বড় বিপদ, এবং বড় সুযোগ
coronavirus

শিক্ষকরা আছেন, সামাজিক আগ্রহ বাড়ছে, ঘুরে দাঁড়াতেই পারি

লজ্জায় হোক, প্রেরণায় হোক, নিজস্ব তাগিদে হোক, সহযোগের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসতে পারেন কেবল শিক্ষক নন, বৃহত্তর সমাজের বহু নাগরিকও।

Advertisement

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৫:০১
Share:

রাস্তার ধারে চায়ের দোকান চালান একলা মা। কাছেই ঝুপড়িতে থাকেন, দুই মেয়েকে নিয়ে। এক জন তৃতীয় শ্রেণি, অন্য জন পঞ্চম। এক স্কুলশিক্ষক সে-দিন চা খেতে গিয়ে দেখলেন, দুই বোনে দোকানে বসেই স্কুলের বই নিয়ে পড়াশোনা করছে। তিনি তাদের সঙ্গে দু’একটা কথা বলেন, জানতে চান পড়াশোনার খবর, মা নীরব দৃষ্টিতে নজর করেন। কিন্তু তার পরে যখন সেই শিক্ষক বলেন, “ওদের একটা ছবি তোলা যাবে?” মা সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁঝিয়ে ওঠেন। তীব্র স্বরে, কিছুটা অসংলগ্ন ভাবে, যা বলেন তিনি, তার মর্মার্থ: ‘বাচ্চারা দোকানে বসে পড়ছে, দেখে মজা হচ্ছে? কী করবে ওরা? স্কুল থেকে বই পেয়েছে, এখানে বসে পড়ছে। কে পড়াবে ওদের? কেউ সাহায্য করেছে এসে? আপনি নিজের কাজে যান। আমাদের নিজেদের লড়াইটা লড়তে দিন।’ মেয়ে দু’টির মুখ সাদা হয়ে যায়— তারাই বুঝি কোনও অন্যায় করে ফেলেছে।

Advertisement

অতিমারির সময়কার এই অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়েই শুরু হয়েছে লার্নিং টুগেদার। একটি সমীক্ষা-পুস্তিকা। রাজ্যের প্রায় দু’হাজার প্রাথমিক শিক্ষককে নিয়ে তৈরি ‘শিক্ষা আলোচনা’ গোষ্ঠীর কয়েকশো সদস্য নানা জেলায় প্রাথমিক স্তরের সাত হাজারের বেশি ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনার হাল এবং তার পাশাপাশি প্রায় সাড়ে তিনশো শিক্ষার্থীর পরিবারের আর্থিক অবস্থা নিয়ে সমীক্ষাটি করেছেন। একটা বিরাট অংশই দরিদ্র, শ্রমজীবী ঘরের ছেলেমেয়ে, সরকারি প্রাথমিক স্কুলে পড়ে তারা। সমীক্ষার ফলাফল ভয়াবহ। এক কথায় বললে, দেড় বছরে এক দিকে পরিবারের দারিদ্র আরও অনেক বেড়েছে, অন্য দিকে লেখাপড়া প্রায় সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত।

এই বিপর্যয়ের খবর আজ আর নতুন নয়। অতিমারি ও আর্থিক সঙ্কটের ফলে দুনিয়া জুড়েই শিক্ষার প্রচণ্ড ক্ষতি হয়েছে, তার নানা তথ্য ক্রমশ পাওয়া যাচ্ছে। যে দেশগুলিতে ক্ষতি সবচেয়ে বেশি, ভারত তাদের প্রথম সারিতে, জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন দখল করতে বদ্ধপরিকর। শিক্ষা-সঙ্কটে দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্থান কোথায়, এখনও নিশ্চিত করে বলার মতো তথ্য নেই, তবে ফার্স্ট-সেকেন্ড হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সোজা এবং সাফ কথা হল, এই রাজ্যের, বিশেষত গরিব ঘরের শিশুদের লেখাপড়ার বিপর্যয় ঠেকাতে আমরা ব্যর্থ। এই সমীক্ষাও সেটাই জানাচ্ছে।

Advertisement

কিন্তু এখন আমরা কী করব? ‘যা হবার তা হবে’ বলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব? সরকারি ছাড়পত্র পেলে পুজোর পরে স্কুল খুলবে, প্রাথমিক স্তরের পড়াশোনা চালু হতে হয়তো বছর ঘুরে যাবে, তার পরেও কী অবস্থায় চলবে সেই সব স্কুল, লেখাপড়া কেমন হবে, সে-সব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে যে যার চরকায় তেল দেব? বিনোদনী রাজনীতির অন্তহীন অলীক কুনাট্য রঙ্গে মেতে থাকব? না কি, ‘আর নহে, আর নয়’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়ব? ঝাঁপিয়ে পড়া মানে আবেগের উন্মাদনায় গা ভাসানো নয়, তাৎক্ষণিক শুভেচ্ছার বশে কিছু একটা করে ফেলার উচ্ছ্বাস দেখানো নয়। ঝাঁপিয়ে পড়া মানে আলস্য, ঔদাসীন্য এবং গতানুগতিকতার অভ্যাস ছুড়ে ফেলে সবাই মিলে কাজে নামা, কী ভাবে কাজটা করা যাবে তা নিয়ে ভাবা, সেই ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা, সেই চেষ্টা থেকে নতুন ভাবনার রসদ সংগ্রহ করা। চিন্তা করতে করতে কাজ করা, কাজ করতে করতে চিন্তা করা।

মাস্টারমশাইরা অনেকেই সে-ভাবে কাজ করছেন এবং চিন্তাভাবনা করছেন। লার্নিং টুগেদার-এর পাতা ওল্টালে তার কিছু কিছু সন্ধান মেলে। তার বাইরেও অবশ্যই আছেন আরও অনেক উদ্যোগী, আছেন শিক্ষা আলোচনা-র নিজস্ব পরিমণ্ডলের বাইরেও। তাঁরা এই দুঃসময়ে যে যে-ভাবে পারেন ছেলেমেয়েদের যতটা সম্ভব পড়াশোনার ভিতরে রাখার চেষ্টা করছেন, অন্য নানা ভাবেও তাদের এবং তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। এই সহযোগ তাঁদের কাছে নতুন কিছু নয়, স্বাভাবিক সময়েও তাঁরা ছাত্রছাত্রীদের সন্তান মনে করেন, এখন সন্তানরা বিপন্ন, তাই তাদের নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বেড়েছে, সাহায্যের চেষ্টাও জোরদার হয়েছে। সত্য সে যে সুকঠিন— বহু শিক্ষক এই লড়াইয়ে শামিল নন, তাঁরা দিনগত পাপক্ষয়ে আছেন সুখে হাস্যমুখে। কিন্তু আপাতত তাঁদের কথা থাকুক, সঙ্গে থাকুক এই আশাটুকু যে, যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের দেখে এঁরাও অনেকেই হয়তো জাগ্রত হবেন, অনুপ্রাণিত হবেন, এবং লজ্জিত হবেন। ব্যক্তিগত ও সামাজিক লজ্জা থেকে পৃথিবীতে অনেক ভাল কাজ হয়েছে। এবং, আমরা সবাই একেবারে নির্লজ্জ হয়ে যাইনি— এই বিশ্বাসটুকু হারালে গুরুদেব পাপ দেবেন।

লজ্জায় হোক, প্রেরণায় হোক, নিজস্ব তাগিদে হোক, সহযোগের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসতে পারেন কেবল শিক্ষক নন, বৃহত্তর সমাজের বহু নাগরিকও। বস্তুত, সেটা এখন কেবল কাম্য নয়, জরুরি, এমনকি অপরিহার্য। কেন অপরিহার্য, শিক্ষা আলোচনা প্রকাশিত প্রতিবেদনের পূর্বকথা-তে অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী সেটা সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিয়েছেন। তাঁর মূল বক্তব্য: এই দেড় বছরে অগণন ছেলেমেয়ের লেখাপড়া যে ভাবে ব্যাহত বা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়েছে, স্কুল খোলার পরেও সেই সমস্যা চলে যাবে না; বরং তখন সঙ্কটের পুরো চেহারাটা দেখতে পাওয়া যাবে। পঠনপাঠনের প্রচলিত কাঠামোয়, শিক্ষকদের উপরে পুরো বোঝা চাপিয়ে দিয়ে এই বিপুল সমস্যার মোকাবিলা সম্ভব নয়। চাই বিশেষ পরিকল্পনা অনুসারে বিশেষ কর্মসূচি আর তা রূপায়ণের বিশেষ উদ্যোগ। বিভিন্ন অঞ্চলে অতিমারির বিভিন্ন এবং পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেই লড়াই চালাতে হবে। কাজটা করতে হবে একটা ‘মিশন মোড’-এ— নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণের দায়িত্ব নিয়ে। এবং সে জন্য দরকারি হল ‘স্কুলের পাশাপাশি সমাজের অংশগ্রহণ’ (কমিউনিটি পার্টিসিপেশন অ্যালংসাইড ফর্মাল স্কুলিং)।

এখানে ‘সমাজ’ বলতে স্পষ্টতই বুঝতে হবে সেই নাগরিকদের, যাঁরা স্কুলের শিক্ষক নন, কিন্তু ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় সাহায্য করতে আগ্রহী এবং সমর্থ। অর্থাৎ, একটা বড় অর্থে, যাঁরা স্বেচ্ছা-শিক্ষক হতে প্রস্তুত। তাঁদের অনেককেই কিছু কিছু জিনিস একটু জেনে এবং বুঝে নিতে হবে, কারণ ছাত্রছাত্রীদের, বিশেষ করে ছোটদের শেখানোর কাজটা ঠিক ভাবে করতে গেলে শিক্ষকতার একটা মৌলিক প্রশিক্ষণ থাকলে সুবিধে হয়। এই জানা এবং বোঝার কাজটাতে শিক্ষকরা তাঁদের সাহায্য করতে পারেন। সাহায্য করতে পারেন ছাত্রছাত্রীদের কার কী প্রয়োজন সেই বিষয়ে তাঁদের অবহিত করতে। এবং সাহায্য করতে পারেন অভিভাবকদের সঙ্গে এই স্বেচ্ছা-শিক্ষকদের সংযোগ তৈরি করে দিতে। পাশাপাশি, কী পড়াতে হবে, তারও একটা রূপরেখা তৈরি করে দেওয়া ভাল। এই বিষয়ে কিছু ধারণা এই প্রতিবেদনে দেওয়া হয়েছে, উদ্যোগী শিক্ষকরা আরও বিশদ পরামর্শ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন।

মনে হতে পারে, এ-সবই হল ভাল ভাল কথা, কিন্তু অবাস্তব, আমাদের সমাজে এ ভাবে হয় না। কবুল করব, কিছু কাল আগে নিজের মনেও এই সংশয় প্রবল ছিল। সরকারি যন্ত্র ও যন্ত্রীদের প্রগাঢ় ঔদাসীন্য সংশয় বহুগুণে বাড়িয়েছে, সে-কথাও অনস্বীকার্য। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলবে, না মহামান্য শাসকদের বোধোদয় হবে, জানি না। হলে ভাল, তবে ভরসা বিশেষ নেই। কিন্তু গত এক বছরে, বিশেষত কয়েক মাসে শিক্ষকদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে, তাঁদের আন্তরিক তাগিদ আর অনলস উদ্যোগ দেখে, এবং তাঁদের নানা অভিজ্ঞতার কথা শুনে সংশয়ের খাঁচায় বন্দি থাকা অসম্ভব বলে মনে হয়েছে। একটা ছোট্ট দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে এই প্রতিবেদনটি থেকেই। পূর্ব মেদিনীপুরের এক শিক্ষক লিখেছেন, ঘরবন্দির সময়ে ছেলেমেয়েদের কাছে পৌঁছতে পারছিলেন না তিনি। তখন কিছু প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীর সাহায্য চাইলেন, যারা ওই শিশুদের কাছাকাছি থাকে। তারা সাগ্রহে এবং সানন্দে এগিয়ে এল, কেবল প্রশ্নোত্তরের খাতাপত্র পৌঁছে দেওয়া নয়, ছোটদের উৎসাহ দেওয়া, তাদের দরকার মতো পড়া বুঝতে সাহায্য করা, এমনকি বইপত্র থেকে তাদের পড়ে শোনানো, এমন নানা কাজ করল তারা। ওই শিক্ষক জানিয়েছেন, কিছু স্থানীয় গৃহশিক্ষকও এই উদ্যোগে শামিল হয়েছেন, স্বেচ্ছা-শিক্ষক হিসাবেই।

এমন দৃষ্টান্ত সর্বত্র সুলভ হয়তো নয়, কিন্তু বিরলও বলা যাবে না, গত এক বছরের পত্রপত্রিকা— এই সংবাদপত্রও— তার অনেক সাক্ষ্য বহন করেছে। এবং এটাও লক্ষ করেছি যে, সাম্প্রতিক কালে এমন সক্রিয় আগ্রহের সংবাদ ক্রমশ সংখ্যায় বেড়েছে, বেড়ে চলেছে। তার কতটা সমাজের উৎসাহ বৃদ্ধির কারণে আর কতটা এ-ধরনের খবর দিতে সংবাদমাধ্যমের আগ্রহ বৃদ্ধির ফলে, জানি না, কিন্তু দুটোই আশা জাগায় যে, সমাজে দুষ্টচক্রের মতোই সুস্থচক্রও থেমে থাকবে না। সেই চাকাটি নিউ টাউনের ওই ছোট্ট মেয়ে দু’টির পাশে গিয়ে দাঁড়াবে, তাদের পড়তে লিখতে জানতে বুঝতে সাহায্য করবে, তাদের একলা-মায়ের দুশ্চিন্তা একটুখানি কমবে।

অধ্যাপক চৌধুরী তাঁর পূর্বকথায় লিখেছেন, এই সামাজিক উদ্যোগ একটা বড় পরিবর্তনের অনুঘটক হয়ে উঠতে পারে, যা অতিমারি-জনিত বিশেষ প্রয়োজনের সীমা ছাড়িয়ে সাধারণ ভাবে শিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের এত দিনের পিছিয়ে-থাকার ইতিহাস পাল্টে দিয়ে এক নতুন সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। পূর্ণ সাক্ষরতার সম্ভাবনা, সত্যিকারের সর্ব-শিক্ষার সম্ভাবনা, সামগ্রিক ভাবে শিক্ষার চিত্রটা বদলে দেওয়ার সম্ভাবনা। তিনি খেয়াল করিয়ে দিয়েছেন, এই প্রতিবেদনের শিরোনামে বলা হয়েছে ‘সর্বজনীন শিক্ষা অর্জনের একটা সুযোগ’-এর কথা। কথাটা সত্যিই ধাক্কা দেয়— এই ঘোরা রজনীকে ‘সুযোগ’ বলে দেখার কথা উঠছে কী করে? ধাক্কাটা যথেষ্ট জোরদার হলে কিন্তু এই সুযোগকে কাজে পরিণত করা যাবে। আমরাই তা করতে পারি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement