আজকাল ফুটবলের বড়ই বাড়বাড়ন্ত। ফাইল চিত্র।
খেলা শব্দের নিকটতর অনুষঙ্গ কোনটি? রণ না রমণ? জয়দেবের গীতগোবিন্দ পড়লে মনে হয় দ্বিতীয়টি। আর মহাভারত-এর সভাপর্বের দৌলতে আবার প্রথমটিই প্রথমে মনে আসে। কোথায় খেলার সঙ্গে আনন্দের যোগ? হয়তো ছন্দে, নৃত্যপরতায়। বিজ্ঞানও সায় দেবে এ কথার। নাড়ির গতি, শ্বাসের ওঠাপড়া, নিদ্রা, ঋতুস্রাব, এমনকি সূক্ষ্মতর স্তরে দেহকোষের শক্তিচক্র, সর্বত্রই এই ছন্দের খেলা। অন্তর্নিহিত এই ছন্দকে যখন কোনও ক্রিয়ার মাধ্যমে অন্যের দৃষ্টিগোচর করে তোলে, তখন তাকে আমরা শিল্প বলি। লিয়োনেল মেসি যখন বলকে পায়ের চেটোয় ঠুকে পর্যায়ক্রমে বাঁ দিক ও ডান দিক করে বিপক্ষের রক্ষণকে বিভ্রান্ত করতে থাকেন, তখন আমরা বুঝি ওই তুঙ্গমুহূর্তে যা ক্রিয়াশীল, তা আসলে এক জাদুশক্তি যার উৎস দেহের স্বতঃস্ফূর্ত নৃত্যপরতায়। তার সঙ্গে যোগ করতে হবে খেলাকে ঘিরে মানুষের মহামিলনের উপরি পাওনা। ফুটবলের দৌলতেই না ফ্রান্সের দলটাকে মনে হয় বিশ্বমানবের মেল্টিং পট।
মুশকিল হল, আজকাল ফুটবলের বড়ই বাড়বাড়ন্ত। চতুর্বার্ষিক বিশ্বকাপ ছেড়েই দিলাম, টিভি খুললেই ফুটবলের অবিরাম উৎসব। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত ভুলতে এ এমন এক বিনোদন, যা আবার ঘাত-প্রতিঘাতে ভরপুর। রাগবিকে বাদ দিলে, ফুটবল একমাত্র খেলা যেখানে সমর্থকদের মধ্যে সংঘাত এত বেশি। ১৯৮৫-তে ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালে ব্রাসেলসের ভয়ঙ্কর দাঙ্গার পর ফ্রি-কিকের জাদুকর মিশেল প্লাতিনি বলেছিলেন, “এই ফুটবল জীবনের মতোই কুৎসিত, নির্মম।”
এত মানুষ মেতে থাকেন খেলাধুলাকে ঘিরে, অথচ কিমাশ্চর্যম্, ফুটবল নিয়ে কোনও সমালোচনা হয় না, বুদ্ধিচর্চার জগতে সবচেয়ে উপেক্ষিত বিষয় এটি। তার একটা কারণ অবশ্যই ভাবুক বুদ্ধিজীবীদের খেলাধুলা সম্বন্ধে তাচ্ছিল্য ও অনাগ্রহ। দ্বিতীয় কারণ হয়তো পেশাদারি ক্রীড়াজগৎ অনেকটা স্বৈরতন্ত্রের মতো, তাকে নিয়ে গভীর কোনও প্রশ্ন বা পর্যালোচনাকে মনে করা হয় অপরাধ। ক্বচিৎ কদাচিৎ কোনও বুদ্ধিজীবী যখন বিষয়টি নিয়ে কলম ধরেন তখন নিজের বুদ্ধিবৃত্তির নিরোধ হয়ে ওঠে প্রায় আবশ্যিক। আলবের কাম্যুর মতো বিশ্ব-বন্দিত ভাবুক পেশাদারি ফুটবলের মধ্যে সারল্য ও মানবিক কর্তব্যকে আবিষ্কার করে ফেলেন।
প্রশ্নাতীত পেশাদারি ক্রীড়াজগতে কেবল একটি প্রশ্নের অবাধ অনুমতি এবং সর্বাত্মক উপস্থিতি— জিতবে কে? খেলা নয়, খেলার ফলটাই আসল। ক’টা গোল, কত রান, কত পয়েন্ট— এই নিয়েই যাবতীয় জল্পনা, আদান-প্রদান। আমাদের দৈনন্দিন সামাজিকতাও এই সংখ্যাতত্ত্বের একনায়কত্বের উপর নির্ভরশীল। এ দিকে, সাদা চোখে দু’টি দলের মধ্যে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ধরা পড়ে তার নীচ দিয়ে সহস্র ধারায় বয়ে চলে ব্যক্তিগত রেষারেষির চোরাটান। কে বেশি টানতে পারে ক্যামেরার আলো, মিডিয়ার প্রসাদ? এ সব বুঝতে পারেন শুধু প্রশিক্ষকেরা। সুতরাং, ফুটবল সে অর্থে মোটেই সমষ্টিগত কোনও খেলা নয়, বরং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এমনকি স্বার্থপরতা এর চালিকাশক্তি। ব্যক্তিগত প্রতিযোগিতা, যোগ্যতমের উদ্বর্তন, তঞ্চকতার বৈধতা ইত্যাদি মিলিয়ে পেশাদারি খেলার নৈতিক কাঠামোটা অবাধ পুঁজিবাদী মূল্যবোধের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।
এ বারের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা বনাম নেদারল্যান্ডসের কোয়ার্টার ফাইনালের খেলার পর একটি ছবি ভাইরাল হয়েছিল। টাইব্রেকারে ৩-৪ হারের পর পরাভূত ভগ্নজানু ওলন্দাজ খেলোয়াড়দের ঘিরে আর্জেন্টিনীয়দের লাগামহীন ধর্ষকামী উল্লাস। ফাঁদে পড়া অসহায় শিকারকে ঘিরে শিকারিদের মনে যেমন আসে হিংস্র বিদ্রুপ। এই ফুটবলকেই নিশ্চয়ই প্লাতিনি জীবন বলেছিলেন।
মাথায় রাখা ভাল, যে ক্রীড়াবিশ্বের কথা আমরা বলছি তা কিন্তু তার ভাষা, বার্তা সমস্ত বিষয়বস্তু সমেত একান্তই প্রতীচ্যের ক্রীড়াবিশ্ব। আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হলেও এ বারের বিশ্বকাপের প্রকৃত বিজয়ী বিশ্বায়ন। ইরান, সৌদি আরব, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, বিশেষত মরক্কোর মতো প্রাচ্যবিশ্বের অভাবনীয় ক্রীড়াকুশলতা ও সাফল্য তার প্রমাণ ।
যুদ্ধের পাশাপাশি ধর্মের সঙ্গেও পেশাদারি খেলার যোগ। প্রথমেই বলতে হয় ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার কথা। ক্রীড়াঙ্গনে যুযুধান দুই দলের সমর্থক যেন বিবাদী দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মতো সমর্থকদের মধ্যে খণ্ডযুদ্ধের খবর সংবাদশীর্ষে উঠে আসে। কোনও দলের সমর্থক বিরোধী দলের প্রশস্তি ও নিজ দলের নিন্দা বরদাস্ত করে না। দলাদলি কী ভাবে যুক্তিবৃত্তির বিপর্যয় ঘটায়, সমাজমাধ্যমের পাতা তার প্রাত্যহিক সাক্ষী।
দ্বিতীয়ত, খেলার আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যেও ধর্মীয় ক্রিয়াকর্মের বেশ কিছু মিল। এমন মিল যে, পেশাদারি ক্রীড়ানুষ্ঠানকে মনে হতে পারে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের প্যারডি। যেমন মাঠে নামার আগে মাটি ছুঁয়ে মাথায় বা বুকে হাত ছোঁয়ানো, গোল করার পর হাঁটু মুড়ে বসে দু’হাত আকাশে তুলে ঈশ্বরের আশীর্বাদ ভিক্ষা, আরতির ঢঙে বিজেতার কাপ ঊর্ধ্বে তুলে ধরা, শান্তিস্বস্ত্যয়নের ঢঙে শ্যাম্পেন ছেটানো।
আসলে আমরা সবাই দৃশ্যের গোলাম। পল ভালেরি বলেছিলেন, “আধুনিক জীবনে কল্পনার স্থান নিয়েছে দৃশ্য।” সে ছিল বিগত শতকের প্রথম ভাগের এক কবিমনের আশঙ্কার কথা। আজ এটা প্রমাণিত সত্য। ফুটবল তার দৃশ্যাবলি দিয়ে স্বপনে, জাগরণে, হৃদয়ে, মগজে আমাদের ভুবন ভরিয়ে দিয়েছে। আধুনিক জীবনের কেন্দ্রে সে পাকা করে ফেলেছে নিজস্ব কর্তৃত্বের বনিয়াদ।