আন্তর্জাতিক সীমানা পেরোতে কি আবশ্যক হবে কোভিডের টিকা নেওয়ার সার্টিফিকেট— ‘ভ্যাকসিন পাসপোর্ট’? টিকার ছাড়পত্রের ধারণা যদিও নতুন নয়। কিছু দেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে ১৯৬৯ সাল থেকেই চলে আসছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) অনুমোদিত ‘ইয়েলো কার্ড’— পীতজ্বর ও অন্য কিছু অসুখের প্রতিষেধক নেওয়ার প্রমাণ হিসেবে। গুটিবসন্তের টিকা নিয়ে সীমান্ত পেরোনোর ব্যবস্থা চালু হয় দেড় শতক আগে। টাইম ম্যাগাজ়িনের এক প্রতিবেদন থেকে ১৮৮৫ নাগাদ এই বিষয়ের আমেরিকান রূপরেখার কথা জানা যায়। কানাডার কুয়েবেক থেকে আমেরিকার ভারমন্ট প্রদেশে রেলগাড়ি ঢোকার আগে ট্রেনে উঠতেন চিকিৎসক, পরীক্ষা করে দেখতেন যাত্রীদের গুটিবসন্তের শংসাপত্র বা হাতে টিকা নেওয়ার দাগ। তা না থাকলে সেখানেই টিকা দিতেন। অথবা, আমেরিকা ঢোকার আগে ট্রেন থেকে নেমে যেতে বলতেন। ১৮৯৭-তে জর্জিয়ার সাভানাতে নিয়ম হয়েছিল, বসন্তের টিকার শংসাপত্র দেখালে তবেই স্কুলে ভর্তি হওয়া যাবে। ১৯০৩-এ মেইন প্রদেশে নিয়ম হয়, গুটিবসন্তের টিকার প্রমাণ ছাড়া কাঠের কাজ করা যাবে না। এক সময় হজে যাওয়ার জন্যেও বসন্তের টিকার প্রমাণপত্র দেখাতে হত। ব্রিটিশ ভারতে তীর্থযাত্রার ক্ষেত্রে প্লেগের টিকাকরণের প্রমাণ আবশ্যক করা হয় তৎকালীন বম্বে প্রদেশের পন্ধরপুরে।
সেই ভ্যাকসিন পাসপোর্টই কি নবরূপে উপস্থিত হল? এটাই কি হতে চলেছে চলে-ফিরে বেড়ানোর মন্ত্র? বিমানযাত্রা, রেলযাত্রা, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, শপিং মল, সিনেমা-থিয়েটার সর্বত্রই কি বাধ্যতামূলক হয়ে উঠতে পারে এই পাসপোর্ট? কনসার্ট, বিয়ে বা কর্মক্ষেত্রে যোগ দেওয়ার জন্য দেশের মধ্যে ডিজিটাল পাস চালু করেছে ইজ়রায়েল। প্রতিষেধক-প্রাপ্তদের হাত ধরে বিশ্বজনীন অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের জিয়নকাঠি হয়ে উঠবে টিকার ছাড়পত্র, এমনই আশা। অনেকে আবার এই পাসপোর্টের ঘোর বিরোধী। সমাজকে তা নাৎসি জার্মানির মতো নজরদারভিত্তিক ব্যবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে করছেন তাঁরা। ভ্যাকসিন পাসপোর্ট চালু হলে এক দলের জন্য দুনিয়ার দরজা খুলে যাবে সহজেই, প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হবে বাকিরা। এর প্রয়োগজনিত, নীতিগত ও কূটনৈতিক পরিণতি নিয়ে সতর্ক করেছে হু। আমেরিকায় টেক্সাস ও ফ্লরিডার গভর্নরেরা এ ধরনের পাসপোর্ট নিষিদ্ধ করেছেন। ল্যানসেট জার্নালের এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ভ্যাকসিন পাসপোর্ট নিয়ে অভিন্ন নীতি ঠিক করতে না পারলে তৈরি হবে কূটনৈতিক সঙ্কট, প্রশস্ত হবে ধনী ও দরিদ্র দেশের বিভাজন।
টিকা নিয়ে কূটনৈতিক গোলযোগ কোভিডের আগেও দেখা গিয়েছে। ২০১২-তে দক্ষিণ আফ্রিকায় ঢোকার সময় পীতজ্বরের টিকাকরণের প্রমাণ না থাকায় ১২৫ জন নাইজেরিয়ানকে আটকানো হয়। পর দিনই নাইজেরিয়ায় ঢুকতে আটকানো হয় ২৮ জন দক্ষিণ আফ্রিকানকে, ফেরত পাঠানো হয় ৫৬ জন ‘বেআইনি’ অভিবাসীকে। তাই কোভিড টিকার পাসপোর্ট নিয়ে ‘বাড়াবাড়ি’ বুনো ওল আর বাঘা তেঁতুলের গল্প হয়ে উঠতে পারে। সুরক্ষা-বুদ্বুদ নির্মাণের প্রয়াসের সঙ্গে এ যেন দুনিয়ার দখলদারির লড়াইও। চিন যেমন ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে, চিনা টিকা নেওয়া থাকলে সে দেশে ঢোকা সহজ হবে, তা এখনও ‘হু’-এর মান্যতা না পেলেও।
আমেরিকায় ভ্যাকসিন পাসপোর্টের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ প্রবল হয়ে উঠছে। ব্যক্তিস্বাধীনতা লঙ্ঘনের সঙ্গে সামাজিক বৈষম্য বাড়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে। বেড়ে চলা অসাম্য অতিমারিকেও বাড়িয়ে দিতে পারে, ভাবছেন কেউ কেউ। হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি নাহয় জানিয়েছেন যে, বাইডেন সরকার দেশব্যাপী ভ্যাকসিন পাসপোর্ট চালু করবে না, কিন্তু সামাজিক ক্ষেত্রের কতটা দখল নেবে এই পাসপোর্ট, টিকার প্রমাণ ছাড়া কোথায় নেমে যেতে হবে ট্রেন থেকে, কোথায় কলেজে ভর্তিতে চাওয়া হবে প্রমাণপত্র, সেই হিসেব কে রাখবে?
ভ্যাকসিন পাসপোর্টের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও নতুন নয়। একশো বছর আগে আমেরিকায় জোর করে দেওয়া টিকার চিহ্নকে চিকিৎসা ব্যবস্থার স্বৈরাচারের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়েছে। এখন অবশ্য সমাজজীবনের স্বাভাবিক অংশগ্রহণকেই স্বাধীনতা বলে ভাবতে শিখছেন বহু মানুষ। তবু এও ঠিক, টিকার পর্যাপ্ত জোগান নেই বহু দেশে। কিছু দেশে প্রায় কোনও টিকাই পৌঁছয়নি। অনেক দেশেই এ পর্যন্ত টিকার দুটো ডোজ় পেয়েছেন ৫ শতাংশেরও কম। তাই আপাতত দুনিয়ার অসংখ্য মানুষের এই ভ্যাকসিন পাসপোর্ট জোগাড় করার সুযোগই নেই। সামাজিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার এই জাদুকাঠি তাই গোটা বিশ্বেই পুনঃসংজ্ঞায়িত করতে পারে ‘হ্যাভস’ আর ‘হ্যাভ-নটস’-দের। মূলত সম্পন্ন মানুষ এবং ধনী ও সুবিধাপ্রাপ্ত দেশের নাগরিকেরাই যে নতুন ‘হ্যাভস’ তৈরি করবে, তা-ও সভ্যতার চিরকালীন চরিত্র।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা