Ramayan

এক অন্য রামকথা

কাব্যটি মহারাষ্ট্র প্রাকৃতে, ১১৮টি সর্গে ও ছ’টি ভাগে লেখা। জৈন শ্বেতাম্বর সম্প্রদায়ের রামকথার মূল স্রোতটি এই কাব্যকে কেন্দ্র করেই রয়েছে।

Advertisement

অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০২৩ ০৪:২৭
Share:

রামায়ণ বা তদুপরি রামকথা কোনও নির্দিষ্ট একটি ধর্মের ‘নিজস্ব’ সম্পদ নয়। প্রতীকী ছবি।

ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপর একদা বলেছিলেন, “রামায়ণ ইতিহাসের কোনও একটি মুহূর্তের অন্তর্গত নয়। কারণ, বিভিন্ন সময় ও জায়গার বুনটে এটির বিভিন্ন সংস্করণ তৈরি হয়েছে।” (এগজ়াইল অ্যান্ড দ্য কিংডম: সাম থটস অন দ্য রামায়ণ) রামায়ণ বা তদুপরি রামকথা কোনও নির্দিষ্ট একটি ধর্মের ‘নিজস্ব’ সম্পদ নয়। বরং এটি ভারতভূমির নিজস্ব সম্পদ, তা সবারই।

Advertisement

কেন এমন বলা, তা এই বেতাল-বেসুরো যুগে জৈন রামকথার প্রাচীনতম কবি বিমলসূরি এবং তাঁর কাব্য পউমচরিঅ-র নিরিখে দেখা যেতে পারে— কবি ও কাব্যের পরিচয়, কাব্যের রচনাকাল, বাল্মীকি বা প্রচলিত রামায়ণের থেকে কোথায়ই বা এটি আলাদা, কেনই বা এটি লিখতে হল বিমলসূরিকে।

কাব্যটি মহারাষ্ট্র প্রাকৃতে, ১১৮টি সর্গে ও ছ’টি ভাগে লেখা। জৈন শ্বেতাম্বর সম্প্রদায়ের রামকথার মূল স্রোতটি এই কাব্যকে কেন্দ্র করেই রয়েছে। এখানে পউম বা পদ্ম হলেন রাম। রামের মুখমণ্ডল সদ্য-ফোটা পদ্মের মতো, চোখ পদ্মের পাপড়ির ন্যায়। ঘটনা হল, জৈন ঐতিহ্যে ৬৩ জন মহামানব রয়েছেন। রাম হলেন অষ্টম বলদেব, লক্ষ্মণ অষ্টম বাসুদেব ও রাবণ অষ্টম প্রতিবাসুদেব। কাব্যটি শ্রেণিক বিম্বিসারের প্রশ্নের উত্তরে স্বয়ং মহাবীরের প্রধান শিষ্য গোয়ম বা ইন্দ্রভূতি গৌতমের বিবৃতি।

Advertisement

এই বিবৃতির সময় নিয়ে মতভেদ আছে। খোদ বিমলসূরি জানাচ্ছেন, এর সময়কাল স্বয়ং মহাবীরের নির্বাণের ৫৩০ বছর পরে। সুতরাং এটি খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের আশপাশের রচনা। তবে এ বিষয়ে দু’জনের মতান্তর লক্ষণীয়। পউমচরিঅ সম্পাদনা করেন এইচ জ্যাকবি। তাঁর মতে, এই কাব্য খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতক বা তার পরের রচনা। মরিস ভিনটারনিৎস-এর দাবি, এর সময়কাল ৬৪ খ্রিস্টাব্দ। সময়কালের মতো বিমলসূরির পরিচয়ও নিশ্চিত করে বলা যায় না। কাব্যে মথুরার নিবিড় বর্ণনা থাকায় মনে করা যেতে পারে, তিনি ওই সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। পাশাপাশি, এ কাব্য শ্বেতাম্বর সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হলেও, এতে এমন কিছু উপাদান আছে যা দিগম্বর সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত (‌যেমন, নরক, কুলকারদের বর্ণনা ইত্যাদি)।

বিমলসূরির কবিপ্রতিভা নিশ্চিত ভাবেই মুগ্ধ করে। কবিত্বের চরম নিদর্শন নদী, শহর, ঋতু, জলকেলি, প্রেমদৃশ্য ইত্যাদির বর্ণনায়। কাব্যের প্রয়োজনে প্রাকৃতের সঙ্গে অপভ্রংশ প্রবাদেরও সার্থক ব্যবহার এতে। পুরো কাব্যটি মুখ্যত আর্যা ছন্দে লেখা। তবে রুচিরা, গাথা, মালিনী, ইন্দ্রবজ্র প্রভৃতি ছন্দেরও সার্থক ব্যবহার রয়েছে। কিন্তু এর পরেও কবি নয়, বরং এক ভিন্ন রামকথার প্রচারক— এটিই বিমলসূরির মুখ্য পরিচয়।

ভিন্ন শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ। প্রচলিত বাল্মীকি-রামায়ণের অনুসরণ দেখা গেলেও, আখ্যানের ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অমিল আছে। বিমলসূরি ও জৈন ঐতিহ্য মতে, বানরেরা এবং রাক্ষসেরা ‘বিদ্যাধর’ নামে একটি বংশের দু’টি ভিন্ন ধারা। কামরূপত্ব, আকাশ-গমন প্রভৃতি অলৌকিক বিদ্যার অধিকারী বলে বিদ্যাধর নাম। এদের একটি শাখার নিবাস লঙ্কায়। রাক্ষস নামে সে শাখার প্রতাপশালী ব্যক্তিত্বের নামানুসারে শাখাটি রাক্ষস নামে পরিচিত হয়। আর কিষ্কিন্ধ্যাপুরের বিদ্যাধরেরা বানর নামে পরিচিত। এই গোষ্ঠীর লোকজন তাঁদের পতাকা ও মুকুটে বানরের ছবি ব্যবহার করতেন।

পাশাপাশি, পউমচরিঅ-তে বলা হচ্ছে, রাবণের একটি মাথা। ইন্দ্র, যম, বরুণেরা মানুষ। দশরথের চার রানি। শত্রুঘ্ন চতুর্থ রানি সুপ্রভার ছেলে। রাম ও লক্ষ্মণের বেশ কয়েকটি বিয়ে, রাবণের বোন চন্দ্রণখার মেয়ে অনঙ্গকুসুমার সঙ্গে হনুমানের বিয়ের ছবি এঁকেছেন বিমলসূরি। এখানে সীতার জন্মও স্বাভাবিক ভাবে। তিনি জনক ও বিদেহা (কোনও মহিলার নাম, না কি প্রাচীন একটি জনগোষ্ঠীর কোনও মহিলা বোঝানো হয়েছে, তা বলা সম্ভব নয়) যমজ সন্তানের এক জন। সীতার ভাই ভামণ্ডল। লক্ষ্মণ রাবণকে বধ করেন। এখানে রাম, লক্ষ্মণ, রাবণ, সীতা, বালী, সবাই জৈন ধর্ম গ্রহণ করেন।

তা হলে কি শুধু ধর্মের কারণেই এই রামকথা? কাব্য রচনার কয়েকটি কারণ অনুমান করা যায়— প্রথমত, জৈন ধর্মের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে রামকথার মতো প্রাচীন ও অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি আখ্যানকে খাপ খাওয়ানোটা জরুরি হয়ে পড়ে। কারণ, জৈন ধর্মাবলম্বী মানুষের জীবনে ‘ব্রাহ্মণ্য’ বা বাল্মীকির রামকথা প্রভাব ফেলতে পারত। তাই জৈনদের সামনে, সে ধর্মের আচার-আচরণের সঙ্গে খাপ খায়, এমন একটি রামকথা দাঁড় করানোর দরকার পড়ে। সে জন্যই কি জৈন ধর্মের বিভিন্ন খুঁটিনাটি দিক বর্ণনার পাশাপাশি গোদান, স্ত্রীদান, ভূমিদান এবং সুবর্ণদানের নিন্দা করা হচ্ছে! দ্বিতীয়ত, পউমচরিঅ-তে বর্ণিত রামকথা হয়তো সে সময় প্রচলিত মৌখিক ঐতিহ্যকে অনুসরণ করেছে। সেটিকে সংরক্ষণ করা জরুরি হয়ে পড়ে। তৃতীয়ত, কবি নিজেই জানাচ্ছেন, প্রচলিত রামকথার ‘অলৌকিকত্ব’-এর বদলে জোর দিতে চান বাস্তবতায়। এই সূত্রে প্রচলিত রামকথায় ‘কুসত্য’ রয়েছে বলে বিমলসূরির দাবি।

কোনটা কুসত্য, কোনটা বিশ্বাস ও সময়ের সারাংশ, সেটাই হয়তো রামকথার মূল কথা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement