এমানুয়েল মাকরঁ-ই (ছবি) আরও এক বার সমূহ পতন থেকে রক্ষা করলেন ফ্রান্সের প্রজাতান্ত্রিক আদর্শকে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৫৮.৫৫% ভোট পেয়ে পরাজিত করলেন অতি-দক্ষিণপন্থী মারিন ল্য পেনকে। উল্টো ফল হলে ঘটে যেত প্রতি-বিপ্লব। ফরাসি রাষ্ট্র ও সংবিধানের দখল নিত ফ্যাসিস্ট শক্তি। সুখের কথা, আপাতত তা হওয়ার নয়।
ফ্রান্সের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে, দলমত নির্বিশেষে, বিগত কয়েক দশক যাবৎ নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নিয়েছে ইউরোপীয় কার্যক্রম। এই নিয়মের ব্যতিক্রম হল না এ বারও। ২০২২-এ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল বাম ও দক্ষিণ সনাতন দলগুলির অপ্রাসঙ্গিকতা। ২০১৭-র নির্বাচনেই তার পটভূমি প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। এ বার দেখা গেল রাজনীতিকে, প্রথাগত দলের বদলে, প্রথা বিরোধী রাজনৈতিক উদ্যোগ বা ব্লকের আলম্ব-নির্ভর হয়ে পড়তে। প্রথম রাউন্ডেই এই তিনটি ব্লক সামনের সারিতে উঠে এসেছিল, প্রথম ধারাটি অতি-বাম ও পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনপন্থী, যার মুখ জঁ লুক মেলঁশোঁ, দ্বিতীয়টি মধ্যপন্থী ও ইউরোপ-পন্থী, যার মুখ মাকরঁ। তৃতীয়টি উগ্র-জাতীয়তাবাদী ইউরোপ-বিরোধী, মুখ মারিন ল্য পেন।
অন্তিম রাউন্ডে এমানুয়েল মাকরঁ বনাম মারিন ল্য পেন, এটুকুই শুধু মিল ২০১৭-র নির্বাচনের সঙ্গে। আর বাকি সব কিছুই বেমিল। গত বার মাকরঁ ছিলেন নতুন মুখ, এ বার তিনি বিদায়ী প্রেসিডেন্ট এবং সেই ভূমিকায় অর্জিত কর্মফল দাগ ফেলেছে তাঁর রাজনৈতিক সত্তায়। রাষ্ট্রনেতার ব্যর্থতা জনিত সাধারণ মানুষের সহজাত ঘৃণা ও রোষের সহজ লক্ষ্যস্থল হয়ে উঠেছেন তিনি। এ বার ল্য পেন ছাড়াও অতি-ডানদের আরও দু’টি প্রশাখা প্রথম রাউন্ডে প্রার্থী দিয়েছিল, তাদের প্রাপ্ত ভোটের (প্রায় ১০%) সিংহভাগ এসে জমা হয়েছে দ্বিতীয় রাউন্ডে ল্য পেনের ঝুলিতে। সুতরাং ২০১৭-র ফলের তুলনায় এই ফলকে বিচার করলে বরং গভীর উদ্বেগের কারণ থেকে যাচ্ছে। কারণ ২০১৭-র তুলনায় অতি-দক্ষিণপন্থীদের ভোট বেড়েছে প্রায় ৮%। ভোটদানে বিমুখ মানুষের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৩%।
অর্থাৎ অবশ্যই রাষ্ট্র-পরিচালনায় রাষ্ট্রনায়কের কিছু খামতি ছিল, যার ফয়দা তুলেছে ল্য পেন-সম্প্রদায়। বস্তুত তাঁর রাষ্ট্রনেতৃত্বের পঞ্চবার্ষিকী বার বার ঝড়-ঝঞ্ঝায় বিপর্যস্ত হয়েছে। প্রেসিডেন্টের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে অপব্যবহারের অভিযোগ উঠল বেনাল্লা-কেলেঙ্কারিতে। নিন্দুকেরা মাকরঁ-রাজকে এক নয়া-উদ্ভাবিত শিরোপায় ভূষিত করলেন, গণ-একনায়কতন্ত্র বা আধা-একনায়কতন্ত্র। দেশের সামাজিক ক্ষেত্র উত্তাল হয়ে উঠল হলুদ-জ্যাকেট আন্দোলনে। ২০১৭-য় মাকরঁ-র আবির্ভাব এমন এক আকাশছোঁয়া প্রত্যাশা জাগিয়ে তুলেছিল যার প্রতিক্রিয়ায় তৈরি হল এই রাজনৈতিক সুনামি। তার পর এল শরণার্থীর ঢেউ। অতি-দক্ষিণবাদীরা হাতে ধর্ম ও বর্ণ-ভিত্তিক রাজনীতির নতুন ইন্ধন পেলেন। অবসরের বয়সে সংস্কার আনতে গিয়েও হাত পোড়ালেন রাষ্ট্রনেতা। ইতিমধ্যে আছড়ে পড়ল অতিমারির ঢেউ। নগ্ন করে দিল স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার কঙ্কালসার চেহারা। সীমানা-ভাঙা বিশ্বায়িত মানুষ কুঁকড়ে আবার ঢুকে গেল নিজস্ব গণ্ডির মধ্যে। ‘বাঁচতে হলে নিজেকে সীমানায় বাঁধো’— মাকরঁ-বিরোধী স্লোগান যেন এই সুযোগে ন্যায্যতা পেল। সেই ঢেউ সরে যাওয়ার পর অর্থনীতি যখন আবার সীমানা অতিক্রমের চেষ্টা করছে, এসে পড়ল ইউক্রেনে রুশ-আগ্রাসন। নির্বাচনে মাকরঁ-র যদি প্রকৃত প্রতিপক্ষ কেউ থেকে থাকে, তা এই সমস্যাগুলিই।
দেরিতে হলেও, মাকরঁ নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন। জয়লাভের পর সংযত এক বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, “যাঁরা আমায় ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছেন, তাঁদের অনেকেই আমার মতাদর্শের পক্ষে নন, তাঁরা আমায় ভোট দিয়েছেন অতি-দক্ষিণপন্থার পথরোধ করতে।” তিনি জানেন তাঁর এই জয়লাভের পিছনে বহুলাংশে বামপন্থী ভোটের সক্রিয় মদত। এই দ্বিধাদ্বন্দ্বদীর্ণ ফ্রান্সে তাঁর কাজ হবে দলমতনির্বিশেষে সকলের চাহিদা ও অনুভূতিকে সমান গুরুত্ব দেওয়া। আগামী দিনে তিনি নিশ্চিত করবেন কেউ যাতে আর উপেক্ষিত বোধ না করেন। “যে নতুন যুগ শুরু হতে চলেছে তা বিগত জমানার ধারাবাহিকতা হবে না।” অর্থাৎ উল্লাসের দিন নয়, সামনে অনেক লড়াই অপেক্ষা করছে। শুধু স্বদেশে নয়, সারা বিশ্বেই এখন এমন অনেক চিতার আগুন জ্বলছে। তাই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তাঁকে শান্তি ও ঐক্যের বার্তাবাহক হয়ে উঠতে হবে।
লড়াইয়ের প্রথম পর্ব আসন্ন জাতীয় সভা নির্বাচন। যে নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি তো বটেই, প্রধানমন্ত্রীও নির্বাচিত হবেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের রেশ ফুরোবার আগেই জাতীয় সভার দামামা বেজে উঠল। এই ঢাকে প্রথম কাঠির বাড়ি অবশ্য পড়েছিল প্রথম রাউন্ডের ফল ঘোষণার পরক্ষণেই। তিন নম্বরে থেকে দ্বিতীয় রাউন্ডের রেস থেকে ছিটকে যাওয়া জঁ লুক মেলঁশোঁ বললেন তিনি রেসেই আছেন, মোটেই ছিটকে যাননি। ফরাসি জাতির কাছে আবেদন রাখলেন, তাঁকে দেশের প্রধানমন্ত্রী করা হোক। ডাক দিলেন রাজনৈতিক সহাবস্থানের। যেমনটা পঞ্চম প্রজাতন্ত্রের ইতিহাসে তিন বার হয়েছিল। প্রথম দু’বার প্রেসিডেন্ট ফ্রঁসোয়া মিতেরঁ-র আমলে, ১৯৮৬-৮৮; সহাবস্থান হয়েছিল দক্ষিণপন্থী জাক শিরাক-এর সরকারের সঙ্গে, দ্বিতীয় বার ১৯৯৩-৯৫, এদুয়ার বালাদুর পরিচালিত সরকারের সঙ্গে। তৃতীয় সহাবস্থানের নজির তৈরি হয় জাক শিরাকের আমলে, তাঁকে সহাবস্থান করতে হয়েছিল জোসপ্যাঁ নেতৃত্বাধীন বামপন্থী সরকারের সঙ্গে। এ বার কী হতে চলেছে? আবারও সহাবস্থান?
২০১৭-য় নির্বাচিত হয়ে জনসমক্ষে তাঁর প্রথম আবির্ভাব ঘটেছিল— একা। ২০২২-এ তিনি এলেন স্ত্রী-পুত্র পরিবৃত হয়ে। এই দৃশ্য কি নতুন কোনও অর্থ বহন করে? তিনি কি তাঁর সেই একক রাজকীয় জুপিটারের অনুষঙ্গ পরিহার করতে চাইছেন? তৈরি করতে চাইছেন মাটির কাছাকাছি, হাত ধরাধরি করে চলার এক নতুন পারিবারিক অনুষঙ্গ?
এ বার বিজয় সমাবেশ সংঘটিত হল শঁ-দ্য-মারস্-এ। এটাও কি খুব প্রতীকী নয়? পৌরাণিক চরিত্র মারস্ যুদ্ধের দেবতা। আবার শঁ-দ্য-মারস্ ফরাসিদের যৌথ কল্পনায় বাস্তিল দুর্গ-পতন পরবর্তী উৎসব-স্থল, জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। প্রজন্ম, বর্ণ, ধর্ম, শ্রেণিকে ঘিরে ফরাসি সমাজের দেহে এখন গভীর সব ফাটল-রেখা। খাদ্য, তাপবিদ্যুৎ শক্তি, জ্বালানি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য আকাশছোঁয়া, অর্থনৈতিক বৃদ্ধি তলানিতে। মাইক্রোফোনে বিজয়ী প্রেসিডেন্টের অমোঘ কণ্ঠস্বরে যেন গ্রিক ট্র্যাজেডির নায়কের সংলাপ, “রোষানলের প্রতিটি শিখাকে আমায় সম্যক ভাবে প্রশমিত করতে হবে।” প্রেসিডেন্টের কাছে ফ্রান্সের এখন একটিই দাবি— শুশ্রূষার। তার যন্ত্রণা শোনার ইচ্ছার।