গ্রামের মানুষের প্রযুক্তি-প্রতিভা বিকল্প শিক্ষার পথ হতে পারত
Education

যতই আমরা তাচ্ছিল্য করি

আমাদের বদ্ধমূল ধারণা, যা কিছু জ্ঞানের কথা, সে সব ইংরেজিতেই পড়তে হবে।

Advertisement

তৃষ্ণা বসাক

শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০২২ ০৪:৫৬
Share:

বাসন্তীর ছেলের জন্মগত অসুখ, আর পাঁচটা শিশুর মতো বাড়তে পারেনি, হাঁটতেও পারত না বাচ্চাটি অনেক দিন পর্যন্ত। বাসন্তী করলেন কী, উঠোনে একটা গর্ত করে চার দিকে কাঠের খুঁটি পুঁতে ঘিরে দিলেন। তার মধ্যে ছেলেকে দাঁড় করিয়ে রাখলেন দিনের পর দিন। এই করতে করতে পায়ের জোর বাড়ল ছেলের, তার পর তিনি গাছের ডাল দিয়ে দুটো ক্রাচ তৈরি করে দিলেন। প্রথমে দুটো ক্রাচ। তার পর এক দিন একটা সরিয়ে দিলেন, এই ভাবে ছেলে হাঁটতে শিখে গেল। এক দিকে বাবা, অন্য দিকে মা বসে থাকতেন, বাবার কাছ থেকে দৌড়ে মার কাছে যেতে পারলে ছেলেটা পেত তার প্রিয় মিষ্টি।

Advertisement

আর এক ঘটনা। মায়ের ঠাকুরঘরটি বড় অন্ধকার, বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়তে অসুবিধে হয় মার। তাঁর ছেলে ঠাকুরঘরের ছাদের একটি টালি সরিয়ে তার বদলে একটি কাচ লাগিয়ে দিলেন। ঠাকুরঘর ঝলমলিয়ে উঠল, মা এখন দিব্যি পাঁচালি পড়তে পারেন।

এঁরা দু’জনেই গ্রামের বেশি লেখাপড়ার সুযোগ না-পাওয়া মানুষ। ইঞ্জিনিয়ারিং বা পলিটেকনিক পড়তে পারেননি। শহর থেকে অনেক দূরে প্রত্যন্ত গ্রামে থাকার কারণে অনেক সুযোগ তাঁদের কাছে পৌঁছয়নি। তার উপর বাসন্তী নিরক্ষর, নামসইটুকু করতেও পারেন না। বাংলাদেশের এক গ্রামে বাসন্তীর মতোই এক নারী আবার গ্রামের সব বাড়ির ফিউজ় পাল্টানো, কল সারানো করে বেড়াতেন। তাঁর নাম খোদেজা থেকে হয়ে গিয়েছিল খোদে ভাই! (প্রযুক্তি একচেটিয়া পুরুষের বিষয় কিনা! জাপান যাত্রীর ডায়রি-তে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে সব কাজে উদ্ভাবনার দরকার নেই, যে সব কাজে পটুতা পরিশ্রম ও লোকের সঙ্গে ব্যবহারই সবচেয়ে দরকার, সে সব কাজ মেয়েদের।) এঁদের প্রত্যেকেরই প্রাযুক্তিক প্রতিভা ছিল, যা কাজে লাগানো যায়নি।

Advertisement

এ দেশে প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ চাষের সঙ্গে যুক্ত, কিন্তু জিডিপিতে তার প্রতিফলন মাত্র ২০ শতাংশ। তাই চাই অনেক কৃষি-সংক্রান্ত উদ্ভাবন। আর সে কাজে গ্রামের মানুষরাই সবচেয়ে ভাল ফল পেতে পারেন। কিন্তু তাতে দু’টি বাধা। এক তো ইংরেজি ভাষার উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ। অন্যটি গ্রাম আর শহরের মানসিক দূরত্ব।

আমাদের বদ্ধমূল ধারণা, যা কিছু জ্ঞানের কথা, সে সব ইংরেজিতেই পড়তে হবে। তাই একান্ত দেশি প্রযুক্তি বানাতে, তা নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে বা পেপার লিখতেও ইংরেজির দরকার। কিন্তু বিনা স্বদেশি ভাষা কোনও আশাই পুরে না, প্রাযুক্তিক উদ্ভাবনেও বাধা আসে। মাতৃভাষায় বিজ্ঞান শেখা এবং নিজেদের বানানো যন্ত্র নিয়ে মাতৃভাষায় মত বিনিময় করতে না পারলে গ্রামের ছেলেমেয়েরা উদ্ভাবনী প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও তারা নিজেদের মেলে ধরতে পারে না।

ইমপ্যাক্ট অব ভার্নাকুলার ল্যাঙ্গোয়েজ ইন এফেক্টিভ সায়েন্স কমিউনিকেশন নামে একটি গবেষণায় ১০০ জন ১৪ থেকে ১৭ বছরের ছেলেমেয়েকে দু’টি ভাগে ভাগ করে অর্ধেককে ইংরেজিতে, বাকি অর্ধেককে তাদের মাতৃভাষায় বিজ্ঞানের প্রাথমিক কিছু তত্ত্ব পড়ানো হল। দেখা গেল, নিজেদের মাতৃভাষায় ছেলেমেয়েরা অনেক দ্রুত এবং অনেক গভীর বিজ্ঞান প্রযুক্তির ধারণা তৈরি করতে পেরেছে। অথচ, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কংগ্রেসে বাংলায় গবেষণাপত্র লিখে জমা দেওয়া যায় বলে, তা নিয়ে অনেক শিক্ষিত মানুষের তাচ্ছিল্য চোখে পড়ার মতো।

গ্রামে যে প্রাযুক্তিক প্রতিভা আছে, তার চমৎকার একটা ছবি উঠে আসে হিন্দি ভাষার প্রখ্যাত লেখক ফণীশ্বরনাথ রেণুর একটি গল্প ‘পঞ্চলাইট’-এ। মাহাতো টোলীর পঞ্চায়েত রামনবমীর মেলা থেকে একটি পেট্রোম্যাক্স কিনেছে। রুদল শাহ বেনের দোকান থেকে কয়েক বোতল কেরোসিন তেলও এসেছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এখন এই কলকব্জাওয়ালা জিনিস জ্বালাবে কে? শেষ অবধি ডাক পড়ে তরুণ তুর্কি গোধনের, কিছু দিন আগে পঞ্চায়েতের আদেশে যার হুঁকোপানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে— গাঁয়ের মেয়ে মুনরিকে দেখে প্রেমের গান গাওয়ার অপরাধে। সেই গোধনকে অবরোধ মুক্ত করে পঞ্চলাইট জ্বালতে ডাকা হয়। সে এসে দেখে স্পিরিট নেই। তার উদ্ভাবনী বুদ্ধি খুঁজে নেয় স্পিরিটের বিকল্প নারকেল তেল। “মুনরি দৌড়ে গিয়ে এক মালশা নারকেল তেল নিয়ে এল। গোধন পঞ্চলাইটে পাম্প দিতে থাকে। ধীরে ধীরে পঞ্চলাইটের রেশমের থলিতে আলো আসতে লাগল। গোধন কখনও মুখ দিয়ে ফুঁ দেয়, কখনও পঞ্চলাইটের চাবি ঘোরায়। একটু পরেই পঞ্চলাইট থেকে শোঁ-শোঁ আওয়াজ উঠতে শুরু করে, রোশনি বাড়তে থাকে, সবার মনের ময়লা দূর হয়ে গেল।”

আসলে বাধা শুধু ইংরেজি ভাষাই নয়, গ্রাম আর শহরের মনের ভাষাও আলাদা। অর্থাৎ শহরের শিক্ষণ আর গ্রামের শিক্ষা গ্রহণ— এ দুয়ের মধ্যে অনেক ‘ডটেড লাইন’ বা না-বলা দূরত্ব থেকে গেছে। তা হলে কী ভাবে শহরের প্রযুক্তিবিদ গিয়ে গ্রামকে প্রাযুক্তিক কৌশল শেখাবেন? শিবরামের সেই বিখ্যাত গল্পের কথা মনে পড়ছে। “অনেকের ধারণা ধান গাছে তক্তা হয়, আসলে তা নয়, তক্তা হয় পাট গাছে। তাই নৌকার কাঠকে পাটাতন বলে।”

কিংবা তারাপদ রায়ের সেই গল্প ‘বিশেষজ্ঞ’— যেখানে শহরের কৃষি বিশেষজ্ঞ গ্রামের এক চাষিকে জিজ্ঞেস করছেন সে কি ‘এই’ ‘এই’ ভাবে গাছের যত্ন নিচ্ছে, বিভ্রান্ত চাষিটি যখন জানায় সে এ সব কিছুই করেনি, তখন হতাশ বিশেষজ্ঞ বলেন “আমি অবাক হয়ে যাব যদি আপনি এই গাছে এক কেজির বেশি কাজু বাদাম পান।” চাষিটি উত্তরে বলেন, তিনিও খুব অবাক হবেন যদি এই গাছে একটিও কাজু বাদাম হয়— কারণ এটা শ্যাওড়া গাছ!

তবুও এর মধ্যেই অনেকে বিন্দুগুলো জোড়ার চেষ্টা করে চলেছেন। পেশায় অর্থনীতিবিদ বিভা গুপ্তর গবেষণার বিষয় ছিল ‘ট্রান্সফার অব টেকনোলজি অ্যামংস্ট রুরাল উইমেন’। ১৯৭৬ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন সেন্টার অব সায়েন্স ফর ভিলেজার্স (সিএসভি) মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধায়। এখানে সত্তরের বেশি গ্রামীণ প্রযুক্তি তৈরি হয়েছে, যেমন বায়োগ্যাস, মাটির বাড়ি, কম খরচে শৌচাগার, মধু ও আঠা তৈরি, ভেষজ কীটনাশক ও সার, বৃষ্টির জল ধরে রাখা, কলাগাছের কাণ্ড থেকে হাতে তৈরি কাগজ, জ্বালানি বাঁচানো রান্না আর সংরক্ষণের ব্যবস্থা, কম খরচের ফিল্টার, এমন কত কী।

আইআইটি বম্বে-র সেন্টার ফর টেকনোলজি অলটারনেটিভস ফর রুরাল এরিয়াজ় নামক প্রতিষ্ঠানও এই সব নিয়ে প্রচুর কাজ করে চলেছে ১৯৮৫ সাল থেকে। তারা ‘রুরাল উইম্যান সেলফ-হেল্প গ্রুপ’কে ৭০ লক্ষ সৌর বাতি তৈরির প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। সম্প্রতি রুকার্ট টেকনোলজি নিয়ে এসেছে বিজলি, জেনারেটর বা সৌর শক্তি ছাড়াই চলা এক আনাজ-কুলার। আইআইটি বম্বে’র সহায়তায় তৈরি এই প্রযুক্তি এক সপ্তাহ আনাজ, ফল, ফুল তাজা রাখে। যাতে চাষি বাজারে তাজা কৃষিপণ্য বিক্রি করে সঠিক দাম পান। ‘এনহ্যান্সড ইভাপোরেটেড কুলিং’ দিয়ে এটা সম্ভব।

‘নতুন মানুষ’ বলে একটি কল্পবিজ্ঞানের গল্পে দেখানো হয়েছে, আজ থেকে কয়েকশো বছরের পরের একটি শিক্ষিত তরুণী লিখতে বা পড়তে পারে না, কিন্তু পিক্টোরিয়াল কমিউনিকেশনে সে পারদর্শী। সে সব কিছু ছবি দিয়ে বোঝে। অর্থাৎ ভাষার বাধা আর কোনও বাধাই থাকে না। এই ভাবেও ভাবা যায়।

অ্যালভিন টফলার বলেছিলেন, যারা লিখতে পড়তে জানে না— একুশ শতকে তাদের নিরক্ষর বলা যায় না। বরং যারা শিখতে (লার্ন) গিয়ে, পুরনো শেখা ভুলে (আনলার্ন) আবার নতুন করে শিখতে (রিলার্ন) পারে না, তাদেরই এই অভিধা দেওয়া যায়। এই দেশে ডিজিটাল মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে বিকল্প শিক্ষা দিতে পারলে আমাদের গ্রামের ‘নিরক্ষর’ মেয়ে বাসন্তী বা খোদেজারাও নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে পারেন বইকি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement