নমুনা বাছাইয়ের পদ্ধতি পাল্টানোয় প্রকৃত ছবিটি ঝাপসা হয়েছে
Poverty In India

দারিদ্র কমানোর ম্যাজিক

দারিদ্র কতটা কমেছে, তা দেখার জন্য নিম্নতম ২০% পরিবারের মাথাপিছু ব্যয়ের দিকে তাকানোই যথেষ্ট। এনএসএসও দু’ভাবে পরিবারগুলির মাসিক মাথাপিছু ব্যয় মেপেছে।

Advertisement

অভিরূপ সরকার

শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০২৪ ০৭:৩১
Share:

২০২২-২৩ সালে ভারতীয় পরিবারগুলির মাথাপিছু মাসিক ব্যয় নিয়ে যে রিপোর্ট ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অফিস (এনএসএসও) প্রকাশ করল, সন্দেহ নেই, তার একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে। এর আগে, ২০১৭-১৮ সালে, অনুরূপ একটা রিপোর্ট তৈরি হয়েছিল, কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার সেটাকে প্রকাশ করতে দেয়নি, কারণ রিপোর্টের ফাঁস হয়ে যাওয়া অংশ অনুযায়ী, তাতে দেখা গিয়েছিল যে ২০১১-১২’র তুলনায় ২০১৭-১৮’তে মাথাপিছু মাসিক ব্যয় কমেছে, দারিদ্র বেড়েছে। এ বার আর সে ভয় নেই। পূর্ণাঙ্গ ডেটা-সম্বলিত রিপোর্ট অবশ্য এখনও বেরোয়নি, কিন্তু তার বদলে সমীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফলের সারাৎসার নিয়ে যে ফ্যাক্টশিট প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে ২০১১-১২’র তুলনায় ২০২২-২৩ সালে ভারতীয় পরিবারগুলির মাথাপিছু মাসিক ব্যয় অভূতপূর্ব হারে বেড়েছে। একই সঙ্গে দারিদ্রের হার নেমে গেছে ২২.৯% থেকে ৫ শতাংশের কাছাকাছি। অর্থাৎ এনএসএসও-র এই রিপোর্টটির মাধ্যমে লোকসভা ভোটের আগে বার্তা দেওয়া হচ্ছে, মোদী-জমানায় শুধু যে অবস্থাপন্নদের উন্নতি হয়েছে তা-ই নয়, উন্নতির সুফল চুইয়ে-চুইয়ে সমাজের নিম্নতম শ্রেণির কাছেও পৌঁছে গিয়েছে।

Advertisement

দারিদ্র কতটা কমেছে, তা দেখার জন্য নিম্নতম ২০% পরিবারের মাথাপিছু ব্যয়ের দিকে তাকানোই যথেষ্ট। এনএসএসও দু’ভাবে পরিবারগুলির মাসিক মাথাপিছু ব্যয় মেপেছে। প্রথমে, বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প থেকে পরিবারগুলি যে ভোগ্যপণ্য পেয়েছে— রেশনের চাল-গম থেকে শুরু করে সাইকেল, ল্যাপটপ, ইস্কুলে যাওয়ার ব্যাগ, বইখাতা— সে সব বাদ দিয়ে শুধুমাত্র পারিবারিক আয় থেকে যে খরচটা করা হয়েছে, ‌তার হিসাব করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, সরকারি প্রকল্প থেকে বিনামূল্যে পাওয়া ভোগ্যপণ্যগুলির বাজারের দাম পারিবারিক ব্যয়ের সঙ্গে যোগ করলে যে মাথাপিছু ব্যয়ের অঙ্কটা পাওয়া যাচ্ছে, তা হিসাব করা হয়েছে। পরিবারগুলিকে তাদের মাথাপিছু মাসিক ব্যয়ের নিরিখে কয়েকটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে।

যে পরিবারের দৈনিক মাথাপিছু খরচ ২.১৫ ডলার বা তার কম, বিশ্ব ব্যাঙ্ক তাকে দরিদ্র বলছে। টাকার অঙ্কে এই ডলারের মূল্য হিসাব করতে গেলে পার্চেজ়িং পাওয়ার প্যারিটি অর্থাৎ ক্রয়ক্ষমতা-নির্ভর টাকা-ডলারের বিনিময় মূল্যের দিকে তাকাতে হবে। ২০২২ সালে এই বিনিময় মূল্য ছিল ডলার প্রতি ২২.৮৮ টাকা। সেই হিসাবে কোনও পরিবারের মাসিক মাথাপিছু খরচ ১৪৭৬ টাকা বা তার কম হলে বিশ্ব ব্যাঙ্কের মাপকাঠি অনুযায়ী তাকে দরিদ্র বলা যায়। মাসিক ভোগব্যয়ের যে হিসাব সরকারি পরিসংখ্যান থেকে বেরিয়ে আসছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে, একমাত্র গ্রামাঞ্চলের দরিদ্রতম পাঁচ শতাংশ পরিবারের মাসিক মাথাপিছু ভোগব্যয় এর চেয়ে কম— বিনামূল্যে পাওয়া ভোগ্যবস্তু বাদে তাদের ব্যয় মাসে ১৩৭৩ টাকা, বিনামূল্যের পণ্য ধরলে তা ১৪৪১ টাকা। অর্থাৎ এনএসএসও-র নতুন তথ্য অনুযায়ী দারিদ্রের হার ৫%-এ নেমে এসেছে।

Advertisement

কথাটা সত্য হলে এ এক মস্ত সুখবর। কিন্তু, কথাটা সত্য কি না, তা নিয়ে গভীর সংশয় আছে। আমরা জানি, পর পর বিমুদ্রাকরণ, জিএসটি এবং লকডাউন এসে দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্রটিকে এবং তার উপরে নির্ভরশীল গরিব মানুষদের ছারখার করে দিয়েছিল। সেই উপর্যুপরি আঘাতগুলি সামলে দেশের গরিব মানুষ কেমন করে রাতারাতি তাঁদের মাসিক ব্যয় বাড়িয়ে ফেললেন? লকডাউনের সময় বা তার আগে থেকেই অবশ্য কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারগুলি গরিবদের জন্য প্রকল্পের সংখ্যা এবং বরাদ্দ বাড়িয়েছিল। বিনামূল্যে রেশনের মতো কিছু প্রকল্প এখনও চালু আছে। কিন্তু, কল্যাণমূলক এই প্রকল্পগুলির জন্য দারিদ্রের হার কমে গিয়েছে, সে কথা বলা মুশকিল। কারণ, সরকারি হিসাবই দেখাচ্ছে, বিনামূল্যে পাওয়া ভোগ্যপণ্যগুলিকে বাদ দিলেও গ্রামাঞ্চলের দরিদ্রতম পাঁচ শতাংশ পরিবার বাদে আর সব পরিবারেরই মাসিক মাথাপিছু ভোগব্যয় ১৪৭৬ টাকার চেয়ে বেশি। এ কথা ঠিক যে, সেই ব্যয়ের টাকার কিছুটা এসেছে বিধবাভাতা বা কৃষকভাতার মতো সরকারি নগদ হস্তান্তর প্রকল্পে পাওয়া অর্থ থেকে। কিন্তু সারা দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এর পরিমাণ এতটা বেশি নয় যে, দারিদ্র একেবারে পাঁচ শতাংশে নেমে যাবে।

সংশয়ের কারণ আরও আছে। ২০১৯-২১ এই দু’বছরে বিশ্ব ব্যাঙ্ক ভারতে একটা সমীক্ষা করেছিল। সেই সমীক্ষার ভিত্তিতে বিশ্ব ব্যাঙ্কের অনুমান, ২০২১ সালে ১৮.২ কোটি অর্থাৎ ১২.৯২% ভারতীয় ২.১৫ ডলার মাপকাঠির নিরিখে দারিদ্ররেখার নীচে বাস করতেন। এই হিসাবকে যদি একেবারে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে না দিই, তা হলে প্রশ্ন উঠবে— কোন জাদুবলে মাত্র এক বছরের মধ্যে দারিদ্রের অনুপাত এতখানি কমে গেল?

রহস্যটা সম্ভবত এনএসএসও-র নতুন সমীক্ষা-প্রণালীর মধ্যে লুকিয়ে আছে। নমুনা সংগ্রহের আগে পরিবারগুলোকে তাদের আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী কয়েকটা স্তরে ভাগ করে নেওয়াটা জরুরি। পরের কাজ প্রত্যেকটি স্তর থেকে পৃথক ভাবে নমুনা সংগ্রহ করা, যাতে কোনও স্তরের পরিবারই নমুনা থেকে বাদ না পড়ে। এই প্রক্রিয়ার নাম স্ট্র্যাটিফায়েড স্যাম্পলিং বা স্তরবিন্যস্ত নমুনা সংগ্রহ। স্তর বিভাজনের কাজটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর উপরে নির্ভর করছে সমাজের প্রত্যেকটি স্তরের পরিবার নমুনায় জায়গা পাওয়া না-পাওয়া। ২০১১-১২’র সমীক্ষায় যে ভাবে স্তরবিন্যাস করা হয়েছিল, ২০২২-২৩’এর সমীক্ষায় সে ভাবে হয়নি। আমাদের অনুমান, স্তরবিন্যাসে পরিবর্তন আনার ফলে দারিদ্রের হার এতটা কম দেখাচ্ছে।

প্রথমে শহুরে পরিবারগুলির কথা। ২০১১-১২’র সমীক্ষায় শহরের পরিবারগুলিকে তাদের আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী উপরের ১০%, মাঝের ৬০% এবং নীচের ৩০%— এই তিন ভাগে ভাগ করে মাঝের স্তর থেকে অর্ধেক এবং বাকি দু’টি স্তর থেকে সিকি ভাগ করে নমুনা নেওয়া হয়েছিল। এর ফলে ধনী-দরিদ্র সকলেই তাদের গুরুত্ব অনুযায়ী নমুনায় স্থান পেয়েছিল। ২০২২-২৩’এর সমীক্ষা শহরের পরিবারগুলিকে ভেঙেছে তিন ভাগে— যাদের দশ লাখ টাকা বা তার বেশি দামের চার চাকার গাড়ি আছে; যাদের দশ লাখ টাকার চেয়ে কম দামের চার চাকার গাড়ি আছে; এবং যাদের চার চাকার গাড়ি নেই। আমাদের দেশে যে-হেতু বেশির ভাগ পরিবারেরই চার চাকার গাড়ি নেই, তাই নমুনার বেশিটাই এসেছে তৃতীয় ভাগটি থেকে। এই তৃতীয় ভাগটিতে কিন্তু গরিব ছাড়াও, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্য-মধ্যবিত্ত ইত্যাদি নানা ধরনের পরিবার আছে। এমনকি কিছু উচ্চ-মধ্যবিত্ত থাকাটাও আশ্চর্য নয়, যারা নানা কারণে গাড়ি কেনেনি। এই সব পরিবারে মাথাপিছু মাসিক ব্যয় গরিবদের চেয়ে অনেকটাই বেশি। এত বিস্তৃত, এত ভিন্নধর্মী পরিবার নিয়ে যে স্তর, তার থেকে নমুনা সংগ্রহ করলে নমুনায় গরিবদের অনুপাত কম হওয়ারই সম্ভাবনা। এবং সেটাই হয়েছে।

২০১১-১২’র সমীক্ষায় গ্রামের পরিবারগুলির থেকে প্রথমেই অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্নদের আলাদা করে একটা ভাগে রাখা হয়েছিল। বাকিদের মধ্যে দুটো ভাগ— এক, যে পরিবারগুলির মূল আয় কৃষির বাইরে থেকে আসে; এবং দুই, যাদের আয় কৃষি থেকে আসে। যে পরিবারগুলির আয় কৃষির বাইরে থেকে আসে, তারা মূলত অসংগঠিত শিল্প ও বাণিজ্যনির্ভর। এই পরিবারগুলিই বিমুদ্রাকরণ, জিএসটি এবং লকডাউনের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই ক্ষতির চিহ্ন কিন্তু ২০২২-২৩’এর সমীক্ষায় উঠে এল না, কারণ নতুন সমীক্ষায় গ্রামের পরিবারগুলিকে তাদের জমির মালিকানা অনুযায়ী উপরের ৫%, মাঝের ৫% থেকে ২০% এবং নীচের ৮০% এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। কৃষির বাইরে উপার্জন করা অসংগঠিত শিল্প ও বাণিজ্যনির্ভর পরিবারগুলিকে আলাদা করে চিহ্নিত করা হয়নি। এই পরিবারগুলি নীচের ৮০% পরিবারের মধ্যে মিশে আছে। কিন্তু এই স্তরে অনেক কৃষি-নির্ভর পরিবারও আছে, যাদের বিমুদ্রাকরণ, জিএসটি বা লকডাউন তুলনামূলক ভাবে অনেক কম আঘাত করেছে। নতুন সমীক্ষার নমুনায় এরা উঠে এসে অকৃষি-নির্ভর ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে আংশিক ভাবে আড়াল করে দিয়েছে। ফলে সার্বিক ভাবে দারিদ্রের অনুপাত বাস্তবের তুলনায় কম দেখাচ্ছে।

পরিশেষে একটা প্রশ্ন। এমন কৃত্রিম ভাবে দারিদ্রকে কম দেখিয়ে কি কোনও রাজনৈতিক লাভ হয়? ভোটাররা তো দেখতেই পাচ্ছেন তাঁদের চার দিকে দারিদ্র কমেছে কি না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement