বেছেছি! আর কথা বাড়াব না ভেবে বললাম, যে দামেরই হোক, এটাই আমার সবচেয়ে বেশি পছন্দ হয়েছে। আমার সহায়কদের মধ্যে এক জন বললেন, “তা হলে স্যর, আপনি দুটো ব্রিফকেস নিন।” আমি নিশ্চিত নই, তবে এই ভদ্রলোক সম্ভবত অর্থনীতি নিয়ে লেখাপড়া করেছিলেন— অর্থনীতিবিদদের কাছেই সব সমস্যার এমন চটজলদি সমাধান থাকে! প্রস্তাবটি শুনে অন্যরা বেশ সপ্রশংস ভঙ্গিতে তাঁর দিকে তাকালেন।
কিন্তু, প্রস্তাব ধোপে টিকল না। আমলাতন্ত্রের চৌহদ্দিতে তুলনায় বেশি পোড়-খাওয়া এক কর্মী জানালেন, “নিয়ম হল, ৬০০০ টাকা অবধি খরচ করা যাবে, কিন্তু একটার বেশি ব্রিফকেস কেনা যাবে না।” এ বার মুখ খুললেন এক পিয়ন। তাঁর দার্শনিক সত্তা চমকে দেওয়ার মতো— “আরে, দুটোই বা কী, একটাই বা কী? স্যর, দুটো ব্রিফকেস মানে তো আসলে একটাই ব্রিফকেস, যার দুটো কম্পার্টমেন্ট রয়েছে!” এমন অদ্বৈতবাদী কথা শুনে ‘সাধু, সাধু’ রব উঠল; দু’এক জন তাঁর পিঠ চাপড়ে দিলেন।
ভেবে দেখলাম, আমার সামনে দুটো রাস্তা রয়েছে— এক, আমার দফতরের কর্মীদের এই সব ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া উপেক্ষা করে তাঁদের ভাবাবেগে আঘাত দেওয়া; অথবা একটা নয়, দু’দুটো বেশ ‘বলতে নেই’-টাইপ খারাপ দেখতে ব্রিফকেসের মালিক হওয়া। দু’দিকের লাভ-ক্ষতি হিসাব কষে শেষ পর্যন্ত বললাম, “ঠিক আছে, দুটো ব্রিফকেসই নেব। কিন্তু, সরকার যে-হেতু ৬০০০ টাকা দেবে, আর দুটো ব্রিফকেসের দাম যে-হেতু ৬৭০০ টাকা পড়ছে, তাই বাকি ৭০০ টাকাটা আমার থেকে নিয়ে নিন।” আমার কথা শুনে দফতরের কর্মীরা স্তম্ভিত। তাঁরা সর্দারজিকে বললেন, “আপনি তো একটা ব্রিফকেস বেচবেন বলে এসেছিলেন। উনি দুটো নিচ্ছেন। ওই ৭০০ টাকাটা ডিসকাউন্ট দিন, মশাই।” সর্দারজি দাড়ি চুলকে একটু ভাবলেন, তার পর রাজি হয়ে গেলেন। এ ভাবেই আমি দুটো ব্রিফকেসের গর্বিত মালিক হলাম, যার মধ্যে একটাও আমি চাইনি।
গল্প বলা শেষ, এ বার ন্যাশের স্বতঃসিদ্ধ আর উপপাদ্যগুলোকে আর এক বার ঝালিয়ে নিই, আমার ক্লাস লেকচারের জন্য।