পরিবেশের প্রশ্ন জড়িয়ে রয়েছে অর্থনীতি আর রাজনীতির সঙ্গে
Environment

লোভ, অসাম্য, আশঙ্কা

এই সময় একই সঙ্গে এমনও ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, পরিবেশের অবক্ষয় এবং প্রাকৃতিক সম্পদের নিঃশেষ হয়ে আসার প্রক্রিয়াটি ভয়ঙ্কর গতিতে এগিয়ে চলছে।

Advertisement

সুনীতা নারায়ণ

শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ১০:৪২
Share:

আমরা এখন এক প্রবল দিশাহারা সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এমন এক সময়, যখন ভূ-রাজনীতির ক্ষেত্রে তীব্র গোলযোগ আর অভূতপূর্ব সংঘর্ষের সম্মুখীন হতে হয়েছে বিশ্বকে। এমন এক সময়, যার মাথার উপরে জমে রয়েছে অর্থনৈতিক সঙ্কট ও বাণিজ্য যুদ্ধের ঘোর কৃষ্ণবর্ণ মেঘ। এবং এই সময় একই সঙ্গে এমনও ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, পরিবেশের অবক্ষয় এবং প্রাকৃতিক সম্পদের নিঃশেষ হয়ে আসার প্রক্রিয়াটি ভয়ঙ্কর গতিতে এগিয়ে চলছে। ২০২৪ সালের শেষে দাঁড়িয়ে বলতে পারি যে, ফেলে আসা বছরটিতে দুনিয়া পাল্টেছে বহুবিধ ভাবে। এই বছরেই প্রত্যেক দিন বিশ্বের কোনও না কোনও অংশ চরম আবহাওয়াজনিত ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে, তাপপ্রবাহ এবং শৈত্যপ্রবাহের নতুন রেকর্ড গড়েছে, আবার তা ভেঙেও গিয়েছে; যে সব সম্প্রদায় এমনিতেই বিপন্ন, ক্রমাগত বিপর্যয়ের ধাক্কা সামলে উঠতে না পেরে তারা বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে।

Advertisement

আমরা এক ভিন্ন যুগে প্রবেশ করেছি। বিজ্ঞানীরা একে ব্যাখ্যা করছেন, ‘অ্যানথ্রোপসিন এপো’। ভূতাত্ত্বিক ভাষায় এই পর্বের সংজ্ঞা নিরূপণ করা যায় এই ভাবে— যখন মানুষের কাজকর্ম এই নীল গ্রহের জলবায়ু এবং বাস্তুতন্ত্রের উপরে লক্ষণীয় প্রভাব ফেলেছে। সভ্যতার অগ্রগতির জন্য আমরা যা যা করেছি— আরও ভাল থাকার স্বার্থে এবং সম্পদ উৎপাদনের জন্য— দেশের এবং এই গ্রহের সুস্থ থাকার সমস্ত শর্ত ভেঙে দিয়েছে। এই সময়কাল বেশ কিছু দিঙ্‌নির্ণয়কারী পরিবর্তনেরও সাক্ষী। পরিবর্তন— মানুষ হিসাবে আমাদের একে অপরের প্রতি আচরণে, ‘ঠিক এবং ভুল’-এর বৈশ্বিক মাপকাঠিতে, এবং কৃত্রিম মেধা সংক্রান্ত প্রযুক্তির ক্ষেত্রে— যা অদূর ভবিষ্যতে সর্বব্যাপী চালকের আসন দখল করবে।

কিন্তু এই সব কিছুর মধ্যে, আমরা আস্থা রেখেছি নতুন যুগের প্রযুক্তির উপরে। আজকের বৃহৎ প্রযুক্তি সংস্থাগুলি সর্ব-নিয়ন্ত্রক সাম্রাজ্য হিসাবে গড়ে উঠেছে— তাদের তুলনায় অতীতের বহুজাতিক সংস্থাগুলিকে এখন চুনোপুঁটি মনে হয়— তাদের প্রভাব এখন দেশের গণ্ডি অতিক্রম করে আমাদের জীবনকে যে ভাবে স্পর্শ করেছে, তা আগে কখনও দেখা যায়নি। আজ সেই অতিবৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর কর্তারা শুধু প্রযুক্তি বা মিডিয়াতে নয়, রাজনীতির পরিসরেও পরিবর্তন ঘটানোর কান্ডারি। অতিবৃহৎ ব্যবসা আরও অনেক বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠতে চায়— এবং, সরকারের জোর যত কমে, তাদেরও ততই শক্তিবৃদ্ধি হয়। অধিকাংশ সরকারই এক ভ্রান্ত ধারণায় ভোগে যে, তারাই নীতি নির্ধারণ করে এবং সেগুলি জনস্বার্থ রক্ষার কাজটিই করে। কিন্তু বাস্তবে সরকারগুলি সেই জায়গাটি ছেড়ে দিয়েছে বৃহৎ পরামর্শদাতা সংস্থা, ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্ক এবং বেসরকারি পুঁজির হাতে। গণপরিসরের বেসরকারিকরণ ঘটে গিয়েছে, এবং আমরা শুধু নীরব দর্শক। গণতন্ত্র মরে যায়নি, কিন্তু ব্যবসা এবং আমার-আপনার মতো উপভোক্তা শ্রেণির চক্রে পড়ে আজ তার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। এবং এর সমস্ত কিছু ঘটছে এই জলবায়ু পরিবর্তনের কালেই।

Advertisement

একের পর এক এ-হেন বিপুল পরিবর্তনের কারণে আজ আমাদের বিশ্ব আগের চেয়ে আরও বেশি উদ্বিগ্ন, আরও বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। আমরা এক ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের দুনিয়ায় বাস করছি যেখানে ধনী ধনীতর হচ্ছে, আর দরিদ্র দরিদ্রতর। গত পাঁচ বছরে কোভিড-১৯ অতিমারি বিশ্ব-অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেওয়ায় এই বিভেদ আরও চওড়া হয়েছে। এবং এই ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই এসেছে একের পর এক যুদ্ধ। ফলে দেশগুলির হাতে ক্ষত সারিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর মতো অর্থের উৎস অপ্রতুল হয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে জুড়েছে মন্দ প্রশাসন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সম্পদ সঙ্কোচন, যার পরিণতিতে দেখা দিয়েছে পরিযাণের ক্রমবৃদ্ধি। কারণ, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষ নতুন সুযোগ খুঁজতে বাধ্য। এই সমস্ত কিছু মানুষের ক্রোধ এবং নিরাপত্তাহীনতায় অগ্নিসংযোগ করেছে, যা এই শ্রেণির নতুন ব্যবসায়ী নেতা এবং প্রবল ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকা উন্নত প্রযুক্তির যুগে গণতন্ত্রকে বলি দিয়েছে এক বিদ্বেষপূর্ণ এবং মেরুকরণের দুনিয়ার হাতে।

এই ক্রোধ শুধুমাত্র বিশ্বের দরিদ্রদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। ধনীরাও নিজেদের প্রতারিত মনে করছেন— অন্তত এই ভাবেই তাঁরা দেখছেন। যখন বিশ্ব নব্বইয়ের দশকে অর্থনীতিগুলিকে যুক্ত করার পথে হেঁটেছিল, তখন দরিদ্ররাই সবচেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন কাজ হারানোর আশঙ্কায়। কৃষকরা রাস্তায় নেমেছিলেন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে, যা তাঁদের জীবিকার পথে অন্তরায় হয়ে উঠতে পারত। আজ, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পরিবর্তিত। এই নতুন অর্থনীতি থেকে এ বার বাদ পড়েছেন উন্নত বিশ্বের শ্রমিকরাই। তাঁদের ভাষায় সেই সব ‘শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী এবং বিশেষজ্ঞ শ্রেণি’র বিরুদ্ধে তাঁরা রুখে দাঁড়াচ্ছেন, যাঁরা এই পরস্পর-সংযুক্ত বিশ্বের পরিষেবা আর অর্থনীতির দ্বারা উপকৃত। এই শ্রেণি-সংগ্রামের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হল নতুন ভাবনার প্রত্যাখ্যান। মানুষ এখন যে কোনও তথ্য বা জ্ঞানকে পক্ষপাতদুষ্ট ভাবছে, মনে করছে তা কারও ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষা করছে মাত্র। এর ফল হল, উত্তরোত্তর বাড়তে থাকা বিপর্যয়ের মুখে সহায়তার প্রয়োজন তীব্র হওয়া সত্ত্বেও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো জনস্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়কেও দেখা হচ্ছে সন্দেহের চোখে। এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচন আশঙ্কা তৈরি করছে যে, এই জ্ঞানের প্রতি প্রত্যাখ্যানের মনোভাবও বাড়বে।

এইখানেই জলবায়ু সঙ্কটের প্রসঙ্গ আবার চলে আসে। আমরা এক চরম জলবায়ুর যুগে বাস করছি— আমাদের চার পাশে বিপর্যয় ঘটে চলেছে। কিন্তু এর সমাধানে আমরা যথেষ্ট চেষ্টা করছি না। আমরা একে অস্বীকার করছি না, কিন্তু এক সর্বজনীন স্বার্থে একযোগে কাজ করার মতো সমাজ হিসেবেও আর আমরা নিজেদের গড়ে তুলছি না। এই কারণেই বাকুতে ২৯তম কনফারেন্স অব পার্টিজ়-এ আমরা এক যৌথ সহযোগী বিশ্ব গড়ে তোলার ইচ্ছাপ্রকাশের ভানটুকুকেও ঝেড়ে ফেলে দিলাম। ধনী বিশ্ব সরকারি ভাবে জলবায়ু-অনুদানের নামে সামান্য খুদকুঁড়ো ছুড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। এবং ঐতিহাসিক ভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী এই বিশ্ব জানাল, অপর যে বিশ্বকে কার্বন-হীন উন্নয়নের পথটি নতুন করে ভাবতে হবে, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে এবং ক্ষতির ধাক্কা সয়ে বেঁচে থাকতে হবে, তাদের এই ‘যথেষ্ট’ পরিমাণেই কাজ চালিয়ে নিতে হবে। এটা অপমান বইকি!

এইখানেই অর্থনীতি, জলবায়ু পরিবর্তন আর রাজনীতি পরস্পরের সঙ্গে মিশে যায়। বিশ্বায়নের প্রতিশ্রুতি ছিল যে, তা এক সমৃদ্ধতর এবং নিরাপদতর বিশ্ব গড়ে তুলবে। দেশগুলি পরস্পরকে আক্রমণ করবে না, কারণ নিজেদের স্বার্থেই তারা সহযোগিতার পথে থাকবে। কিন্তু শিল্প অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার আসল কারণ হল— শ্রম এবং পরিবেশের রক্ষাকবচগুলির পিছনে খরচ কমানো। এই খরচ বহন করতে গেলে উৎপাদন ব্যয়বহুল হয়ে পড়ার সম্ভাবনা। উন্নত দেশগুলি থেকে উন্নয়নশীল বিশ্বে উৎপাদন সরিয়ে দেওয়া হল, ফলে উন্নত দেশগুলিতে কার্বন নিঃসরণও কমল। আমরা কার্বন ডাইঅক্সাইড ব্যালান্সশিট থেকে জানতে পেরেছি যে, চিন প্রথম বিশ্বের উৎপাদক হয়ে ওঠে, এবং পরবর্তী কালে অন্যরাও যোগ দেয়। আজ, যেখানে বিশ্বের প্রয়োজন পরিবেশবান্ধব পথে হাঁটা, সেখানে সে নতুন ধরনের বাস্তবতার সম্মুখীন হচ্ছে। এই ‘অন্য’ বিশ্বে, বিশেষত চিনে সমস্ত পরিবেশবান্ধব জিনিসের উৎপাদন এখনও ‘সস্তা’।

ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজের দেশে ব্যবসা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এক বাণিজ্য-যুদ্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু এতে খরচ বাড়বে, আর্থিক এবং পরিবেশগত দিক থেকে, কারণ বিশ্ব বাণিজ্যের ক্ষেত্রে খুব বেশি মাত্রায় পরস্পর সংযুক্ত। ফলে চট করে সম্পর্ক ছেঁড়া কঠিন। এর ফলে কার্বনহীন অর্থনীতির পথে যাত্রাটিও বেসামাল হয়ে পড়বে। কারণ, যা কিছু পরিবেশবান্ধব সবই তো বিদেশি, অতএব তাকে বয়কট করা হোক।

ঠিক এই কারণেই জলবায়ু পরিবর্তনের গোড়ায়, যখন বিশ্ব এক নতুন ‘আজ’-এর দিকে মোড় নিয়েছে, তখন এক ‘অন্য কাল’-এর ভাবনা ভেবে রাখা জরুরি ছিল। আমরা বিগত দিনের হাতে বন্দি হতে পারব না। আমাদের এক নতুন ভোর খুঁজতেই হবে।

সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট, দিল্লি

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement