অর্থনৈতিক বৃদ্ধি চলবেই, ধরে নেওয়া চলে না
Economy

সরকারি খরচের দিশা

সম্প্রতি আমি দক্ষিণ কোরিয়া গিয়েছিলাম। সে দেশে সকলে অত্যন্ত দুশ্চিন্তায় রয়েছেন, কারণ তাঁদের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার (যা সাধারণত জিডিপি দিয়ে মাপা হয়) কমছে।

Advertisement

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০২৪ ০৭:৫৮
Share:

—প্রতীকী ছবি।

রবার্ট সোলো চলে গেলেন ২১ ডিসেম্বর, নিরানব্বই বছর বয়সে। তিনি এমআইটি-তে আমার সহকর্মী ছিলেন। সোলো এবং পল স্যামুয়েলসন পঞ্চাশের দশকে এমআইটি-তে অর্থনীতি বিভাগের সূচনা করেন, যা অর্থনীতির চর্চায় একটি বিশিষ্ট ধারা নির্মাণ করার জন্য গোটা বিশ্বে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। পরবর্তী সাত দশকে সারা বিশ্বে অর্থনীতির চিন্তা ও কাজের গঠনে সোলোর প্রভাব সুস্পষ্ট। সেই সঙ্গে, তাঁর একটি মৌলিক তত্ত্ব কতখানি যথার্থ, তা-ও ফের স্পষ্ট হচ্ছে।

Advertisement

সম্প্রতি আমি দক্ষিণ কোরিয়া গিয়েছিলাম। সে দেশে সকলে অত্যন্ত দুশ্চিন্তায় রয়েছেন, কারণ তাঁদের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার (যা সাধারণত জিডিপি দিয়ে মাপা হয়) কমছে। একই উদ্বেগ গ্রাস করছে চিনকেও, যদিও চিনে বৃদ্ধির হার এখনও অতটা কমেনি। বৃদ্ধির হার উঁচু রাখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চিন-সহ নানা দেশ। সোলো কিন্তু বলবেন, এ চেষ্টা বৃথা। ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে (আ কনট্রিবিউশন টু দ্য থিয়োরি অব ইকনমিক গ্রোথ) সোলো লিখেছিলেন, যে দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার বেশি, একটা সময়ের পরে সেখানে সেই হার কমতে বাধ্য। কারণ, সেখানে পুঁজি-সম্পদের পরিমাণ বাড়তে বাড়তে ছাড়িয়ে যাবে শ্রম-সম্পদকে। পুঁজির উৎপাদনশীলতা কমবে। অন্য দিকে, তরুণ কর্মীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় উন্নয়নশীল দেশগুলির বৃদ্ধির হার অপ্রতিহত থাকবে। তাই ধনী দেশ ও উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে দূরত্ব ক্রমে কমে আসবে।

সোলো আরও একটি দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তা হল, পুঁজি এবং শ্রম ছাড়াও অর্থনৈতিক বৃদ্ধি যা নির্ণয় করে, তা হল প্রযুক্তি। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যত উদ্ভাবন আসবে, অর্থনৈতিক বৃদ্ধি তত দ্রুত হবে। তবে এক দেশে তৈরি প্রযুক্তি যে-হেতু অন্য দেশগুলিও ব্যবহার করতে পারে, তাই তা দিয়ে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হেরফের নির্ধারিত হবে, এমন নয়। চিনের দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়। চিন দীর্ঘ দিন পশ্চিমি প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে উৎপাদন বাড়িয়েছে, বৃদ্ধিও হয়েছে দ্রুত। মনে রাখতে হবে, ধনী দেশগুলির বৃদ্ধির হার থিতিয়ে আসার পূর্বাভাস যখন সোলো দেন, সে সময়ে সেগুলির বৃদ্ধি হচ্ছে বিপুল হারে। তারা ক্রমশ শক্তিশালী, সম্পদশালী হচ্ছে। বৃদ্ধির হার কমতে পারে, তেমন সম্ভাবনা কারও চিন্তায় আসেনি। সত্তরের দশক থেকে ধনী দেশগুলোতে বৃদ্ধির হার কমতে শুরু করল। সোলো নোবেল পুরস্কার পান ১৯৮৭ সালে।

Advertisement

সেই কারণেই হয়তো সোলোর তত্ত্ব নিয়ে বেশ কিছু পরিসংখ্যান-নির্ভর চর্চা শুরু হয়ে যায় এই সময়ে। কিন্তু গবেষকরা দেখলেন, ধনী দেশে বৃদ্ধির হার কমেছে ঠিকই, কিন্তু গরিব দেশে সেই হার আরও বেশি কমেছে। তাই তাদের মধ্যে দূরত্ব কমেনি বরং বেড়েছে। সোলোর তত্ত্ব ভুল বলে অনেকেই মনে করলেন। কেউ কেউ মনে করলেন, একটা নতুন ব্যাখ্যার দরকার। অর্থনীতিবিদ পল রোমার এই সময়ে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির এক নতুন তত্ত্ব (এন্ডোজেনাস গ্রোথ থিয়োরি) আনলেন। বললেন, পুঁজির বৃদ্ধির সঙ্গে শ্রমের উৎপাদনশীলতা কমার কথা ঠিকই, কিন্তু কর্মীদের আরও ভাল শিক্ষা, প্রশিক্ষণ মিলছে, আরও উন্নত প্রযুক্তির উদ্ভাবন হচ্ছে। এ সবের প্রভাবে উৎপাদনশীলতা ধাক্কা খাচ্ছে না, অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হারও তেমন মন্থর হচ্ছে না।

কিন্তু পরবর্তী ত্রিশ বছর দেখাল, সোলো ছিলেন অভ্রান্ত। আশির দশক পর্যন্ত জাপানের অর্থনীতি তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছিল। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক এজ়রা ভোগেল একটি বই লেখেন, জাপান অ্যাজ় নাম্বার ওয়ান: লেসনস ফর আমেরিকা। ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত বইটি বিপুল শোরগোল ফেলে। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত এই মত বেশ খানিকটা প্রাধান্য পায় যে, জাপান দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলির অর্থনৈতিক বৃদ্ধি অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু ১৯৯০ সালেই জাপানের অর্থনীতি মস্ত হোঁচট খেল, এবং তার পর আর কখনও সে দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার এক-দেড় শতাংশের বেশি উঠল না। বৃদ্ধির উঁচু হারে ফিরতে জাপানের সরকার মরিয়া হয়ে অনেক নির্মাণ প্রকল্পে বিপুল বরাদ্দ করেছে। যেমন, বেশ কয়েকটি অপ্রয়োজনীয় সেতু তৈরি করেছে। সেগুলি থেকে টোল আদায় হয়েছে এত সামান্য যে, নির্মাণের জন্য সরকারি ঋণের সুদও ওঠেনি তা থেকে। এই সব ‘গন্তব্যহীন সেতু’-র মতো অকারণ নির্মাণে টাকা ঢালতে গিয়ে জাপান সরকারের ঋণ কয়েকশো গুণ বেড়েছে, কিন্তু অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতে গতি আসেনি। এখন দক্ষিণ কোরিয়া, চিনও যে ভাবেই হোক বৃদ্ধির উঁচু হার ধরে রাখতে চাইছে। সোলোর তত্ত্বের সপক্ষে গত তিন দশকে যত তথ্য মিলেছে, তাতে আন্দাজ হয় যে, দক্ষিণ কোরিয়া বা চিনের সরকার যা চাইছে, তা হবে না— সরকারি খরচ বাড়িয়ে অর্থনীতিতে গতি আসবে না।

রবার্ট সোলো। —ফাইল চিত্র।

এ থেকে কয়েকটি জরুরি কথা বেরিয়ে আসে। যেমন, অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার উঁচু রাখাটাই মস্ত সাফল্য বলে দাবি করা চলে না। বৃদ্ধির হার একটি সূচক, যা থেকে বোঝা যায় যে, একটি দেশের অর্থনীতি এখনও যথেষ্ট বড় হয়নি। ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার এখন ছয়-সাত শতাংশ। এই হার ক্রমাগত বেড়েই চলবে, বা এমনই থাকবে, সে আশা করা চলে না। কয়েক বছর পরে তা কমে আসবে, তা অবধারিত। বরং মনে রাখা দরকার, চিনের মাথাপিছু রোজগার যখন ভারতের সমান ছিল, তখন চিনের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ছিল ভারতের চেয়ে অনেক বেশি— দশ শতাংশের আশেপাশে। সেই দৃষ্টিতে, চিনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাইলে ভারতকে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার বাড়াতে আরও অনেক তৎপর হতে হবে। বর্তমানে ভারত তার সম্ভাবনার অতি সামান্যই বাস্তবে পরিণত করতে পেরেছে।
দ্বিতীয়ত, ধনী দেশগুলির বৃদ্ধির হার কমা মানে, তাদের ভোগ (কনজ়াম্পশন) কমছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নিরিখে সেটা ভাল খবর, কারণ বেশি ভোগ মানে বেশি কার্বন উৎপাদন। দারিদ্র নিরসনের জন্য উন্নয়নশীল দেশে তা অনিবার্য হতে পারে, ধনী দেশের জন্য নয়। যে সব ধনী দেশে বৃদ্ধির হার দু’শতাংশের আশেপাশে, সেখানে বৃদ্ধির হার বাড়ানোর জন্য টাকা খরচ না করে, বরং দেশের অবহেলিতদের জীবনের মান আরও উন্নত করার জন্য টাকা খরচ করা দরকার। যেমন, দক্ষিণ কোরিয়া উন্নত দেশ হলেও, সেখানে বৃদ্ধদের অবস্থা করুণ। তাঁদের আরও ভাল জীবন দেওয়া দরকার।

রবার্ট সোলো নিজে জীবনের মান সম্পর্কে সচেতন ছিলেন পুরো মাত্রায়। সব সময় কাজ আর জীবনের সামঞ্জস্য রেখে চলতেন। একেবারেই গম্ভীর, ভারিক্কি ছিলেন না, মজা করে কথা বলতেন। সতীর্থদের কাজের সমালোচনা করার সময়েও ঝলসে উঠত তাঁর রসবোধ। এক বার বলেছিলেন, আধুনিক অর্থনীতিবিদকে তাঁর ল্যাপটপ-সুদ্ধ টাইম মেশিন থেকে যে কোনও সময়ে, যে কোনও দেশে ফেলে দিলে তাঁরা নেমেই চটপট কাজ শুরু করে দেবেন— কোন দেশ, কোন সময়ে এসে পড়েছেন, তা জানার চেষ্টা না করেই! অর্থনীতি যে আসলে পদার্থবিজ্ঞান নয়, তাকে দেশ-কালের নিয়মবিধির গণ্ডি মেনেই কাজ করতে হয়, এ ভাবেই তা মনে করিয়েছিলেন সোলো।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement